• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯
পড়া দেখা শোনা

যারা কাজের লক্ষ্য নিয়ে পড়ছেন, তারা এমসিকিউ ধরনের পড়াশোনা করেন

আর্ট : রাকিব

মতামত

পড়া দেখা শোনা

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ০৪ অক্টোবর ২০১৮

পড়া দেখা শোনাঅনেককাল মাস্টারির সূত্রে, চলতে হয় নবীনদের সঙ্গে। ওদের মন-মানসিকতা, চিন্তাধারা বুঝে-চিনে কাজ করতে হয়। শুধু আমি কেন, যিনি যে প্রফেশনেই থাকুন না কেন, এটা করতে হয়। কারণ, প্রবণতাটাই প্রধান। আমরা যে গতিশীলতার কথা বলছি, পরিবর্তনের কথা বলছি, এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছি, সেখানে কে কী চায়, কার কী মানসিকতা-মেজাজ, সেটা জেনে বুঝে চলাটা খুব প্রয়োজন। এবং সেটাই চলছে। নইলে হবে না। গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না, পিছিয়ে পড়তে হবে। আর তাতে নিজেরও পিছিয়ে পড়া। যা হোক, অ্যাপসের এই যুগে আপনি প্রজন্মের প্রবণতাটা কীভাবে বুঝবেন? এখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র ছেলেরাই বেশি পড়ে। বলতে গেলে সেটি প্রায় আশি ভাগ। এই আশি ভাগ ছেলেমেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। তারা মফস্বল থেকে আসে। এখন পড়াশোনাটা তাদের কাছে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তারা পরিশ্রম করে, নম্বর বেশি পাওয়ার চেষ্টা করে, যেটুকু জানে তা আবার অনতি জুনিয়রদের মধ্যে বিতরণ করে দু-চার পয়সা আয়েরও চেষ্টা করে। একটু জানাশোনা হলে কোচিংগুলোতে জায়গা হয়, পয়সা আসে। এমন অনেক আছে— যারা হয়তো বাড়ি থেকে তেমন টাকা-পয়সা নেয় না বা নেওয়ার অবস্থাও নেই। এক ধরনের যুদ্ধ করেই তাদের জীবনযাপন চলে। বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে পড়াশোনাটা এখন ‘কাজ’। জ্ঞান কোনো লক্ষ্য নয়। থাকলেও সেটা নম্বর অর্জনের উপায়। এই দুটি কাজই আমার কাছে ঠিক ভালো ঠেকে না। প্রথমত, যারা কাজের লক্ষ্য নিয়ে পড়ছেন, তারা এমসিকিউ ধরনের পড়াশোনা করেন। মূলত পড়ার চেয়ে দেখা, এটাই লক্ষ্য। ‘দেখা’টা কী? একটা অনুমান, একটা জিনিস দেখে বোঝা, সে বোঝাটা মনগড়া ধরনের, অগভীর, বোধের স্তর নেই, তাৎক্ষণিক— ‘হঠাৎ দেখা’র মতো। এদের ভেতরের সংস্কৃতি শূন্য। সৃষ্টিশীলতা নেই। আত্মবিশ্বাসের আস্থা খুব দুর্বল। অধিকাংশ শিক্ষার্থী এই ‘কাজে’র লক্ষ্য নিয়ে নির্ধারিত নম্বরপ্রাপ্তির পড়াশোনা করছে। এই পড়াশোনা তো ‘দেখা’মাত্র। এই ‘দেখা’ শব্দটার বিশ্লেষণ আমি একটু পরে করছি। দ্বিতীয়ত হলো, নম্বর পাওয়া। এটা হয়তো ওই লক্ষ্যশীল কাজেরই একটা এক্সটেনশন। কিন্তু এর পরিণতি আরো ভয়ঙ্কর। ইতিহাস বা দর্শনের একজন ছাত্র; বা ধরলাম আইনের ছাত্র— সে ভালো ফল করল, ফলের জোরে সে শিক্ষক হলো। শিক্ষক হয়ে সে কী করবে? যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ধরি, তবে তো মারাত্মক বিপর্যয়। এ বিপর্যয় প্রতিদিন চাক্ষুষ করছি। নম্বর ভালো পেয়ে শিক্ষকতায় যারা আসছেন, অন্তত এ সময়ে (সময় ধারাবাহিকতায়) তারা কীভাবে ভালো করবেন (অন্তত গড় চিন্তায়)! তারা যখন চাকরিতে আসছেন, তখন পড়াশোনার চেয়ে দৈনন্দিন ভোগ-প্রতিষ্ঠা-সামাজিক মর্যাদা (মধ্যভিত্তিক তথাকথিত ভাবাবেগ) প্রভৃতি তাদের ধ্যানজ্ঞান হচ্ছে। এবং এটা তো বলাই চলে, এদেশে কেউবা প্রথম জেনারেশন বা দ্বিতীয় জেনারেশন আমরা শিক্ষিত হয়ে উঠছি, ফলে তাদের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠার ভারসাম্য মনে ও মগজে দৃঢ়তর সাম্যহীনতা তৈরি করছে। ভারসাম্য নেই। ফলে শিক্ষকতাটা, তাদের নম্বর পাওয়া ধারায় রয়ে যাচ্ছে। ওই গতানুগতিক নোটবই (হয়তো তার বা আগেও কোনো নোট/শিট), প্রশ্ন করা, নম্বর দেওয়ার [‘দেখা’ ধরনের (অগভীর) মানসিকতা] মধ্যেই সীমিত থাকছে। এই সীমা অতিক্রম করার সাধ্য তার হবে কোথায়! পাঠদানও তেমনই। সেমিনার, গবেষণা, তত্ত্বগত আলোচনা— এসবের বালাই নেই। স্রেফ চাকরি করা। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে, আবার বলি, আমাদের চলতি প্রজন্মের প্রবণতা দুটি- ‘কাজ পাওয়া’ ও ‘নম্বর পাওয়া’। এই দুটি বিষয়ের একটি ‘সংস্কৃতি’  এ সমাজে গড়ে উঠেছে। সেটি পড়া নয়, শেখা নয়— দেখা। পড়ে, বুঝে, শিখে, আত্মস্থ করে, প্রতিদিন সৃষ্টিশীলতার মধ্য থেকে, কৌতূহলী হয়ে কিছু করা নয়; স্রেফ দেখে নিয়ে চলা। ফলে এ প্রজন্ম, ইচ্ছে করলেই ছবি তোলে, ছবি তুলতে গেলে নিজেকে দর্শনীয় করে ‘পোজ’ দেয়, কিংবা দু-চার মিনিটের একটি কর্ম বা অপকর্মের ভিডিও দেখে, কোনো চলতি কাজের ভিডিও পোস্ট করে, তা দেখছে, ফেসবুক দেখছে, নিউজ দেখছে, অনেকগুলো চ্যানেল দেখছে, তাৎক্ষণিক ভিডিও কনফারেন্স দেখছে, তা দেখে আবার পোস্ট দিচ্ছে— এই দেখাদেখির মস্ত এক মহরত চলছে এখন। পড়ার ধৈর্য নেই। আগ্রহও নেই। কার্যত আগ্রহটা শোষণ করেছে দেখাদেখির কাজটি। এমন দেখাদেখির ফলে পড়ার কাজটা নির্বাসনে গেছে। আর তা যখন হয়, তখন জ্ঞান-বুদ্ধি-চিন্তার সম্প্রসারণ ঘটে কী করে! সেটি ঘটানোর জন্য ধৈর্য-সহ্যের পরিবেশও ঠিক থাকে না। এই না থাকাটা আমরা কীভাবে দেখছি? প্রশ্ন হয়, আমরা কী পড়ার কথা বলতে গিয়ে ব্যাকডেটেড কোনো কথা বলছি? জ্ঞানের গভীরতার কথা বলতে গিয়ে পুরনো চাল ভাতে বাড়ে ধরনের ‘পুরনো’ কথা বলছি?

কদিন আগে গ্রামের (গ্রাম তো গ্রাম নেই এখন) একটা কলেজে গেছি। চাকরি দেওয়ার একটা টিমে কাজ করতে। সেখানে অনার্সসহ এমএ পাস করা চাকরিপ্রার্থীদের দক্ষতা তো রীতিমতো হাস্যকর (এত নিম্নমানের)! বাংলা সাহিত্য পড়ে বাংলাদেশের কোনো লেখকের নাম বলতে পারে না, ইংরেজি সাহিত্য পড়ে শেকসপিয়রের একটি ট্র্যাজেডির নাম বলতে পারছে না অথচ এ ধরনের প্রার্থীরাই শিক্ষকতার জন্য আবেদন করে বসে আছেন। এখানে যদি দশজন প্রার্থী থাকে একই অবস্থা। যদি দশটি কলেজের এমন নিয়োগের কাজ করে থাকি— ওই একই অবস্থা। শিক্ষা কতটা নম্বরভিত্তিক বা ‘কাজ’ভিত্তিক (সার্টিফিকেট) হয়ে গেছে! এই লোকদের কাছ থেকে এখনকার আগুয়ান প্রজন্ম কী পাবে? কী শিখবে? প্রশ্নটা তো কালচারের। যে কালচারে পড়ার বালাই নেই, অধিকার করে বসেছে ‘দেখা’-বিষয়ক প্রযুক্তির অত্যাচার— সেখানে কী হতে পারে! এখন ‘দেখা’র কাজটির হয়তো অনেক ভালো দিক আছে। আমি অনেককিছু দেখে ভালো শিখতেও পেরেছি। প্রেজেন্টেশন— অভিনয় দেখা, চলচ্চিত্র দেখা মুগ্ধ হওয়া— দেখা ও শোনার, বোঝা ও জানার যোগাযোগের এসব তো মনোযোগী ও মুখ্য বিষয় ছিল আমাদের। অনেকেই তাতে উপকৃত হয়। মনে রাখাও সহজ হয়। এ পথে তো আমরা গেছি বহুদিন! একটি ছবি দেখার জন্য, একটি বই পড়ার জন্য, একটি নাটক দেখার জন্য ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছি কত জায়গায়! একজন ভালো শিক্ষকের ক্লাসও তেমনি। যিনি প্রচুর ম্যাটার্স প্রদান করেন ক্লাসে, বহুজীবনের বই পাঠেও তা সম্ভব হয় না। এসব দেখার আনন্দ ও জানার পদ্ধতি খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু বিপরীতে এখন সারাক্ষণ আমরা যা দেখছি তা কতটা ওই ‘দেখা’র মধ্যে পড়ে? হ্যাঁ, প্রজন্মে প্রজন্মে পার্থক্য আছে। সময়ের ধারা পুরনোরা গ্রহণ করতে চায় না, নতুনরা করে। কিন্তু আধুনিক-মনস্ক যে কোনো বুদ্ধিশীল মানুষের কাছে সবটাই গ্রহণীয়। সে তা গ্রহণ করতে বাধ্য। আর যদি না করেন তবে তিনি কূপমণ্ডূক। সেটিও জ্ঞানের দীনতা। ফলে এখনকার বিনাশী ব্যবস্থার বিপক্ষে এবং অবিনাশী ব্যবস্থার পক্ষে আমাদের কথা বলতে হবে। যেটা ব্যাপকমাত্রায় চোখে পড়ছে, তা দুর্বহ। আমাদের ভবিষ্যৎকে দুষ্টগ্রহের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে যেন। এ থেকে বেরুনোর কোনো বিকল্প নেই।

‘দেখা’টা কী? ‘দৃক’ বা দেখা একটি চোখ। সাহিত্যের বিশ্লেষণে এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ অনেক। সে আলোচনার সময় এখানে নেই। কেন আমি দেখি? একটি ছোট্ট উদাহরণ দিই : ‘দুই নম্বর ওয়ার্ডের অশ্বত্থ গাছটির উপরের শাখাটিতে গোধূলির ম্লান আলো চিকচিক করিতেছে। অনেকগুলি পাখি একবার এ ডালে একবার ও ডালে যাইতেছে। এক দণ্ডও বিশ্রাম নাই! কিছুক্ষণের মধ্যেই তো চতুর্দিক অন্ধকারে ঢাকিয়া যাইবে। তাহার পর সারা রাত নিঝুমের পালা,— তাই বোধহয় শেষ মুহূর্তের এই চঞ্চলতা, এত ডানা ঝাপটানি, এত আনন্দ উৎসব— যতটুকু আনন্দ সময়ের নিকট হইতে ছিনাইয়া লওয়া যায়। সত্যই কি পাখিগুলি এই জন্য সন্ধ্যার সময় এত চঞ্চল হয়?’ (জাগরি : সতীনাথ ভাদুড়ী) এই যে দেখা! লেখকের দেখা। আলোর আকাঙ্ক্ষার জন্য কী প্রতীকী এক ব্যঞ্জনা লেখকের চোখে ধরা পড়েছে। এটি কি মোবাইলে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করা স্ক্রিনশট্! প্রকৃতি দেখার মুগ্ধতার দৃশ্যটি ‘পথের পাঁচালী’র অপুর কৌতূহলেই বা কীভাবে আটকায়! সাহিত্য এই এক আনন্দ! তাতে মনন গড়ে ওঠে। প্রকৃতি দেখার দৃষ্টি চনমন হয়। পাঠের আগ্রহ জাগে। জীবন সম্পর্কে নতুন অর্থ যোগ হয়। করপোরেট যুগে এর মূল্য নেই। করপোরেট বা পুঁজির শর্ত তা-ই! সে পেছনে টানবে, জানার ব্যাপারে বাধা দেবে, যন্ত্রদানবের ভেতরে আটকে দেবে, যন্তর-মন্তর থেকে শেখানো বুলির অনুকরণ করবে, শুধু প্রয়োজনটুকু নেবে, নির্ধারিত মাপে নির্ণয় করবে জীবনের দায়, কৃত্রিমতা দিয়ে বাস্তবকে ঢেকে দেবে, অসহায়ত্ব আর নৈরাশ্য দিয়ে জীবনের শুকনো পথগুলো আহ্বান করবে— এই তো কাজ!

ফলে লেখাপড়া থেকে শুরু করে জীবনের সব প্রহর তারা হরণ করে ফেলছে, একটি সম্ভাবনাময় দৃষ্টিশীল প্রজন্মকে অন্ধ, পঙ্গু, ভীরুতা ও অসহায়ত্বের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই চালাকি পুঁজি-বর্ধিষ্ণু সমাজে কেউ বুঝলেও; আত্মপ্রচার, স্বার্থপরতা, ইনডিভিজ্যুয়ালিটির মোহে আচ্ছন্ন ধাপ্পাটুকু বোঝা সহজ হচ্ছে না। আসলে এ থেকে আমাদের কারোরই (সমাজের বড় একটা চালিকাশক্তির) নানা কারণে কোনো মুক্তি নেই। একটা পঙ্গু, কূপমণ্ডূক জনশক্তি তৈরি হচ্ছে। সুতরাং একদিকে ভোগের জৌলুস অন্যদিকে পাপমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় (হতাশা থেকে) ধর্মীয় উপাসনালয়ের প্রতি আস্থা— স্ববিরোধিতার এই কোপানলে না আছে ‘ধর্ম’ না আছে ‘মানবতা’। ফলে শিক্ষা-সংস্কৃতি-জ্ঞান-বুদ্ধির সবটাই এই ডিজিটাল প্রজন্মের মুখে এক বড় বাধা। এখন সেবাপরায়ণ ডাক্তারের অভাব, ব্রতশীল শিক্ষকের অভাব, দুর্নীতিমুক্ত ইঞ্জিনিয়ারের অভাব, প্রজাতন্ত্রে দক্ষ আমলার অভাব, রাজনীতিবিদদের অভাব— এই ক্রমবর্ধিষ্ণু গোটা সমাজকে অধিকতর অনিরাপত্তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। ফলে সমাজের বৈষম্যমুক্তি ঘটছে না। তবু এসব মোকাবেলা করে যারা কাজ করছেন, তারা আসলে মানবের ভেতরের অভ্যন্তরীণ শক্তি— চলতি সমাজ বা রাষ্ট্রের সেখানে কোনো জোগান নেই। তবু মানুষ তো আশাবাদী। কারণ, শেষ পর্যন্ত সত্য ও ভালোরই জয় হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads