• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
শ্রেণিকক্ষের বাইরের অভিজ্ঞতাও গুরুত্বপূর্ণ

মাঠের অভিজ্ঞতা ও গবেষণা অনেক ন্যাচারাল সায়েন্স ও সোশ্যাল সায়েন্সের মূল বিষয়

সংগৃহীত ছবি

মতামত

শ্রেণিকক্ষের বাইরের অভিজ্ঞতাও গুরুত্বপূর্ণ

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ১০ অক্টোবর ২০১৮

প্রকৃত শিক্ষালাভের জন্য শিক্ষার্থীদের সবসময়ই পাঠ্যবই, নোটবই, গাইড বই, কোচিং, বইয়ের থলে আর ব্ল্যাকবোর্ডের সঙ্গে লেগে থাকা ঠিক নয়। সত্যিকারের শিক্ষা শুধু ঐতিহাসিক কিছু ডাটা মুখস্থ কিংবা কয়েকটি গণিতের সমাধান করা নয়। গ্রামারের কিছু নিয়ম জানা নয়। শিক্ষা হচ্ছে একধরনের জীবনব্যাপী ইন্টারঅ্যাকটিভ পদ্ধতি যেখানে থাকবে প্রশ্ন করা, আলোচনা করা, ক্রিটিক্যালি কোনো কিছু চিন্তা করা, কোনো প্রচলিত বিষয়ের মধ্যে নতুন অর্থ খুঁজে বের করা এবং প্রতিটি অবস্থায় অর্জিত জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করা।

ধরুন, টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত একটি খেলা দেখছেন। বিষয়টি কেমন? অবশ্যই মজার। ধরুন, আপনি স্টেডিয়ামে বা মাঠে সমর্থক বেষ্টিত হয়ে খেলা দেখছেন। দুটিতে কি একই ধরনের মজা পাবেন? এই বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা কোনোভাবেই টেলিভিশন বা প্রতিবিম্ব বা ইমেজের মাধ্যমে দেখানো সম্ভব নয়। শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। শ্রেণিকক্ষে যে শিক্ষাদান করা হয়, তা অনেক সময়ই বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মিল থাকে না। আমাদের শিক্ষার্থীরা ইটালিয়ান রেনেসাঁ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন বই পড়ে। সেই জানা আর যদি ইটালিয়ান ভাস্কর্য, পেইন্টিং কিংবা অ্যাকুয়ারিয়াম নিজ চোখে দেখেন, তাহলে কি একই ধারণা হবে রেনেসাঁ সম্পর্কে? আমাদের অনেক বিদ্যালয়েই বিজ্ঞান পড়ানোর যন্ত্রপাতি নেই, থাকলেও ব্যবহার করা হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন দিন দিন। শিক্ষার্থীরা প্রথমদিকে যখন ল্যাবটেরিতে কাজ শুরু করেন, তখন খুব উত্তেজিত থাকেন; কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর অনেক এক্সপেরিমেন্টের বাস্তবের সঙ্গে মিল থাকে না বিধায় তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মাইকেল রেইস বলেছেন, ‘ক্লাসরুমের বাইরের কার্যাবলি শ্রেণিকক্ষের চেয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টি করে বেশি।’

শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানোর নিমিত্তে আমরা মাঠ পরিদর্শনের আয়োজন করে থাকি। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসর মার্টিন ব্রন্ড বলেছেন ফিল্ড ট্রিপের কথা। ফিল্ড ট্রিপের মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষা শিক্ষার্থীরা অনেকদিন মনে রাখতে পারেন। তারা সেখান থেকে সরাসরি যে উদাহরণগুলো দিতে পারেন, তা বিদ্যালয় কিংবা শ্রেণিকক্ষভিত্তিক শিক্ষায় সম্ভব নয়। ফিল্ড ট্রিপ শুধু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নয়- এটি ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, ইংরেজিসহ কারিকুলামের অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমার মনে আছে, আমরা যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, শেকসপিয়রের যে নাটকটি যেদিন পড়ানো হবে, শিক্ষকরা তার আগে বলতেন আগামীকাল বা তার পরদিন ব্রিটিশ কাউন্সিলে ‘ম্যাকবেথ’ নাটক মঞ্চস্থ হবে, তোমরা সবাই নাটকটি দেখবে। নাটক দেখে আসতাম এবং পড়ার সময় বার বার কোন চরিত্র কীভাবে আচরণ করত, কী ভূমিকা পালন করত- নাটক পড়ার সময় চোখের সামনে ভেসে উঠত। একদল শিক্ষার্থীকে যখন বায়োলজির জন্য ক্লাসরুমের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়, তারা ওইদিনের জন্য অন্য বিষয়গুলোর ক্লাসও করতে পারেন না। কাজেই অন্য বিষয়গুলোও ফিল্ড ট্রিপের আওতায় আনা দরকার।

শিখন শেখানো প্রকৃতিগতভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে এবং শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হতে পারে, যখন শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমের চার দেয়ালের বন্দিদশা থেকে বাইরের মুক্ত বাতাসে নিয়ে আসা হয়। শিক্ষার্থীরা যখন কোনো বিষয় বাস্তবজীবনে অনুশীলনের সুযোগ পান, তখন শ্রেণিকক্ষের বাইরে ও ভেতরে একীভূত একধরনের সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারেন এবং প্রাসঙ্গিকতা রক্ষা করতে পারেন।

অনেকের কাছে ফিল্ড ট্রিপ মানে দীর্ঘ বাস ভ্রমণ, শুকনো বা ভারী লাঞ্চ, উদ্দেশ্যবিহীনভাবে কিছু বিষয় ঘুরে ঘুরে দেখা। অবশ্য ফিল্ড ট্রিপ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ও বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। তবে বাস্তব শিক্ষার জন্য ফিল্ড ট্রিপ একটু আলাদা, একটু পরিকল্পনামাফিক। এই ভ্রমণ বা ট্রিপ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলাদা একধরনের সম্পর্ক কিংবা বন্ডিং সৃষ্টি করে। উঁচু শ্রেণিতে এই বন্ডিং বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছি, পিকনিক করতে গিয়ে যে প্রেমের শুরু তা বিয়েতে গিয়ে শেষ হয়েছে। বাইরের ভ্রমণ একজন শিক্ষার্থীকে গভীরভাবে অবলোকন করার বা দেখার জন্য শিক্ষকদেরও সুযোগ তৈরি করে দেয়। একজন শিক্ষার্থী বিশ্বকে কীভাবে দেখছে, কোন দৃষ্টিতে দেখছে, কোন অবস্থায় কীভাবে সাড়া দিচ্ছে তা সঠিকভাবে এবং বাস্তবসম্মতভাবে দেখার এটি একটি সুযোগ। একজন শিক্ষকের একজন শিক্ষার্থীকে এভাবে দেখার মধ্যে  তিনি জানতে পারেন কোন বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীর কতটা পরিষ্কার ধারণা আছে যা শ্রেণিকক্ষে সবসময় কিংবা সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয় না।

শ্রেণিকক্ষের বাঁধা-ধরা নিয়ম বা চার দেয়ালের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার পথ হলো শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা, যাতে তারা তাদের চারপাশের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে, প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারে। শিক্ষার্থীরা কমিউনিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে, আলাপ-আলোচনা করে কোনো বিষয় সম্পর্কে সঠিক তথ্য নিতে পারে, সুন্দরভাবে বুঝতে পারে যা তার পাঠ্যবিষয়কে আরো সুন্দরভাবে বোঝার জন্য মশলা হিসেবে কাজ করে। এতে তাদের যে মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে, তা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। শিক্ষাবিদ লরি গার্ডিনার ও ডন কলকুইট অ্যান্ডারসনের মতে, সঠিক জ্ঞান অর্জনের জন্য আমরা কত শতাংশ সময় শ্রেণিকক্ষে ব্যয় করব, আর কত শতাংশ শ্রেণিকক্ষের বাইরে ফিল্ড ট্রিপ, কমিউনিটি সার্ভিস, স্টাডি ট্যুর বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করব, তার নির্দিষ্ট কোনো সূত্র নেই। প্রয়োজন অনুযায়ী এবং শ্রেণিকক্ষের ভেতরের ও বাইরের শিক্ষাদানের সঙ্গে সমন্বয় করে করা যায় অথবা যখনই শ্রেণিকক্ষে একঘেয়েমি আসে তখনই বদলিয়ে কাজ করার মাধ্যমেই সত্যিকারের ও ফলপ্রসূ শিখন পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব।

মাঠের অভিজ্ঞতা ও গবেষণা অনেক ন্যাচারাল সায়েন্স ও সোশ্যাল সায়েন্সের মূল বিষয়। বিজ্ঞানের একটি অংশ হচ্ছে, মানবতা শেখানো যা ফিল্ড ট্রিপের মাধ্যমে শেখা যায়। মানবিক শাখার অনেক অভিজ্ঞতা ফিল্ড ট্রিপের মাধ্যমে অর্জিত হয়। যেমন মৌখিক ইতিহাস সংগ্রহ, ঐতিহাসিক স্থাপনা পরিদর্শন, স্থানভেদে অভিজ্ঞতা ইত্যাদি।

এ ছাড়া ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য শ্রেণিকক্ষের বাইরের অভিজ্ঞতা শিখন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষার্থীদের বাস্তব জ্ঞান আহরণের জন্য শ্রেণিকক্ষের চার দেয়ালের বাইরে যাওয়া একটি আবশ্যকীয় শর্ত। আমরা যদি উঁচুমানের শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার সঙ্গে বাইরের শিক্ষার সমন্বয় করতে হবে। শ্রেণিকক্ষের বাইরে গিয়ে শেখা শিক্ষার্থীদের অনুসন্ধান করার দক্ষতা বৃদ্ধি করে। তা ছাড়া মূল্যায়ন বিশ্লেষণ, কোনো বিষয় পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। শ্রেণিকক্ষের বাইরের অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে এবং ধীরে ধীরে তাদের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে।

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads