• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯

মতামত

পাহাড়ে কি কান্না চলতেই থাকবে

  • অলিউর রহমান ফিরোজ
  • প্রকাশিত ১৭ অক্টোবর ২০১৮

আবার পাহাড় ও দেয়াল ধসে চারজনের করুণ মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে শিশুসহ একই পরিবারের তিনজন। ১৩ অক্টোবর গভীর রাতে চট্টগ্রাম জেলার আকবর শাহ থানার অন্তর্গত ফিরোজ শাহ কলোনির বরিশাল ঘোনায় পাহাড় ধসে তিনজন এবং একজন রিকশাচালকের ওপর দেয়াল পড়ে এ মৃত্যু ঘটে। পাহাড়ের ওপর আমরা অনেক অত্যাচার করছি। পাহাড় কেটে কেটে আমরা তার ভারসাম্য বিনষ্ট করছি। পাহাড়ের প্রাকৃতিক আচ্ছাদন আমরা উপড়ে ফেলছি। নিষ্ঠুরভাবে পাহাড়ের গাছপালা সাবাড় করে ফেলছি। তাই মানুষ যখন প্রকৃতির বিপরীতে চলতে চায় প্রকৃতিও তার বদলা নেয়। পাহাড় এখন ভয়াবহ আক্রোশে ফেটে পড়ছে মানুষের অনলে পুড়ে পুড়ে। মানুষের অপরিণামদর্শিতার কারণে পাহাড়ের কান্না কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। একই ঘটনা বার বার ঘটলেও এ ঘটনা থেকে মানুষ শিক্ষা না নেওয়ায় পাহাড় ধসে মৃত্যু রোধ সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিবছরই পাহাড়ে চাপা পড়ে মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছে। যারা নিয়তির দায় মেনেও বসবাস করছেন তাদের হয়তো বিকল্প কোনো অবলম্বন নেই বলেই তারা ঝুঁকি নিয়েও বসবাস করছেন। কিন্তু এভাবেই কি অসহায় এবং দরিদ্র মানুষগুলো মর্মান্তিক মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবে? আমাদের সামনে এখন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ধেয়ে আসছে। আগের চেয়ে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত আমাদের ঘিরে ধরবে। সেই সঙ্গে বেড়ে যাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও। তাই পাহাড় ধস কীভাবে রোধ করা যায় তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। পাহাড় ধসের কারণগুলো আগে খুঁজে বের করতে হবে।

গত দুই দশকে সাড়ে ৬শ’ মানুষের নির্মম মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ করার মতো ছিল ১৯৯৭ সালে ৭ জন, ১৯৯৯ সালে তিনজন, ২০০৫ সালে ১০ জন আদিবাসী, ২০০৭ সালে ১২৭ জন, ২০০৮ সালে ১৩ জন, ২০০৯ এবং ২০১০ সালে তিনজন, ২০১১ সালে ১৩ জন, ২০১২ সালে ২৯ জন, ২০১৫ সালে ১৯ জন এবং ২০১৭ সালে মারা গেছে ১৫০ জনেরও বেশি। হতাহতের চিত্রে দেখা যায় প্রতিবছর পাহাড় ধসের মৃত্যু, যা একটি হতাশাজনক খবরই বটে।

পাহাড় ধসের প্রধান কারণ হলো মাটির উপরের ভাগের আস্তরণ বিনষ্ট হওয়া। যদি মাটির উপরের আস্তর নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে অধিক বৃষ্টিপাত এবং ভূমিকম্পে তা ধসে পড়ে। আর পাহাড়ের আস্তরণ আমরা দিন দিন ক্ষতিসাধন করেই চলেছি। পাহাড় থেকে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে সর্বাগ্রে। গাছ পাহাড়ের মাটিকে সুরক্ষা দেয়। পাহাড়ের গাছ কেটে সাবাড় করার দরুন পাহাড়ের ওপর ভারী বর্ষণ হলে তা সহজেই পাহাড়ের মাটিকে গলিয়ে দেয়। তা একসময় আস্তে আস্তে নিচের দিকে ধসে আসে। অন্যদিকে পাহাড়ের পাদদেশে যদি নির্বিচারে মাটি কাটা হয়, তাহলে উপরি ভাগের মাটি আলগা হতে থাকে। তাতে করে উপরের সামান্য মাটি নিচে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়াবহভাবে ধসের সৃষ্টি করে। একটি দেশের প্রাকৃতি সৌন্দর্যের লীলাভূমি কতিপয় অসাধু ব্যক্তি এভাবে কেটে বিলীন করবে আর প্রশাসন তা চেয়ে চেয়ে দেখবে তা কল্পনার অতীত। পাহাড়ের মৃত্যুর আরেকটি কারণ হলো— লোভী মানুষের দখলে পাহাড় চলে যাওয়া। তারা পাহাড়ের পাদদেশে বাড়িঘর তৈরি করে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভাড়া দিয়ে পয়সা রোজগার করছে। আর সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব মানুষ সস্তায় জীবনধারণ করার আশায় জীবন্ত কবরের মধ্যে প্রতিনিয়ত পতিত হচ্ছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে থাকে। ভেনিজুয়েলা ১৯৯৯ সালে পাহাড় ধসে ১০ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১১ সালে ব্রাজিলে পাহাড় ধসে ছয় শতাধিক লোকের প্রাণ যায়। তা ছাড়া পাহাড় ধসের তালিকায় রয়েছে কানাডা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, তাজিকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত, নেপাল এবং বাংলাদেশই সবসময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে। পাহাড় থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে অনেক সময় পাহাড়ের স্বাভাবিকতা নষ্ট করে ফেলা হয়। তাতে পাহাড়ের মাটির টেম্পার নষ্ট হয়। বিশেষ করে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলেই বড় ধরনের পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হয়। সেখানে কোনো কোনো সময় আমাদের দেশে ৪০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এতেই বোঝা যায়, পাহাড়ে আমাদের বসবাস করায় কতটা ভয়ানক ঝুঁকি থাকে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ বদলে যাচ্ছে। এতে বৃষ্টিপাতের শঙ্কা অনেক বেশি থাকে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক কারণে এখন অসময়েও বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সে জন্য পাহাড়ের মাটির স্লোপ ঠিক রাখা অনেক জরুরি। আর পাদদেশে দেয়াল তৈরির বিষয়টি সামনে এলেও তা যথাযথভাবে করা হয় না। পাহাড় নিয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়নে রয়েছে চরম গাফিলতি। বিশেষ করে আমাদের এখানে তিতলির প্রভাবে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা যায়নি। তাই একই পরিবারের তিনজনকে মাটিচাপা পড়ে মরতে হলো। এখনো পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করছে। বিশেষ করে বলতে হয় বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এবং রাঙামাটির কথা।

এরই মধ্যে পাহাড়ে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় বসবাস শুরু করার পর থেকেই সব গাছপালা তারা সাবাড় করে ফেলেছে। তাতে করে বড় ধরনের যদি কোনো বৃষ্টিপাত শুরু হয়, তাতে পাহাড়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখনই পাহাড়গুলোকে বৃক্ষ দিয়ে আচ্ছাদিত করে ফেলতে হবে। যে গাছ বেশি শিকড় প্রোথিত করতে পারবে সেই গাছই পাহাড়বান্ধব বলে বিবেচিত হবে। মনে রাখতে হবে, পাহাড় বসবাসের জন্য নয়। পাহাড়

হলো পৃথিবীর খিলানস্বরূপ। পাহাড় পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে।

২০০৭ সালে পাহাড়ে মহাবিপর্যয়ের পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে ২৮টি কারণ এবং ৩৬ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছিল। তার বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই। সেটি কার্যকর করা হলে পাহাড় ধসের পরিমাণ অনেক কমে যাবে বলেই বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। পাহাড় ধসের ২৮টি কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ভারী বর্ষণ, পাহাড়ের বালুর আধিক্য, পাহাড়ের উপরি ভাগে গাছ না থাকা, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রাখা। অপরদিকে ৩৬টি সুপারিশ বাস্তবায়নের মধ্যে ছিল— পাহাড়ে জরুরি ভিত্তিতে বনায়ন করা, গাইড ওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন ও শক্ত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, পাহাড়ের পানি ও বালু অপসারণের ব্যবস্থা, বসতি স্থাপনগুলো টেকসই করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালু উত্তোলন বন্ধ করা, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাঁটা নিষিদ্ধ করা, পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প করতে না দেওয়া, মতিঝর্ণা এবং বাটালি হিলের পাদদেশে বসতি স্থাপন উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা এবং পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু সাম্প্রতিক পাহাড়ধস এই বিষয়গুলোকে আমাদের সামনে এনে দিয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কী বলবে?

 

লেখক : সাংবাদিক

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads