• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯
প্রসঙ্গ : সেন্টমার্টিনের মালিকানা দাবি

সেন্টমার্টিন

সংগৃহীত ছবি

মতামত

প্রসঙ্গ : সেন্টমার্টিনের মালিকানা দাবি

  • প্রকাশিত ২৩ অক্টোবর ২০১৮

মাইন উদ্দিন

বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণাংশের জেলা কক্সবাজার। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপ। এই দ্বীপটির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগের জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে দেশ-বিদেশ থেকে। এটি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এতে কখনো কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি এক অভূতপূর্ব ঘটনার জন্ম দিয়েছে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার। যদিও মিয়ানমার আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ, তবু দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কখনো তেমন ঘনিষ্ঠ হয়নি নানা কারণে। কিছুদিন আগে মিয়ানমারের সরকারি ওয়েবসাইটে দেশটির মানচিত্রে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়, যে বিষয়টি বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। আমাদের দেশের সর্বমহলে বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের কাছে প্রতিবাদ জানানো হয়। রাষ্ট্রদূত এটি ভুলবশত হয়ে থাকতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এর কয়েকদিন পর বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে খবর আসে মিয়ানমার তাদের দাবি থেকে সরে এসেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এ সংবেদনশীল বিষয়টি আসলেই কি ভুল, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য রয়েছে? কোরাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন বা এর সংলগ্ন ছেঁড়া দ্বীপের মালিকানা নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে কোনো অনিষ্পন্ন বিরোধ নেই। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ ছিল, সেটি আন্তর্জাতিক আদালতে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই। আদালতের রায়ে দুই দেশের সমুদ্রসীমা স্পষ্ট করে টানা হয়েছে। এরপরও এ দ্বীপ নিয়ে নেইপিডো এমনটা করল কেন? এই উসকানিমূলক কাজের পেছনে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে- এই সন্দেহটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্তত মিয়ানমারের মতো দেশকে বিশ্বাস করার মানেই হয় না। কারণ তাদের কথা ও কাজের কোনো মিল নেই, এটা রোহিঙ্গা বা তারও আগের কিছু ঘটনা থেকে আমাদের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে।

মিয়ানমার সে দেশের ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা অধিবাসীকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। আশির দশকে নিজস্ব নাগরিকত্ব আইন বানিয়ে তাদের অনাগরিক ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বশেষ রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যা বা জাতিগত নিপীড়ন নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও অং সান সু চি’র সরকার তীব্র চাপের মুখে রয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সেন্টমার্টিনের মতো বিরোধহীন একটি ইস্যুকে চাঙ্গা করে রোহিঙ্গা নিপীড়ন বা জাতিগত নির্মূলের দায় থেকে কি রেহাই পাওয়া যাবে?

বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের ভূখণ্ড টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটারের মতো দক্ষিণে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপটি স্থানীয়দের কাছে নারিকেল জিঞ্জিরা বা দারুচিনি দ্বীপ হিসেবে পরিচিত। ২৫০ বছর আগে আরব নাবিকরা প্রথম এ দ্বীপে বসবাস করেন। তারা এর নাম দেন ‘জাজিরা’। ব্রিটিশ শাসনের সময় এর নাম দেওয়া হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শেখ বখতিয়ার উদ্দিন এবং অধ্যাপক মোস্তফা কামাল পাশা সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে গবেষণা করেছেন। অধ্যাপক বখতিয়ার বলেন, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল জায়গাটি। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি সমুদ্রের নিচে চলে যায়। এরপর প্রায় ৪৫০ বছর আগে বর্তমান সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া জেগে ওঠে। এর ১০০ বছর পর উত্তর পাড়া এবং পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে বাকি অংশ জেগে ওঠে।

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০০ সালে ভূমি জরিপের সময় এ দ্বীপটিকে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। সে সময়টিতে বার্মা ব্রিটিশ শাসনের আওতায় ছিল। কিন্তু তারপরও সেন্টমার্টিন দ্বীপকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত না করে ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর আগে ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে বর্মি রাজার যে যুদ্ধ হয়, তাতে বিতর্কের ইস্যুগুলোর মধ্যে এ দ্বীপের মালিকানাও একটি ছিল। সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন আট বর্গকিলোমিটারের মতো। এর সঙ্গে সংলগ্ন ছেঁড়া দ্বীপটি মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে। ভাটির সময় দুটি দ্বীপ এক হলেও জোয়ারের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

মিয়ানমার মূলত সামরিক শাসকদের দ্বারা শাসিত একটি দেশ। এরা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। যে কারণে মিয়ানমার বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে একঘরে অবস্থায় আছে। আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবরোধ জারি করলেও আন্তর্জাতিক মহলকে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে বহুদিন ধরে। এর মূল কারণ হলো, এই দেশটির ওপর সবসময় চীনের একটা বিরাট প্রভাব ছায়ার মতো বলয় সৃষ্টি করে রেখেছে। সামরিক জান্তাকে চীন গোপনে সবর্দাই সমর্থন দিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে চীনের সমর্থনের বিষয়টি এর জলজ্যান্ত প্রমাণ। মূলত চীনের প্রভাবের কারণেই মিয়ানমার সবসময় আন্তর্জাতিক মহলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে। চীনের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার যোগসূত্রতা, যেখানে চীন ও রাশিয়ার শক্তির কাছে অবশিষ্ট দুনিয়ার শক্তির টনক নড়ে। সেখানে এই দুই দেশের উসকানিতে মিয়ানমার কী না করতে পারে? পক্ষান্তরে এই রোহিঙ্গা ইস্যুতেই প্রমাণিত হয়েছে আমরা কতটা অসহায়। আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের অভাব কতটা প্রকট। এমন অবস্থায় মিয়ানমারের সেন্টমার্টিনের মালিকানা দাবি ভুল নয়, একটা গভীর ষড়যন্ত্রের পূর্বাভাস হিসেবেই আমাদের নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজাতে হবে। নতুবা এজন্য পরবর্তী সময়ে বড় মাশুল আমাদের গুনতেও হতে পারে। 

লেখক :  প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

moin412902@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads