• শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪২৯
প্রাথমিক শিক্ষায় মানোন্নয়ন প্রয়োজন

প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ভিন্নমত

প্রাথমিক শিক্ষায় মানোন্নয়ন প্রয়োজন

  • প্রকাশিত ২৪ অক্টোবর ২০১৮

অলোক আচার্য

সরকারের দিক থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার চেষ্টার ঘাটতি নেই। সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও প্রাথমিক শিক্ষা কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। সম্প্রতি দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মানসম্মত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ প্রকল্পের আওতায় প্রথমে ঢাকা শহরের ৩৪২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে এবং পর্যায়ক্রমে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুনভাবে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সন্তান ভর্তি করাতে আগ্রহ নেই অধিকাংশ অভিভাবকের। উচ্চবিত্তদের আগ্রহ এক্ষেত্রে একেবারেই কম। লেখাপড়ার মান আর অবকাঠামো এসব অনাগ্রহের মূল কারণ। এই প্রকল্পের আওতায় বিদ্যালয়গুলোতে নতুন ভবন নির্মাণ, ভবন সংস্কার, প্রাচীর তৈরি, অবকাঠামো উন্নয়নসহ ভেতর-বাইরে চাকচিক্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জরিপে ৩৭ শতাংশের বেশি স্কুল ভবন ব্যবহারের অনুপযুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেহাল দশা; অন্যদিকে দেশের অলিতে গলিতে, বিল্ডিংয়ের কোনায় ব্যাঙের ছাতার মতো কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠছে। এসব কিন্ডারগার্টেন নিয়ন্ত্রণে কোনো নজরদারি নেই। যেখানে যেমন ইচ্ছা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি বহু আইন এসব কিন্ডারগার্টেনে উপেক্ষিত। উপেক্ষিত হওয়ার কারণ নজরদারির অভাব। বছরের শুরুতেই নানা সুযোগ-সুবিধার কথা বলে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে দেখা যায় এসব প্রতিষ্ঠানকে। কিন্ডারগার্টেনগুলোর মধ্যে চলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কোন প্রতিষ্ঠান বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে। অথচ অনেক কিন্ডারগার্টেনের না আছে অনুমোদন, না আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মতো পর্যাপ্ত অবকাঠামো। আবার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। কিন্তু ফলাফলে কিন্ডারগার্টেনগুলোই এগিয়ে থাকে।

সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ডিজিটাল করার লক্ষ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর পৌঁছে দিচ্ছে। তা ছাড়া সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালুর পরিকল্পনা করছে। ইতোমধ্যে অনেক এলাকায় তা বাস্তবায়িত হয়েছে। আর শিক্ষকের কথা বললে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন যারা নিয়োগ পাচ্ছে, তারা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত। বিনা বেতনে লেখাপড়া করার সুযোগ ছাড়াও বৃত্তি দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণসহ আরো সুযোগ-সুবিধা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে।

অপরদিকে কিন্ডারগার্টেনগুলোতে লেখাপড়া করা শিশুদের মাসে মোটা টাকা বেতন দিতে হয়, অতিরিক্ত বই কিনতে হয়। কিন্তু তারপরও কিন্ডারগার্টেনের প্রতি যে আস্থা জন্মেছে তা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে হচ্ছে না কেন? প্রথমেই একটা প্রশ্ন আসে তা হলো, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা চাকরি করেন তাদের সন্তানরা সবাই কি সরকারি স্কুলে লেখাপড়া করে? এমনটা দেখা যায় যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানরা প্রায়ই এলাকার নামিদামি কোনো কিন্ডারগার্টেনে লেখাপড়া করে। সবাই নয় তবে এই হারটাই বেশি হবে। তাহলে নিজের সন্তানকে যদি নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে দিতে আস্থা না থাকে, তাহলে অন্য অভিভাবকদের দোষ দিয়ে লাভ কী? অন্যের আস্থা অর্জন করতে হলে প্রথমে শিক্ষকদের নিজেদেরই করে দেখাতে হবে।

এদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি অনেকটা দীর্ঘ বলে মনে হয়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি। অপরদিকে কিন্ডারগার্টেনের সময়সূচি সকালে। দুপুর বারোটার আগেই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি ফেরে। এসব ছাত্রছাত্রী যখন খেলাধুলা করে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তখন স্কুল শুরু করে। সময়ের বিষয়ে দেশের শিক্ষাবিদরা গবেষণা করতে পারেন।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সহকারী শিক্ষক হিসেবে যখন কোনো স্কুলে যোগদান করেন, তখন তাদের ভেতর ও পদোন্নতির ইচ্ছা জাগে। কারণ অন্য সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ যতটা রয়েছে, এখানে ততটা নেই। সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকে উন্নীত হলেও সেই প্রক্রিয়াও খুব দীর্ঘ।

দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলগুলোতে স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিস্কুট দেওয়া হয়। এখন সরকার মিড ডে মিল দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। দেশের অনেক স্থানেই মিড ডে মিল চালু হয়েছে। এই বিস্কুট দেওয়া বা মিড ডে মিল চালু করার উদ্দেশ্য হলো ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করা। সেই দিনটি সত্যি অনেক আনন্দের হবে, যেদিন দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মিড ডে মিলের সুযোগ পাবে।

প্রতিবেদনটিতে আরো দেখা গেছে, ২০১৩ সালের আগের সরকারি প্রাথমিকের পাকা স্কুলগুলোর অবকাঠামো মাত্র ৪৭ শতাংশ ভালো পর্যায়ে রয়েছে। মাঝামাঝি পর্যায়ে ২৩ শতাংশ আর খারাপ পর্যায়ে ৬ শতাংশ।

দেশের অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক একেবারেই কম আবার কোথাও শিক্ষার্থী কম হলেও শিক্ষক অনেক বেশি। এতে করে এক স্কুলের লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে এবং অপর স্কুলের শিক্ষকের মেধার ব্যবহার হচ্ছে না। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী যদি স্কুলগুলোতে শিক্ষক দেওয়া যেত, তাহলে এই সমস্যা অনেকটাই কমে আসত। অনেক স্কুলেই কেবল কাগজে-কলমে শিক্ষার্থী বেশি দেখানো হয়। বাস্তবিক পক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা থাকে কম। বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের পদক্ষেপে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ করা হয়েছে। আর পে-স্কেল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের বেতনও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শিক্ষকদের আন্তরিকতাও আরো একটু বৃদ্ধি করতে হবে। মূলত সবকিছু থাকা সত্ত্বেও আন্তরিকতার ঘাটতি আজো রয়েই গেছে। আগে যে শিক্ষকদের শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য কাজ করতে হয়েছে সংসার চালানোর চিন্তায়, এখন তো আর তা করতে হচ্ছে না। অন্তত আগের সেই চাপ আর নেই। তাই শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে একটু মনোযোগী হওয়া যায়। তবে আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে শিক্ষক সঙ্কট। বিভিন্ন সময় পত্রিকার পাতায় এই শিক্ষক সঙ্কটের খবর দেখতে পাই। সহকারী শিক্ষকের পাশাপাশি রয়েছে প্রধান শিক্ষকের সঙ্কট। নানা জটিলতায় এই সঙ্কট পূরণ করা যাচ্ছে না। পুল ও প্যানেল থেকে অনেক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষকের সঙ্কট কিছুটা কাটলেও তা রয়েই গেছে।

লেখক :  সাংবাদিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads