• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

মতামত

নেতা জনতা ও রাজনীতি

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ২৪ নভেম্বর ২০১৮

প্রথমেই বলে নিচ্ছি এ নিবন্ধের শিরোনামটি ধার করে নেওয়া। প্রখ্যাত চিন্তাবিদ-গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি বই আছে ওই নামে। ওই বইয়ে তিনি আমাদের দেশের রাজনীতি এবং তাতে রাজনৈতিক নেতা ও জনতার ভূমিকা অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন নেতাদের বৈশিষ্ট্যের। ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিষয়ের গভীর থেকে তুলে আনা নির্যাস সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেন পাঠকের সামনে।

আলোচ্য বইটিতে তিনি আমাদের দেশের রাজনীতি ও  রাজনীতির কয়েকজন পুরোধা ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাদের মধ্যে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান অন্যতম। শেরে বাংলা ও মওলানা ভাসানীর তুলনামূলক আলোচনা করেছেন এভাবে, ‘নেতা হিসাবে এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে মওলানা ভাসানীর অনেক ব্যাপারে নৈকট্য ছিল। তাঁরা উভয়েই ছিলেন হূদয়বান এবং অগোছালো। ১৯৫৪’র নির্বাচনে লীগ-বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিলেন তাঁরা। অসামান্য জনপ্রিয়তা ছিল তাঁদের। তাঁদের কালে নেতাদের একটা বিশেষ গুণ দরকার হতো। বাগ্মিতা, সেও ছিল উভয়ের। সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনায়াসে মিশে যেতে পারতেন তাঁরা উভয়েই। তবু তাঁরা পৃথক ছিলেন একে অপর থেকে। হক সাহেব যে অর্থে রাজনীতিক, মওলানা সে অর্থে নন। রাজনীতির দুই ধারার প্রতিনিধি ছিলেন এঁরা, যে দুই ধারা পরবর্তীকালে আরো বিকশিত হয়েছে এবং পৃথক হয়েছে পরস্পর থেকে। হক সাহেব রাজনীতি করতেন নির্বাচনের, আর মওলানা করতেন আন্দোলনের। নির্বাচনে মওলানাও অংশ নিয়েছেন অবশ্যই; কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, জনতার দাবিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই। সারা জীবনই তিনি বিরোধী দলের’ (পৃষ্ঠা : ১২-১৩)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব এসেছিলেন মুসলিম লীগ থেকেই। তিনি অগোছালো ছিলেন না। সুস্পষ্টরূপে মানুষ ছিলেন সংগঠনের। তাঁর ছিল বিশাল এক কর্মীবাহিনী, আর ছিল কর্মীদের আকর্ষণ করার এক অসাধারণ ক্ষমতা।... শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীকে অনুসরণ করতেন, কিন্তু সোহরাওয়ার্দীকে তিনি অনেক পেছনে রেখে এলেন বাঙালী জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে’ (পৃষ্ঠা : ১৩-১৪)। আর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান এসেছিলেন একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে। তাঁর সঙ্গে শেখ মুজিবের ব্যবধান যোজন যোজন । তিনি রাজনীতিতে ছিলেন না কখনো। ছিলেন সেনাবাহিনীতে। শেখের মৃত্যুর পরে এবং অনেকটা মৃত্যুর কারণেই রাজনীতিতে তাঁর আত্মপ্রকাশ। শেখ মুজিব অভিযুক্ত হয়েছিলেন রুশ-ভারতের সমর্থক বলে, জিয়া পরিচিত হলেন রুশ-ভারত-বিরোধী হিসাবে। সে হিসাবে তিনি উষ্ণ সমর্থন পেয়ে গেলেন সকল প্রকার দক্ষিণের এবং উগ্র বামের’ (পৃষ্ঠা : ১৪)। এরপর অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ‘হক-ভাসানী-মুজিবের পরে নেতার ভূমিকা কমে এসেছে রাজনীতিতে। এটাই স্বাভাবিক। এর পরেও নেতা থাকবেন, কিন্তু তিনি আসবেন সংগঠনের ভেতর থেকে, সংগঠনের হয়ে। সমাজ বিকাশের ধারা নেতার সঙ্গে জনতার এই পরিবর্তিত সম্পর্কের দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে’ (পৃষ্ঠা-৯৫)।

ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অভিমতের সঙ্গে সবাই একমত হবেন তা নয়। ভিন্ন মত থাকতেই পারে। কেননা, এটা যার যার দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। একটি বিষয়কে একেকজন একেকভাবে দেখেন এবং বিশ্লেষণ করেন। তবে এটা ঠিক, যে চারজন রাজনীতিকের কথা তিনি লিখেছেন, তারা তাদের নিজ কর্মগুণে স্ব-স্ব দলের বাইরে একটি আলাদা ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। দলীয় নেতার বাইরেও তারা পরিচিতি পেয়েছিলেন এবং সমাদৃত হয়েছিলেন গণমানুষের নেতা হিসেবে। এটি তারা অর্জন করেছিলেন। এ কে ফজলুল হক পেয়েছিলেন ‘শেরে বাংলা উপাধি’, মওলানা ভাসানী ‘মজলুম জননেতা’ আর শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধুু’। এ উপাধিগুলো তাদের এমনি এমনি দেওয়া হয়নি। দেশ, জাতি ও নিপীড়িত মানুষের জন্য তাদের মমত্ববোধ, ত্যাগ এবং তাদের কল্যাণে আত্মনিবেদিত হওয়ার পুরস্কার হিসেবেই তারা এসব উপাধি পেয়েছেন। তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য ছিল, মত ও পথের ভিন্নতা ছিল, ফারাক ছিল চিন্তা-চেতনায়ও। তবে একটি জায়গায় তারা মিলে গিয়েছিলেন, যেমন মিলে যায় বিভিন্ন উৎস থেকে বয়ে আসা নদীর ধারা সাগরের মোহনায়। আর সেটি হলো দেশাত্মবোধ।

আজ সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন নেতার কোনো অভাব নেই। পথে-ঘাটে চলতে গেলে ‘নেতা’র শরীরের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। কিন্তু যে নেতা এদেশের মানুষ অতীতে পেয়েছিল এবং এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছে, সে নেতার দেখা কি এখন পাওয়া যায়, নাকি নিকট ভবিষ্যতে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে? এ এক কঠিন প্রশ্ন। অনেকেই বলেন, বাংলাদেশে অনেক কিছুর অভাব থাকলেও বর্তমানে নেতার কোনো অভাব নেই। এই একটি ক্ষেত্রে আমাদের প্রবৃদ্ধি যে বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। বিষয়টি অধিকতর প্রতিভাত হয়ে উঠেছে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন আবেদন ফরম বিক্রির রমরমা বাজার দেখে। মাত্র তিনশ’ সংসদীয় আসনের বিপরীতে প্রধান দুটি দলের আবেদন ফরম বিক্রি হয়েছে সাড়ে আট হাজারের ওপরে। আওয়ামী লীগের ৪ হাজার ২৩টি আর বিএনপির বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৪ হাজারেরও বেশি। অন্যান্য দল মিলিয়ে সর্বমোট ১২ হাজারেরও বেশি। এটা একটা অভাবনীয় ব্যাপার! আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ১২ হাজার নেতা আছেন, যারা মনে করেন তারা এমপি হওয়ার যোগ্য। এটা জানার পর আমাদের কিন্তু আনন্দিত হওয়ার কথা। বগল বাজিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করলেও অশোভন হবে না। নেতা উৎপাদনে আমরা শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নই, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা যেতে পারে! অবশ্য রফতানি না হলেও ইতোপূর্বে জনশক্তি হিসেবে রফতানি হওয়া বেশকিছু নেতাকে এবার দেশে এসে বিভিন্ন দলের মনোনয়ন ফরম কিনতে দেখা গেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন ফরম বিক্রি নিয়ে এবার যেসব কাণ্ড ঘটেছে, আগে কখনো তেমনটি ঘটেনি। দেশের আইনপ্রণেতা হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়েছেন যারা, তারা আইন সম্পর্কে কতটা জ্ঞান রাখেন সে প্রশ্ন তো অবশ্যই আছে। তাছাড়া একটি রাজনৈতিক দলের কোন লেভেলের নেতারা সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করতে পারেন, তারও যেন কোনো পরিধি নেই। এটা ঠিক, মনোনয়ন আবেদন ফরম বিক্রি থেকে দলগুলো মোটা অঙ্কের একটি ফান্ড জোগাড় করতে পেরেছে। বোধকরি দলগুলো সেজন্যই কোয়ালিটির দিকে না তাকিয়ে কোয়ান্টিটির দিকেই নজর দিয়েছে। কিন্তু এর ফলে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও আগ্রহ যে আরেক দফা হ্রাস পেল, সেটা বোধ হয় তাদের উপলব্ধিতে নেই। না হলে জাতীয় সংসদ, যেখানে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন হয়, সেখানকার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় এমন হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি হবে কেন? মনোনয়ন ফরম বিক্রির এ মহাযজ্ঞে আলোড়ন তুলেছে হিরো আলম নামের এক তরুণ, যার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। শোনা যায়, ছোটখাটো অভিনয় আর ফেসবুকে লেখালেখি করে সে পরিচিতি পেয়েছে। বগুড়ার একটি আসন থেকে নির্বাচনে লড়ার ইচ্ছায় সে মনোনয়ন ফরম তুলেছে একটি দল থেকে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, তাকে নিয়ে আমাদের কিছু গণমাধ্যমের মাতামাতি। কয়েকটি টিভি চ্যানেল তো রীতিমতো তার লাইভ সাক্ষাৎকারও প্রচার করেছে। হিরো আলম মনোনয়ন পাক বা না পাক, এমপি হোক বা না হোক, এই যে গুরুত্ব সে পেল তার মূল্য কী কম? মনে পড়ে, ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সয়ফুর রহমান নামে সিলেটের এক লোক প্রার্থী হয়েছিল। সবাই তাকে ছক্কা সয়ফুর বলেই ডাকতো। পরে অবশ্য ১৯৯০ সালে এরশাদের আমলে সে সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিল। কে জানে, এই হিরো আলমের ভাগ্যেও সেরকম শিকে ছিঁড়ে কি-না। বাংলাদেশে তো কত কী ঘটে।

রাজনৈতিক কর্মীদের দোষ দিয়ে লাভ কী? সমাজের অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেও একই প্রবণতা যেন মহামারী আকার ধারণ করেছে। তারা অবশ্য তাদের এ খায়েশের কারণ হিসেবে জনগণের সেবা করার অদম্য ইচ্ছার কথাই বলে থাকেন। তেমনই ইচ্ছা থেকে কুমিল্লা-৭ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাচ্ছেন বিশিষ্ট চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত। একটি পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘একজন রাজনীতিবিদ বা সংসদ সদস্য সব সেক্টরে সেবা দিতে পারেন। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে তিনি তা পারছেন না। তাই সংসদ সদস্য হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দলের মনোনয়ন চেয়েছেন’ (কালের কণ্ঠ, ১৭ নভেম্বর, ২০১৮)। ডা. দত্তের এ যুক্তি কি মেনে নেওয়ার মতো? সবাইকে সব সেক্টরে কেন সেবা দিতে হবে? একজন প্রথিতযশা চিকিৎসক হিসেবে তার তো এদেশের আর্ত-পীড়িত মানুষের সেবা করার বহু সেক্টরই খোলা রয়েছে।

সাধারণ মানুষ এখন আর রাজনীতিকে ভালো চোখে দেখে না। রাজনীতি মানবসেবা নয়, আত্মসেবা হিসেবে তাদের কাছে প্রতীয়মান। এর কারণ অবোধ্য নয়। তারা দেখছে একশ্রেণির মানুষ কীভাবে রাজনীতির সাপলুডু খেলার মতো মই পেয়ে এক ঝটকায় পৌঁছে যাচ্ছে শিখরে। জনগণেরই-বা দোষ কী? তারা চোখের সামনে যা দেখে তার ভিত্তিতেই তো ধারণা করে থাকে।

অথচ নিঃস্বার্থ রাজনীতিকেরও কিন্তু অভাব নেই। এই তো কয়েক মাস আগে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে নির্বাচনে বামফ্রন্ট হেরে গেল। মুখ্যমন্ত্রীর পদ হারেলেন মানিক সরকার। রাজধানী আগরতলায় তার কোনো বাড়ি নেই। শেষ পর্যন্ত সস্ত্রীক তাকে গিয়ে উঠতে হলো পার্টি অফিসে। আর তার সারা জীবনের সঞ্চিত সম্পদ অসংখ্য বই পাঠিয়ে দিতে হলো শ্বশুরবাড়িতে। যারা বলেন আজকালকার যুগে সৎ রাজনীতিবিদ নেই, মানিক সরকার সে কথার জ্বলন্ত প্রতিবাদ। অমন সৎ রাজনীতিক আমাদের দেশেও আছেন। তবে অসৎদের দাপটের কাছে তারা কোণঠাসা।

শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার বইতে যে নেতার চিত্র অঙ্কন করেছেন, সে ধরনের নেতাই দেশবাসী চায়। কিন্তু অসৎ আর আত্মস্বার্থ লোভীদের প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে তারা কি এগিয়ে আসতে পারবেন?

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads