• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

মতামত

‘জামাই-শ্বশুরের যুদ্ধ’ ও রাজনৈতিক বিনোদন

  • সোহরাব শান্ত
  • প্রকাশিত ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮

দেশের সিনেমা হলগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দর্শক আগের মতো হলমুখী নয়। তাই বলে বাঙালির জীবনে বিনোদনের অভাব এমনটা নয়। আমাদের ঘরে-বাইরে নানা রকমের নাটক-সিনেমা মঞ্চস্থ হচ্ছে। বিশেষত রাজনৈতিক অঙ্গনের নানা ঘটনা প্রচলিত নাটক-সিনেমাকেও হার মানাচ্ছে।

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নাটকীয়তার মাত্রা বেড়েছে। নাটকীয়তায় ভরপুর ছিল বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়টিও। এক দশকেরও বেশি সময় আগে বাংলা সিনেমা ‘বউ শাশুড়ির যুদ্ধ’ দেখতে দর্শকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। এখন তাদের বাস্তবে দেখতে হচ্ছে রাজনৈতিক সিনেমা ‘জামাই শ্বশুরের যুদ্ধ’, ‘পিতা পুত্র মুখোমুখি’, ‘তুমি বধূ আমি স্বামী’ ইত্যাদি। এসব

সিনেমাটিক ঘটনা ঘটছে সংসদীয় আসনে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন) আগে একটি রাজনৈতিক দলের ভোটে যাওয়া-না যাওয়া ইস্যুতে ‘স্বামী স্ত্রীর ঠান্ডা যুদ্ধ’ দেখেছে দেশবাসী। জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তার স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ মিলে সে সময় দেশবাসীকে যে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিলেন, তা রাজনীতি-সচেতন পাঠকের মনে থাকার কথা। সেবার এরশাদ বলেছিলেন, ভোটে গেলে লোকে তার মুখে থু থু দেবে। অর্থাৎ ভোট বর্জনের ঘোষণা। কিন্তু এরশাদ ‘অসুস্থ’ হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমএইচে ভর্তির পর তার দল জাতীয় পার্টি নির্বাচনে থেকে যায়। নির্বাচনের পরেও এক সপ্তাহ তিনি সেখানেই ছিলেন এবং নির্বাচনে তার দল থেকে ৩৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অতি উৎসাহী আমজনতা মনে করে এরশাদের এই দ্বিমুখী আচরণে প্রভাব রেখেছিলেন তার স্ত্রী রওশন।

প্রসঙ্গত, ওই নির্বাচনের পর রশওন এরশাদ জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন। এরশাদ হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। জাতীয় পার্টির পাঁচ সংসদ সদস্যকে মন্ত্রী করা হয়। ফলে লোকে তাদের ‘গৃহপালিত’ বিরোধীদল বলতে ছাড়েনি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম অংশীদার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ এবারের নির্বাচনের আগেও ‘অসুস্থ’।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাপার হাইকমান্ডের প্রশ্নবিদ্ধ মনোনয়ন কার্যক্রমে দেশের একটি সংসদীয় আসনে ‘জামাই শ্বশুরের যুদ্ধ’ চলেছে। খবরে প্রকাশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পাওয়া রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন দলটির বর্তমান সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা। সম্পর্কে তারা জামাই-শ্বশুর। মৃধা জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান। আর জামাই রেজাউল দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের যুববিষয়ক উপদেষ্টা। দলটির হাইকমান্ড দুবারের সংসদ সদস্য জিয়াউল হককে বাদ দিয়ে এবার মনোনয়ন দিয়েছে তার মেয়ের স্বামী রেজাউলকে। এ নিয়ে ফুঁসে উঠেছে দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মী; জিয়াউলের অনুসারীরা। তারা রেজাউলের মনোনয়ন বাতিল এবং জিয়াউলের মনোনয়ন নিশ্চিতের দাবিতে ঢাকা-কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও করেছেন। অভিযোগ তুলেছেন, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রেজাউলকে মনোনয়ন দিয়েছে জাতীয় পার্টির হাইকমান্ড। সংসদ সদস্য জিয়াউলের বিক্ষুব্ধ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী মহাসড়কের সরাইলের কুট্টাপাড়া মোড়ে জড়ো হয়ে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করেন। তারা মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে ‘বহিরাগত প্রার্থী ঠেকাও, সরাইল-আশুগঞ্জ বাঁচাও’সহ নানান স্লোগানও দেন।

রেজাউল ইসলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বাসুদেব ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনে নিজের মনোনয়ন চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন দেওয়া হয় শ্বশুরের আসনে। আর শ্বশুর জিয়াউল হক মৃধা সরাইল উপজেলার বাসিন্দা।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, ‘স্নেহভাজন’ জামাতার প্রতি বিরক্ত জিয়াউল হক ঘোষণা দিয়েছেন- তিনি মরলে যেন রেজাউল লাশ দেখতে না আসেন। জামাতাকে নিজের জানাজায় আসতে বারণ সংবলিত অসিয়ত করে যাবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন ক্ষুব্ধ শ্বশুর।

বর্তমান সময়ের জামাই-শ্বশুরের কথা বলতে গিয়ে বাংলার ইতিহাসের আরেক জামাই-শ্বশুরের কথা মনে পড়ল। ওই জুটি ‘মীর জাফর-মীর কাসিমে’র মধ্যে প্রথম জনের নাম বাঙালি গালি হিসেবে ব্যবহার করে।

১৭৫৭ সালে পলাশীর ঐতিহাসিক যুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করার পেছনে ভূমিকা রাখা মীর জাফরের (পুরো নাম মীর মুহাম্মদ জাফর আলী খান বাহাদুর) মেয়ের স্বামী মীর কাসিম (পুরো নাম মীর মুহাম্মদ কাসিম আলী খান) নবাব হিসেবে সিংহাসনে বসেন ১৭৬০ সালে। তিনি মীর জাফরের কন্যা ফাতিমা বেগমকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

নবাব সিরাজের পতনের পর ইংরেজরা তাদের ‘পুতুল নবাব’ হিসেবে গদিতে বসায় মীর জাফরকে। পরে মীর জাফর ও তার পুত্র মিরনের অতিরিক্ত ভোগবিলাস ও ঔদাসীন্যতার কারণে বাংলার পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হতে থাকলে জাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইংরেজরা। তারা কৌশলে হত্যা করে জাফরের পুত্র মিরনকে। এরপর পরিস্থিতি উত্তরণে ক্ষমতায় বসানো হয় জামাতা মীর কাসিমকে। নতুন নবাব মীর কাসিম ছিলেন ‘স্বাধীনচেতা’। তিনি বাংলার উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করার পাশাপাশি ইংরেজদের কাছ থেকে ন্যায্য শুল্ক আদায়ে উদ্যোগী হন। তাই ইংরেজরা তার বিরুদ্ধে লাগে। কাসিমকে বশে আনতে না পেরে ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করে সেই মীর জাফরকেই; যাকে এর আগে তারা ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। ক্ষমতালোভে অন্ধ মীর জাফর নিজ মেয়ের স্বামী মীর কাসিমের ক্ষতি করতে পিছপা হননি। পরে ইংরেজ বাহিনীর মীর কাসিমবিরোধী যুদ্ধগুলোতে সঙ্গে ছিলেন মীর জাফর। শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের সুচতুর কৌশল, শ্বশুরের ষড়যন্ত্র ও নিজ সৈন্যবাহিনীর ভুল সিদ্ধান্তে পরাজিত হন দেশপ্রেমিক মীর কাসিম।

বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামাই-শ্বশুরের ঘটনা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচনের আগে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে দলগুলোর স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ মাত্র। যেখানে তৃণমূলে জনপ্রিয় শ্বশুরকে বঞ্চিত করে ‘টাকাওয়ালা’ জামাইকে মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এমন অভিযোগ জাপার আরো কয়েকজন প্রার্থী করেছেন। এ ধরনের ঘটনা অন্য দলগুলোতে থাকাও অসম্ভব নয়। টাকার খেলা থাকুক বা না থাকুক- এবারের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নকে ঘিরে আরো কিছু ঘটনা জনগণের জন্য আগ্রহের কারণ হয়েছে। 

চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া বাবাকে ভোট না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভিডিও বার্তা ছেড়েছেন ছেলে নিয়াজ মোরশেদ ওরফে এলিট। তিনি একই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে পাননি। তবে তার বাবা মনিরুল ইসলাম ওরফে ইউসুফ একই আসনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়ে পেয়েছেন। পুত্রের এমন ভিডিও বার্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে বটে, মন্তব্যকারীদের বেশিরভাগই পুত্র এলিটের এমন কাণ্ডকে নেতিবাচক হিসেবেই মূল্যায়ন করছেন, যাকে আমরা রাজনৈতিক সিনেমা ‘পিতা-পুত্র মুখোমুখি’ বলতে পারি।

কক্সবাজার-৪ (উখিয়া ও টেকনাফ) আসনে এবার মনোনয়ন পাননি আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। তার বদলে এবার দলটির মনোনয়ন পেয়েছেন বদির প্রথম স্ত্রী শাহীন আকতার চৌধুরী। ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বদিকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। আমজনতা মজা করে তার স্ত্রীকে ডাকছে ‘বৌদি’। এ ঘটনাকে ‘তুমি বধূ আমি স্বামী’ সিনেমা নাম দিলে খারাপ হয় না! রাজনৈতিক অঙ্গনের এমন বিনোদনে আমজনতা সাময়িক আমোদিত হলেও দীর্ঘমেয়াদে বিরক্ত হয়। সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয় আমাদের রাজনীতি ও গণতন্ত্র। বাউল সাধক ক্বারী আমির উদ্দিনের একটি গানের লাইনের মতো করে বলতে হয়- ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট/ প্রজায় কষ্ট পায়’। বর্তমানে রাজা বা রাজ্য নেই। আছে রাজনীতিবিদ ও দেশ। রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে আগে গুরুত্ব দিলে রাজনীতি হাস্যকর হয় না। জনগণও ভালো থাকে।

 

লেখক : গল্পকার, সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads