• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

মি টু : এক কঠোর বাস্তবতা

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮

‘মি টু’ আন্দোলন নিয়ে এখন সর্বত্র কথা হচ্ছে। বাংলাদেশেও লেগেছে ‘মি টু’র ঝাপটা। ‘মি টু’ মানে ‘আমিও’। আমিও শিকার হয়েছি যৌন নিগ্রহের। যৌন নিগ্রহের শিকার এদেশের মেয়েরা প্রতিনিয়ত হয়। কেউ স্বীকার করে, কেউ করে না। পরিবার জানতে পারলে বলে, চেপে যাও, চেপে যাও।  জানাজানি হলে তোমারই বদনাম হবে। তাই মেয়েরা ছেলেবেলা থেকে চেপে যেতেই শেখে। সমাজের দোষারোপ মাথায় নিতে চায় না কেউ। জানাজানি হলে পাঁচ কান হবে, পরিবারের বদনাম হবে, মেয়ের বিয়ে হবে না। আরো কত সমস্যা! তাই চেপে যাওয়াই ভালো।

এভাবেই চলছিল। প্রথম মুখ খুললেন তসলিমা নাসরীন। শুধু মুখ খুললেন না, এদেশের রাঘব-বোয়ালদের চিহ্নিত করে লিখলেন তার ওপর ঘটা যৌন নিগ্রহের কথা। রাতারাতি নষ্ট মেয়ে বনে গেলেন তসলিমা। ছিঃ ছিঃ, নিজের কথা এভাবে কেউ বলে! মানী লোকের মানহানি বলে কথা! তসলিমা দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। কিন্তু তার কলম থামেনি। লিখেই যাচ্ছেন পুরুষতন্ত্রের নানাবিধ কাহিনী।

১৯৯৭ সালে কালো মেয়ে সমাজকর্মী তারানা বার্ক ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীর মুখে তার ওপর যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলেন। তখনই তিনি ঠিক করেছিলেন এ বিষয়ে কিছু করবেন। ২০০৬ সালে যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে তার আন্দোলনের নাম তিনি রাখেন ‘মি টু’ মানে আমিও যৌন হেনস্তার শিকার। আন্দোলনের শুরুতে তিনি শ্বেতাঙ্গ নারীবাদীদের কোনো সমর্থনই পাননি। অভিনেত্রী আলিসা মিলানো যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে গত অক্টোবরে ‘মি টু’ শব্দ দুটি সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশ ট্যাগ হিসেবে ব্যবহার করেন। এরপর ‘মি টু’ ঝড় ওঠে বিশ্বব্যাপী। ইতালির অভিনেত্রী আসিয়া আর্জেন্টো অভিযোগ করেন, ২১ বছর বয়সে যখন কান ফেস্টিভ্যালে যান তখন হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা প্রযোজক হারভে ওয়েনস্টেইন তাকে একটি হোটেলকক্ষে ধর্ষণ করেন। এর পরপরই অভিনেতা ও রক সঙ্গীত তারকা জিনে বেনেট আসিয়া আর্জেন্টোর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই ঘটনা ঘটেছিল ক্যালিফোর্নিয়ার একটি হোটেলে। খবরে প্রকাশ, জিনে বেনেট আসিয়ার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিলে অভিযোগ না করার শর্তে আর্জেন্টো তাকে ৩ লাখ ৮০ হাজার ডলার দিয়েছিলেন। কিন্তু অভিযোগ ঠিকই প্রকাশিত হয়েছে। আর নারীর মতো পুরুষরাও যৌন হেনস্তার শিকার হয় এটাও তার একটা বড় উদাহরণ।

মেয়েরা বাসে বাজারে রাস্তাঘাটে যত্রতত্র যৌন হয়রানির শিকার হন। একশ্রেণির শিকারি পুরুষ যেন ওঁৎ পেতেই থাকে তাদের গায়ের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেওয়ার জন্য। এই বিকৃতিতে তারা কী আনন্দ পান তারাই জানেন, তবে মেয়েরা মরমে মরে যান। অফিসে আদালতে ক্ষেতে খামারে গুদামে ইটভাঁটিতে কোথায় না যৌন হয়রানির শিকার হয়! নিয়োগকর্তারা কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে সুযোগ নেন। খেটে খাওয়া প্রান্তিক নারীরা সহজেই মালিকের লালসার শিকার হন। গৃহকর্মী যৌন হেনস্তার শিকার হন তার গৃহকর্তা বা তার পুত্র কিংবা আত্মীয়-স্বজনের দ্বারা। আর সেটা যখন ধরা পড়ে তখন গৃহিণীরা ওই মেয়েটিকেই দোষারোপ করে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেন। তাই কাজ হারানোর ভয়ে অনেকে মুখও খোলে না। এ ধরনের অভিযোগের শতকরা ৭৫ ভাগই নথিভুক্ত হয় না। মিডিয়া জগতে অভিনেত্রী বা নায়িকা বানানোর প্রলোভন দিয়ে মেয়েদের ডাকা হয়। তারপর আসে সেই প্রস্তাব। যারা রাজি হয় তারা কাজ পায়, যারা হয় না তারা পায় না বা কম পায়। একই ঘটনা ঘটে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও। কোনো নির্দিষ্ট পেশা বললে ভুল হবে। এ নিগ্রহ গার্মেন্টকর্মী থেকে শুরু করে অফিসের এক্সিকিউটিভ পর্যন্ত।

ভারতের একসময়ের নামকরা সংবাদপত্র সম্পাদক বর্তমান মন্ত্রী এম জে আকবরের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি আগ্রাসী আচরণ থেকে শুরু করে যৌন নিপীড়ন পর্যন্ত কোনো অভিযোগই বাদ যায়নি। তিনি অবশ্য বরাবরই জোরালো গলায় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। একজনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন। তারপর আকস্মিকভাবে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। বলিউডের অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন। তিনি নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে মামলাও দিয়েছেন।

বাংলাদেশেও ‘মি টু’র অভিযোগ উঠছে শিল্পপতি, শিক্ষক, সাংবাদিক, আবৃত্তিকার, প্রয়াত নাট্যকারসহ নানা পেশার মানুষের বিরুদ্ধে। মুশফিকা লাইজু অভিযোগ করেছেন  নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের বিরুদ্ধে। রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ফেসবুকে অভিযোগ তোলেন আয়ারল্যান্ডপ্রবাসী মডেল অভিনেত্রী মাকসুদা আকতার প্রিয়তি। অভিযোগ উঠেছে ডিবিসি টেলিভিশনের সাংবাদিক প্রণব সাহার বিরুদ্ধে। অভিযোগকারী তার একসময়ের সহকর্মী সুপ্রীতি ধরের মেয়ে শুচিস্মিতা সীমন্তি। তিনি অভিযোগ করেছেন, তার বয়স ১৬ বছর, তখন প্রণব সাহা তার শরীরে বহুবার আপত্তিকর স্পর্শ করেছেন। সংবাদপাঠক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জামিল আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন সিপিডির পাবলিকেশন্স অ্যাসোসিয়েট আসমাউল হোসনা। ডেইলি স্টারের কূটনৈতিক প্রতিবেদক রেজাউল করিম লোটাসের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী তার একসময়ের সহকর্মী আলফা আরজু। তিনি অভিযোগ করেছেন, একদিন অফিস থেকে লোটাসের গাড়িতে যাওয়ার সময় লোটাস তার গায়ে আপত্তিকরভাবে হাত দেন। এ ব্যাপারে ডেইলি স্টার একটি তদন্ত কমিটি করেছে। পাঠক সমাবেশের পরিচালক শহীদুল ইসলাম বিজুর বিরুদ্ধ যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন ট্রান্সজেন্ডার তাসনুভা আনান শিশির। আবৃত্তি সংগঠন সংবৃতার সপ্তম কর্মশালায় প্রথম স্থান অধিকার করা জাকিয়া তার সাবেক শিক্ষক মাহিদুলের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লিখেছেন, টিএসসিতে একটি কক্ষে অনুশীলনের সময় মাহিদুল তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আরেক সহকর্মীর আকস্মিক উপস্থিতিতে তিনি তা করতে পারেননি।

রফিকুল ইসলাম, প্রণব সাহা, শহীদুল ইসলাম বিজু, মাহিদুল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জামিল সাহেবের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সেলিম আল দীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার পর তার কিছু ভক্ত প্রতিবাদ করেছেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, ৩১ বছর পর কেন? সবকটি অভিযোগই তো অনেক বছর পরে করা। কারণ অনেক বছর পরে বলার সামান্যতম হলেও সুযোগ মেয়েরা পেয়েছে।

ভারতে নন্দিতা দাস ও মল্লিকা দুয়া নারী অধিকার আন্দোলনের লড়াইয়ে বরাবরই সরব। নন্দিতা পরিচালক, অভিনেত্রী আর মল্লিকা দেশের স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানদের একজন, অভিনয়ও করেন সিনেমায়। ভারতের ‘মি টু’ আন্দোলনে তাদের দুজনেরই বাবার নামে অভিযোগ উঠেছে। নন্দিতার বাবা শিল্পী যতীন দাস ‘পদ্মভূষণ’ খেতাবে ভূষিত। তিনি একাধারে চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর। মল্লিকার বাবা ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবপ্রাপ্ত সাংবাদিক বিনোদ দুয়া গত চার দশক ধরে ভারতের হিন্দি সাংবাদিকতা জগতের একজন দিকপাল, বিখ্যাত টিভি অ্যাঙ্কর। নিশা বেরা নামে একজন মহিলা প্রথমে টুইটারে অভিযোগ আনেন কীভাবে চৌদ্দ বছর আগে দিল্লিতে নিজের স্টুডিওতে ডেকে পাঠিয়ে তাকে যৌন হেনস্তা করেছিলেন যতীন দাস। এরপর গারুশা কাটোচ, মালবিকা কুণ্ডু ও তনুশ্রী মজুমদারের মতো আরো অনেক মহিলা জানিয়েছেন কীভাবে যতীন দাস বিভিন্ন সময়ে তাদের যৌন নিগ্রহ করেছেন। এদিকে বিনোদ দুয়ার বিরুদ্ধে চাকরির ইন্টারভিউতে ডেকে ও পরে নিজের গাড়িতে বসিয়ে কীভাবে তাকে যৌন নিগ্রহ করেছিলেন, প্রায় তিরিশ বছর পর সে ঘটনা জানিয়েছেন নিষ্ঠা জৈন নামে এক চিত্রনির্মাতা ও সাংবাদিক। যতীন দাস ও বিনোদ দুয়া জোরেশোরে তাদের প্রতি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

নন্দিতা দাস বলিউডের ১১ জন অভিনেত্রীসহ চুক্তি করেছেন যাদের বিরুদ্ধে ‘মি টু’র অভিযোগ উঠবে, তাদের সঙ্গে কাজ করবেন না। তিনি কিছুটা অস্বস্তিতে। জানিয়েছেন, তিনি এখনো ‘মি টু’র পক্ষে সরব। তবে ‘মি টু’তে যেন কোনো বেনোজল ঢুকে না যায়। আর মল্লিকা দুয়া বলেছেন, যদি তার বাবা এটা করে থাকেন সেটা নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য। তবে তিনি বাবার লড়াইয়ে তার পাশে থাকবেন। মেয়ে বাবার লড়াইয়ে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত পাশে থাকবে, ঠিক আছে। কিন্তু অভিযুক্ত বাবাকে হিরো বানানো ভণ্ডামি— এটাই লিখেছেন কলামনিস্ট স্নেহা বেনগালি।

এদেশে বড় বড় কর্মকর্তা শিল্পপতিদের বিশ্রামের জন্য আলাদা ঘর বিছানা বালিশ থাকে। যেন কাজ করলে ক্লান্তি তাদেরই লাগে। অন্যদের লাগে না। এ ধরনের খাট-পালংয়ের ব্যবস্থা করা, মানুষের সুপ্ত চেতনাকে উসকে দেওয়া। আবার কিছু সুযোগ-সন্ধানী নারীর জন্য সুযোগও সৃষ্টি করে দেওয়া। নারীর বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। যে দেশে বিরাটসংখ্যক মানুষ থাকে ফুটপাতে, বস্তিতে— সেখানে অকারণে বিশালাকার ভবন বানিয়ে তাতে চার-পাঁচটি করে ফ্লোর খালি রেখে ধুলোর চাষাবাদ করে কর্মকর্তাদের মোটা বেতন দিয়ে খাট-পালংয়ে সাজিয়ে এভাবে লালন-পালন করা দরিদ্র দেশের জন্য একান্তই বেমানান। আন্দোলন হয়ে ঝিমিয়ে পড়া, তারপর ঘুমিয়ে যাওয়ার ইতিহাস আমরা বার বার দেখি। ‘মি টু’ আন্দোলনটি যাতে ঘুমিয়ে না পড়ে, দোষীর বিচার হয়- সেটার প্রত্যাশায় দিন গুনছে ভুক্তভোগীরা। সেটি হলে এগিয়ে আসবে আরো আরো ভুক্তভোগী।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক, যুগ্ম সচিব

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads