শীতকাল এলেই অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয় আমাদের দেশ। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই শীতের অতিথি পাখি দেখা যায়। শীতকাল এলে শীতপ্রধান দেশের পাখিরা দেশভ্রমণে বের হয় বেঁচে থাকার জন্য। মূলত আমাদের দেশে আসে সাইবেরিয়া ও হিমালয় অঞ্চলের পাখিরা। শীতকাল এলে ওইসব দেশের ভূভাগ ও জলাশয়গুলো বরফে ঢেকে যাওয়ায় সেখানকার পাখিরা, বিশেষ করে সেসব দেশের হাঁস, বক ইত্যাদি জলচর পাখি প্রয়োজনীয় খাবার পায় না। তখন তাদের বেঁচে থাকার জন্য খাবার প্রয়োজন হয়। শীতপ্রধান দেশের পাখিরা তখন দেশান্তরী হতে শুরু করে। পাড়ি জমায় এমন দেশে যেখানে হাওর-বাঁওড়, নদী-নালার কোনো অভাব নেই, খাবারের সমস্যা নেই। এমন কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম উল্লেখযোগ্য। শীতটা কাটিয়ে আবার ওরা পাড়ি জমায় নিজ দেশে। এরই মধ্যে পাখিপ্রেমিকরা মন ভরে দেখে নেয় তাদের। শীতের মৌসুমে আসা অতিথি পাখিদের মধ্যে রয়েছে বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, চমাহাঁস, জলপিপি, রাজসরালি, লালবুবা, পানকৌড়ি, বক, শামুককনা, চখপখিম সারস, কাইমা, শ্রাইক, গাঙ কবুতর, বনহুর, হরিয়াল, নারুন্দি, মানিকজোড়াসহ নাম-না-জানা আরো অনেক পাখি। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১৫ প্রজাতির হাঁস ছাড়াও গাগিনি, গাও, ওয়েল, পিগটেইল, ডাটাস্মক, থাম, আরাথিল, পেরিক্যান, পাইজ, শ্রেভির, বাটান এসব পাখি এসে থাকে। প্রাণিবিজ্ঞানীদের কথায়, বাংলাদেশের পাখি দুই শ্রেণির। আবাসিক আর অনাবাসিক। অতিথি পাখি অনাবাসিক শ্রেণির।
আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় শীতের এই অতিথি পাখিদের বিচরণ দেখতে পাওয়া যায়। প্রতি বছর শীতের শুরুতেই ওরা আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। নানা রঙ আর আকৃতির অতিথি পাখির কূজনে মুখরিত হয় নদীপাড়, বিল-ঝিল, বন-বাদাড় সব। বাংলাদেশের বেশকিছু জায়গায় আনাগোনা দেখা যায় তাদের। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, মিরপুর চিড়িয়াখানা, মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের পাশের লেক, মহেশখালী দ্বীপ, পঞ্চগড়ের ভিতরগড়, চরভাটা, শিবালয়, হালহাওর, হাকালুকি হাওর, কুয়াকাটা, ঘাটিভাঙ্গা, কলাদিয়া, চরণদ্বীপ, নিঝুমদ্বীপ, চর ওসমান, শাহীবানীচর, সন্দ্বীপ, চরমনতাজ, নেত্রকোনার কলমাকান্দার হাওর, কিশোরগঞ্জ হাওর, সুনামগঞ্জ হাওর, হাতিয়া দ্বীপ, চরপিয়া, ডালচর, জামিরচর, মৌলভীবাজার, টাঙ্গুয়ার হাওর, চর কুকড়িমুকড়ি, গলাচিপা, খেপুপাড়া, জোনাকচর, বুড়িগঙ্গা নদী, হোয়াইকিয়ং, শাহপরীর দ্বীপ, মনপুরা, সোনারচর, চরনিজাম, চরমানিক, চরদিয়াল, আগুনমুখা প্রভৃতি। বহু বছর ধরে শীত মৌসুমে বাংলাদেশে অতিথি পাখি এলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কারণে অতিথি পাখি আসাটা কমে যাচ্ছে। এসব পাখির জীবনযাপন ও পরিবেশ দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। যে পাখিরা শুধু জীবন ও খাদ্যের সন্ধানে আমাদের মতো দেশে আসে; নিজেদের অসচেতনতা ও লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু লোক সেই অতিথি পাখিরই জীবন বিনষ্ট করছে বা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। এমন অমানবিক আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ছাড়া আমরা বাঙালিরা অতিথি পাখি দেখতে গেলেই পাখির খুব কাছে যেতে চাই, ছবি তুলতে চাই। ক্যামেরার ক্লিক বা নীরবতা ভঙ্গ করলে পাখিরা বিরক্তবোধ করে এবং অন্যত্র চলে যায়। এসব কারণে অনেক পাখির আবাসস্থলে পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক লাখ টাকা জরিমানা, এক বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণ। একইভাবে কোনো ব্যক্তি যদি পরিযায়ী পাখির মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করেন, দখলে রাখেন কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করেন বা পরিবহন করেন, সেক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার আইন প্রচলিত রয়েছে।
অতিথি পাখি নিধন এবং বাজারে বিক্রি নিষিদ্ধ জেনেও আইনের ফাঁক গলিয়ে একশ্রেণির পেশাদার এবং শৌখিন শিকারি কাজগুলো করে চলেছে। এক্ষেত্রে প্রচলিত আইনকে প্রয়োগ করতে হবে কার্যকরভাবে। তৎপরতা বাড়াতে হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসনকে। পাশাপাশি হাওর এলাকার মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান দরকার। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও পাখিদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে। পাখি হলো প্রকৃতির কীটনাশক। পাখির সংখ্যা কমে গেলে কীটপতঙ্গের অত্যাচারে অসম্ভব হয়ে পড়বে ফসল ফলানো। সেটিই যদি হয়, তাহলে নির্ভর করতে হবে কীটনাশকের ওপর। কিন্তু এটি তো পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যে দেশে পাখি বেশি, সে দেশে পর্যটকের সংখ্যাও বেশি। কাজেই পাখি ঘাটতি অবশ্যই উদ্বেগের ব্যাপার। আসুন, আমরা অতিথি পাখি শিকার না করে তাদের প্রতি মানবিক আচরণের মাধ্যমে সুন্দর রাখি আমাদের বাসযোগ্য পৃথিবী।
লেখক : প্রাবন্ধিক