• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
মুক্তিযোদ্ধাদের শুদ্ধ তালিকা হোক

মুক্তিযোদ্ধাদের শুদ্ধ তালিকা হোক

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

মুক্তিযোদ্ধাদের শুদ্ধ তালিকা হোক

  • আ. ব. ম. রবিউল ইসলাম
  • প্রকাশিত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে একজন প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধার বেদনার্ত কিছু কষ্ট অনেকের মনে নাড়া দিয়েছিল। সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের যে যাচাই-বাছাই সে সময় চলছিল, তার নিরপেক্ষতা নিয়ে তিনি আক্ষেপ করেছেন। দেশমাতৃকার টানে তিনি সম্মুখ যুদ্ধে ১১ নং সেক্টরে লড়াই করেছেন। পেয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধার উপাধি। তবে সেই ‘বীর’ উপাধি এখন আর তিনি চান না। মৃত্যুর পর দাফনের সময় রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও চান না। সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে অনিয়মের প্রতিবাদ এভাবেই করেছেন তিনি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিয়েছেন।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশমাতৃকার টানে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই মুক্তিযোদ্ধার সনদ বা কোনো খেতাবের মোহে যুদ্ধে অংশ নেননি। যে কৃষক কোনো শহর, সভ্যতা চিনত না, সেই মানুষটি সব স্বজনের বন্ধন ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। কিছু পাওয়ার কথা তিনি ভাবেননি। যারা গান গেয়ে, কবিতা লিখে, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে যারা সে সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন, তাদের মধ্যেও অনেকে নিঃস্বার্থভাবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করেছেন। তাদের সবার চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের স্বাধীনতা। আর আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা, আমাদের গর্বিত জাতীয় সঙ্গীত, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। যারা প্রাণ দিয়েছিল, তাদের শহীদের মর্যাদা দিতেও আমরা অনেক দেরি করেছি। রাজনৈতিক কারণে অনেকে খেতাব পেয়েছেন, আবার রাজনৈতিক কারণেই অনেকে খেতাব পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ভাতা ও সম্মান পেতে প্রায় দুই যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে এই বীরদের।

গত ৪৭ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা ও মানদণ্ড ১০ বার পাল্টেছে। এখনো পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখের বেশি হলেও অনলাইনে ও সরাসরি আরো দেড় লাখ আবেদন জমা পড়েছে। স্থানীয় সাংসদের নেতৃত্বে উপজেলা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ে কমিটি গঠনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করে সোয়া চার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এরপরও তা চূড়ান্ত হয়নি; বরং সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। প্রকৃতপক্ষে সরকার যখন মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে দিয়েছিল, তখনই ভুয়া সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়ে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক হলো, মুক্তিযোদ্ধা না হওয়া সত্ত্বেও ‘লাল মুক্তিবার্তা’য় রহস্যজনকভাবে অনেকের নাম রয়েছে। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর স্ক্যান করে সনদ জাল করেছে। আরো দুঃখজনক যে, কেউ কেউ জেনারেল এম এ জি ওসমানীর খোদাই করা স্বাক্ষর জাল করেছে। জেলা-উপজেলা কমান্ডারের স্বাক্ষর জাল করে বা যাচাই-বাছাই না করে সনদ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। আর জাতীয় জীবনে মুক্তিযোদ্ধাদের গণ্য করা হয় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক ও চরম বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নের কাজ করেছে। প্রতিবারই মুক্তিযোদ্ধার ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা পাওয়া গেছে। এর ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সমাজে যে আলোচনা চলছে, তাতে ত্যাগী, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা দুঃখ পাচ্ছেন। আর মুত্তিযুদ্ধের গৌরবে আঁচড় কাটছে। নানা সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর আমলে মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্ট সংগৃহীত তালিকায় রয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার হিসাব। এটি একসময় জাতীয় তালিকা হিসেবে পরিচিত ছিল। এরপর বিভিন্ন সময়ে দুটি রাজনৈতিক সরকারের আমলে তালিকা প্রণয়ন করা হয় এবং তাতে সংখ্যার তারতম্য ঘটে। রাজা যায় রাজা আসে, আর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি হয় দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এরপরও থাকে দুর্নীতি, ব্যক্তিগত লোভ ও বাসনা, অসচেতনতা ইত্যাদি।

কোনো কোনো মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মনে করেন, সরকার উদার দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বর্তমানে নাতি-নাতনি পর্যন্ত প্রসারিত করায় অনেকেই এই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, অতীতের তুলনায় বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। তাদের ভাতা বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রতিটি উপজেলায় কিছু অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বাড়ি পেয়েছেন। তবে দেশের অনেক স্থানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিস্তম্ভ নেই, বধ্যভূমিগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি, অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর হারিয়ে যাচ্ছে। নানা জটিলতায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় ভাতা থেকে এখনো বঞ্চিত। বেশকিছু স্থানে নির্মিত হলেও দেশের বহু এলাকার সড়কগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করা হয়নি। শুধু রাস্তা নয়, দেশের স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে অনেক স্থাপনা মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করা যেতে পারে। পাঠ্যবইয়ে বেশি বেশি মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি জাতীয় দিবসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি পালনে সঠিক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবনগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করা যেতে পারে।

কেন বার বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা? আর কেনইবা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বিতর্কিত হবে? এই সর্বনাশা প্রবণতা দ্রুত বন্ধ হওয়া উচিত। এতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা মনে করি, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এবং জাতীয় ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় সম্পর্কে কোনো রকম নেতিবাচক প্রচার ও ভাবমূর্তির সঙ্কট তৈরির সুযোগ রাখা উচিত নয়। সরকারের উচিত এ বিষয়ে দূরদর্শী বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং তা সময়ক্ষেপণ না করে এখনই হওয়া উচিত।

জানা গেছে, নানামুখী অনিয়মের অভিযোগ মেনে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে সরকার। দেশের জেলা-উপজেলা থেকে যাচাই-বাছাই কমিটি যেসব তালিকা পাঠিয়েছে, তা অসম্পূর্ণ হওয়ায় গত বছরের ১১ মার্চ আকস্মিক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ মন্ত্রণালয় সোয়া কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল।

দেশে এখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখেরও বেশি। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে অনলাইনে ও সরাসরি আরো দেড় লাখ আবেদন জমা পড়ে। তাদের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে যাচাই-বাছাই করে প্রায় ২৫ হাজার নাম পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় হাজার পাঁচেক ব্যক্তির নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল এবং গত বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আগে নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঘোষণার কথা ছিল।

একটি নির্ভুল ও প্রকৃত তালিকা তৈরির পূর্বশর্ত হলো, সব ধরনের সংকীর্ণ ও কোটারি মনোভাব পরিহার করা। অপ্রিয় হলেও সত্য, জাতিগতভাবে আমরা একটি অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে কঠিন একটা সময় অতিক্রম করছি। সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরি করতে দুর্নীতিমুক্ত থাকা সম্ভব হচ্ছে না এবং এ কারণে তা বন্ধ রাখার ঘটনা জাতীয় লজ্জা ছাড়া কিছুই নয়। বিষয়টি এমনও নয় যে, এই তালিকা অসম্পূর্ণ বা শুদ্ধ না করে যেভাবে আছে, সেভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য ফেলে রাখা হবে। নির্দিষ্ট কোনো দল বা গোষ্ঠীর ওপর দায় না চাপিয়ে আমাদের সম্ভবত একটি আত্মজিজ্ঞাসা দরকার।

এর আগে আমরা বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া স্বর্ণপদকে ভেজাল দেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। এবং এটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি দেশজুড়ে আলোচিত হলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলে দেড় লাখ নতুন দরখাস্ত জমা পড়া একটি অভাবনীয় ঘটনা। ‘একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা’ নামে একটি সংগঠন দাবি করেছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দেড় লাখ হবে। ইতোমধ্যে সোয়া দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। একটি প্রথম শ্রেণির পত্রিকার গত বছরের ১২ মার্চের রিপোর্ট অনুযায়ী, গড়ে প্রতি ছয়টি দরখাস্তের মধ্যে পাঁচটিই অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে সবাই হয়তো জেনেশুনে অসাধু পন্থা অবলম্বন করেননি। জেলা-উপজেলা থেকে আসা দরখাস্তগুলো ভুলে ভরা, এর মুখ্য কারণ তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধার উপযুক্ত সংজ্ঞা হয়তো পরিষ্কার ছিল না।

পরিশেষে বলব, বার বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা গ্রহণ করার প্রবণতা বন্ধ করা দরকার। ৪৭ বছর আগে যার যেমন অবস্থান ছিল, সেটা বিবেচনায় রেখেই দলিল ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কে মুক্তিযোদ্ধা, কে মুক্তিযোদ্ধা নয়, তা নির্ধারণ করতে হবে। তা ছাড়া সর্বোপরি, মুক্তিযোদ্ধারা যখন মুক্তিযুদ্ধে গেছেন, কোনো কিছু পাওয়া যাবে এমন মনোভাব না নিয়েই তারা যুদ্ধ করেছেন। এটাই তাদের মহত্ত্ব। এ জন্য জাতি তাদের চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads