• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯
দুর্নীতির ইঁদুর ইঁদুর খেলা

দুর্নীতির ইঁদুর ইঁদুর খেলা

প্রতীকী ছবি

মতামত

দুর্নীতির ইঁদুর ইঁদুর খেলা

  • মো. মাঈন উদ্দিন
  • প্রকাশিত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

উনি আমার প্রতিবেশী। সম্পর্কে চাচা হন। চাচার প্রতিটি কথাই রহস্যজনক। প্যাঁচ ছাড়া কোনো কথাই সম্ভবত তিনি বলেন না। খুঁতখুঁতে স্বভাবের এই চাচাকে আজ সকালে দেখলাম গালে হাত দিয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন। আমি সকালের বাজার থেকে তার পাশ দিয়েই আসছিলাম। হঠাৎ দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম— চাচা মন খারাপ নাকি? তিনি বিরক্তি নিয়ে বললেন— আচ্ছা ভাতিজা, এ দেশটা কী তাহলে রসাতলেই যাবে! আমি রসিকতা করে বললাম— কী বলেন চাচা, বিজ্ঞানীরা তো ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন— এদেশ রসাতলে নয়; বঙ্গোপসাগরের পানিতে তলিয়ে যাবে। তিনি মাথা চুলকালেন— আরে বেটা, সেটা তো বিজ্ঞানীদের কথা কিন্তু আমার কথা হলো এদেশটা রসাতলে যাবে তা কিছুতেই হতে দেব না। আমি বললাম— চাচা আপনার সমস্যাটা বলেন তো শুনি? তিনি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন— ভাতিজা, কয়েকদিন আগে টিভিতে একটি বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। সেখানে একটি ডায়ালগ ছিল এ রকম— এ অফিসের ডানে কাজ, বামে কাজ, সামনে কাজ, পেছনে কাজ, শুধু কাজ আর কাজ; আর এখানে আমার ডায়ালগ হলো— আমাদের ডানে দুর্নীতি, বামে দুর্নীতি, সামনে দুর্নীতি, পেছনে দুর্নীতি, শুধু দুর্নীতি আর দুর্নীতি, কোনটা রেখে কোনটার কথা বলব ভাতিজা। বাজারে মাছ কিনতে যাও; ওই মাছে ফরমালিন। সরকারি হাসপাতালে যাও, সেখানে ডাক্তার সাহেবরা বলবেন, আমার চেম্বারে যায়েন, সেখানে ভালো চিকিৎসা দেব, অর্থাৎ সেখানেও ভাঁওতাবাজি। একেকজন ডাক্তারকে মনে হয় একেকজন কষাই। ত্রিশ টাকার জায়গায় তিন হাজার টাকার প্রেসক্রিপশন দেয়। সরকারি অফিসে যাও, সেখানে মোটা অঙ্কের উৎকোচ না দিলে কাজই হয় না। খেজুর রস কিনতে যাও; অর্ধেক চিনি পাবে, দুধ কিনতে যাও অর্ধেক পানি।

আমার বিরক্তি উঠে গেল। আমি চাচাকে থামিয়ে বললাম— চাচা, আপনার সমস্যাটি নির্দিষ্ট করে বলেন তো শুনি। চাচা এবার মুচকি হেসে বললেন, শোন তাহলে। আমার ঘরে বাতাড়ির নিদারুণ উপদ্রব। বাতাড়ি বুঝো তো? ইঁদুর, ইঁদুর। এই ধরো ছোট ইঁদুরকে বাতাড়ি বলে। শুধু কি ছোট ইঁদুর! ছোট ইঁদুর; মাঝারি ইঁদুর; বড় ইঁদুর। এই ইঁদুরের জ্বালায় রাতে ঘুম হয় না। সিলিংয়ের ওপর ওরা হা-ডু-ডু খেলে। শুধু কি সিলিংয়ের ওপর। ঘরে শুয়ে থাকলে গায়ের ওপর পিলপিল করে হেঁটে বেড়ায়। ইঁদুরের জ্বালা থেকে মুক্তির জন্য গতকাল বাজার থেকে ইঁদুর মারার বিষ কিনে আনলাম। বিষ বিক্রেতা বলল— জায়গায় খেয়ে জায়গায় ব্রেক। ইঁদুর মারার অব্যর্থ ওষুধ। এই কথাগুলো শুনে ইঁদুর মারার বিষ কিনে ঘরে ছিটিয়ে দিলাম। আর হাসতে লাগলাম, শালার ইঁদুর, এবার খাও মামুর গোলার ধান। ব্যাস, এ পর্যন্তই! আমার সামনে ইঁদুরগুলো সব বিষ খেয়ে খেয়ে সাবাড় করে দিল কিন্তু মাগার একটা ইঁদুরও মরল না। তার মানে কি বুঝেছো ভাতিজা।  আজকাল বিষের মধ্যেও ভেজাল। আমার তো এখন সন্দেহ হচ্ছে মানুষ মারার বিষ খেলেও মানুষ মরবে কি-না। আমি বললাম, ও, তাহলে এই কাহিনী চাচা! চাচা এবার মাথা নিচু করে বললেন, সামান্য বিষের মধ্যেও যদি ভেজাল মেশায়; তাহলে আমাদের নীতি-নৈতিকতার অবস্থান কোথায় বলতে পারো! আমি চাচার কাঁধে হাত দিয়ে বললাম— চাচা, আশা নিয়েই তো মানুষ বেঁচে থাকে।

আশা রাখুন তারুণ্যে। এদেশের শিক্ষিত তরুণরাই এক দিন দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। চাচা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, জি ভাতিজা, আশা তরুণ প্রজন্মকে নিয়েই। স্বপ্ন দেখি, আমার এ ঘর এক দিন ইঁদুরমুক্ত হবে। স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশ এক দিন দুর্নীতিমুক্ত হবে। এদেশের প্রতিটা সেক্টর হবে নিউজিল্যান্ড বা সুইজারল্যান্ডের মতো দুর্নীতিমুক্ত। দুর্নীতি শব্দটি বাংলা ডিকশনারি থেকে মুছে যাবে একেবারে। তিনি একটু থেমে আবার বললেন, কিন্তু বাবা, কষ্ট লাগে তখনি, যখন দেখি দুর্নীতি দমন করে যে প্রতিষ্ঠান, ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্তাব্যক্তিই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়। ক্ষেতের বেড়ায় যদি ক্ষেত খায় তাহলে ছাগলকে দুষ দেব কি করে! আসলে একেই বলে বাতির নিচে অন্ধকার। বুঝলে? তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,  শোনো ভাতিজা, আমার এলাকার এক লোক সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে পিওনের কাজ করে। তার দুই-দুইখান বউ আছে। এই লোক সকালে প্রায়ই আমার কাছ থেকে দশ টাকা গাড়ি ভাড়া নিয়ে অফিসে যায় অথচ বিকালে ফিরার সময় ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে আসে। আমরা সবাই জানি এই লোকের আয়ের উৎস কী। অথচ দুর্নীতি দমনকারীরা এদের নাকি খুঁজে পায় না। এ যেন এক কানার হাটবাজার। এসব দুর্নীতিবাজরা বাজার থেকে বড় বড় পাঙ্গাশ কিনে খায়, পাঙ্গাশ! ফলে তাদের পেটের সাইজ এমন হয় যেন পাঞ্জাবি ফেঁড়ে ফুঁড়ে এই বুঝি ভুঁড়ি বেরিয়ে এলো। চাচা একগাল হাসলেন, তিনি উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, তাদেরই দোষ দেব কীভাবে। আমাদের দেশের দুর্নীতিবাজদের ধরাটাও বেশ কঠিন, কারণ এরা টাকার পাহাড় গড়ে; সেই পাহাড়ের ওপরে শুয়ে ঘুমায়, তাই এরা বরাবরই থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আবার অনেক দুর্নীতিবাজ টাকা দিয়ে বানায় হাত-পাখা, হাত-পাখা বানিয়ে কর্তাব্যক্তিদের বাতাস করে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। আচ্ছা, আরামের ঘুম কে হারাম করতে চায় বল।

আমি বললাম, চাচা, আপনি কী জানেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার জিরো টলারেন্স গ্রহণ করতে যাচ্ছে? মোদ্দা কথা, এবার দুর্নীতি বিনাশ হবেই। চাচা আবার মাথা চুলকালেন, বললেন, শুধু কি ইঁদুরের যন্ত্রণায় আছি ভাতিজা? এই দ্যাখো মাথার উকুন, এরাও এক ধরনের দুর্নীতিবাজ! তোরা রক্ত খাবি? রাতে খা! না, দিনের বেলায়, বেলা-অবেলায় রক্ত খাওয়া শুরু করে। যাকগা, এবার আসল কথায় আসি। ভাতিজা, তোমার কথা শুনে খুব খুশি খুশি লাগছে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাঘববোয়ালরা আইনের আওতায় আসবে; দেশটা আরো উন্নত হবে, এমটাই হগ্গলে প্রত্যাশা করে। তবে, আইনের ফাঁক গলে এরা একবার বেরিয়ে গেলে এদের পেছনে ছুটে কোনো লাভ নেই। আমি বললাম— চাচা, বুঝলাম না আপনার কথাটা। তিনি বললেন— তাহলে শোনো, এক লোকের ঘরে অনেক ইঁদুর ছিল, এই ধরো যেমন আছে আমার ঘরে। তো, ওই লোককে কে যেন উপদেশ দিল তুমি ঘরে ইঁদুরের ফাঁদ পাতো, তাহলে ইঁদুর ফাঁদে আটকা পড়বে। তিনি সন্ধ্যায় ফাঁদ পাতলেন। সকালবেলা দেখলেন অনেক ইঁদুর ফাঁদে আটকা পড়েছে। তিনি একগাল হাসলেন, বাপুরা, ঘুরেফিরে সেই আমার হাতের তলায় এলে। তো, এত ফালাফালি করলে কি জন্য? এবার তোদের পিষে মারার পালা। কিন্তু না, তিনি মত পাল্টালেন। বললেন, একটা সামান্য ইঁদুর। একে ফাঁদের ভেতর মারলে আমার ইজ্জত-সম্মান থাকবে? তাহলে আমার ক্ষমতাই বা কী কাজে লাগল? না, এদের ফাঁদের মধ্যে নয়, মারব ফাঁদের বাইরে। তিনি তার চাকরকে অর্ডার দিলেন, ইঁদুরগুলোকে ছেড়ে দিতে। চাকর ফাঁদ খুলে দিল। ইঁদুরগুলো ফাঁদ থেকে বের হয়ে দৌড়াতে লাগল আর লোকটি দৌড়াতে লাগল ইঁদুরগুলোর পেছন পেছন। ইঁদুরেরা এদিক সেদিক দৌড়িয়ে ঘরের কোনায় আনাচ-কানাচে ঢুকে গেল। লোকটি কোনো ইঁদুরকে ধরতে না পেরে অবশেষে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, একটুর জন্য পারলাম না রে! মালিকের এহেন ছেলেমানুষী কাণ্ড দেখে চাকর হাসল পেটে পেটে। আমাদেরও না সেই অবস্থা দাঁড়ায়! সেদিকে নজর রাখতে হবে ভাতিজা।

চাচার কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। পুরান চাল ভাতে বাড়ে— কথাটা একদম সত্য। দেশ ও জাতি এখন চেয়ে আছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’-এর দিকে।

 

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads