• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯
আমি এক স্বাধীন দেশের নাগরিক

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

ফাইল ছবি

মতামত

আমি এক স্বাধীন দেশের নাগরিক

  • আনিসুজ্জামান
  • প্রকাশিত ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। জাতীয় অধ্যাপক, চিন্তায় ও মননে একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। বাঙ্গালির ইহ-জাগতিকার ক্ষেত্রে সংস্কৃতি যে একটি অন্যতম মৌল উপাদান, তাকে প্রকৃষ্ট করে তোলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাঁর মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্র, স্বরুপের সন্ধানে, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, পুরনো বাংলা গদ্য, আমার একাত্তর, কাল নিরবিধি প্রভৃতি গ্রন্থ বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে যুগ যুগ ধরে বাঙ্গালির মানসপটকে চিনিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আকরগ্রহন্থ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।  মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে তিনি ভাষা, দেশ, জাতি ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলে বাংলাদেশের খবরের সঙ্গে। বিশেষ স্বাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলাদেশের খবরের সহকারি সম্পাদক মামুন মুস্তাফা।

মামুন মুস্তাফা : আগামী বছর জাতি হিসেবে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পালন এবং পরের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করব। এমন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের যে লক্ষ্য ছিল তা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছি বলে মনে করেন?

আনিসুজ্জামান : মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যে লক্ষ্য ছিল সেটা পুরোপুরি অর্জন করতে পারিনি। আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যে চার মূলনীতি ছিল, সেই মূলনীতি আক্রান্ত হয়েছে, বিকৃত হয়েছে। তারপর আবার ফিরে এসেছে সংবিধানে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রধর্ম— এ দুইয়ের যে পরস্পর বিরোধিতা, সেটি নিয়ে আমাদের চলতে হচ্ছে। আমরা বোধহয় আমাদের লক্ষ্য থেকে সমাজতন্ত্র বাদ দিয়েছি। বাস্তব অবস্থায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ এটাকে বড় করে ধরার সুযোগ নেই। কেননা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মানুষের সম্পর্কে সচেতন হয়েছি এবং তাদের অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে চাই। সুতরাং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্বনিতে বাংলাদেশ অর্জিত হয়ে থাকলেও এখন আমরা বাঙালি এবং অবাঙালি নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল মানুষের সমান অধিকার দাবি করি, প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করি। এখন এই গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক অর্জন করেছে। তবে সেই সঙ্গে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই বৈষম্য যাতে আমরা কমিয়ে আনতে পারি এবং দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে সকল মানুষকে যেন উপরে টেনে তুলে আনতে পারি।

মামুন মুস্তাফা : ১৯৪৭-উত্তর রাষ্ট্র-ভূখণ্ডে বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্য আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আপনি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত হয়েছিলেন। যা ছিল মূলত মধ্যবিত্ত বাঙালিদের স্বকীয়তা রক্ষার লড়াই। আপনার ‘স্বরূপের সন্ধানে’ প্রবন্ধে আমরা পাঠকেরা সেই সত্যকে আবিষ্কার করি। সেই প্রেক্ষাপটে বলছি— এ অঞ্চলের জনগণ জাতি হিশেবে বাঙালি, জাতীয়তায় বাংলাদেশি, আর সম্প্রদায়গতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান— এই তিন সত্তার ভেতরে বাংলাদেশের এই জনগোষ্ঠীকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

আনিসুজ্জামান : বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে বাঙালি, তবে বাঙালি নয় এমন অনেক জাতিসত্তা আমাদের দেশে রয়েছে। দেশবাসীর অধিকাংশ মুসলমান, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্য ধর্মবিশ্বাসের মানুষও এদেশের অধিবাসী। ১৯৪৭-পরবর্তী পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ ঘটেছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তারপর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল এই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। এই বিকাশের ইতিহাস আমি খানিকটা অধ্যয়ন করার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি, জাতিগত, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় পরিচয় ভিন্ন ভিন্ন বর্গের পরিচয়— তার একটার সঙ্গে আরেকটা মিলিয়ে ফেললে ভুল করা হবে। রাষ্ট্রীয় পরিচয় আমাদের একটি, কিন্তু জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় একাধিক।

মামুন মুস্তাফা : বাংলাদেশের সমাজ অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনাই লালন করে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে ধর্মের ব্যবহার রাষ্ট্রের শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

আনিসুজ্জামান : বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে, এ-কথা আমিও মনে করি। কিন্তু রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ায় দেশে সাম্প্রদায়িকতার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে এবং জঙ্গিবাদ এক প্রবল হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ধর্মের নাম করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা খুব কঠিন নয়, যদি না তার পাল্টা প্রচারণা অব্যাহত থাকে। আজ দেশের নানা জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় এবং বাড়িঘর আক্রান্ত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তা প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসছে না। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও একটা ধর্মীয় চেহারা দেখাতে ব্যস্ত। বাংলাদেশের জন্য তা শুভ ফল বয়ে আনছে না।

মামুন মুস্তাফা : পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমাদের সব আন্দোলনের মূলে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। যার সূতিকাগার হচ্ছে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষার চর্চা আমরা এখনো করতে পারিনি। এর মূল কারণ হিসেবে আপনি কী মনে করেন?

আনিসুজ্জামান : বাংলাদেশ হওয়ার পরে আমরা আশা করেছিলাম, বাংলা ভাষা সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। কিন্তু আমাদের সে আশা পূরণ হয়নি। এখনো উচ্চতম আদালতে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নেই এবং উচ্চতর শিক্ষার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার প্রয়োগ নেই। দেখা গেল, বাংলাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করতে হলে বাংলায় যে পরিমাণে পাঠ্যবই লেখা দরকার, আমাদের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা সেক্ষেত্রে এগিয়ে এলেন না এবং উচ্চতর আদালতও বাংলা ব্যবহারকে উৎসাহিত করলেন না। বরঞ্চ আদালতের একটি রায়ে বলা হয়েছে, নিম্নতর আদালতে যেখানে বাংলায় সব কাজকর্ম হয়, সেখানে ইংরেজিও ব্যবহার করা যাবে। কাজেই বাংলা ভাষার ক্ষেত্রটা আমরা নিজেরাই সীমাবদ্ধ করে ফেললাম। এর মধ্যে দেখা গেল, আমাদের উদীয়মান মধ্যবিত্ত, কিছু অতিরিক্ত অর্থাগম করে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত হওয়ার পথে যাত্রা করেছে এবং তার কাছে বাংলা মাধ্যমে পড়ালেখার চাইতে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো। তার কাছে ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়ানো এটা গুরুত্ব লাভ করল। ফলে বাংলা মাধ্যম শিক্ষাও অনেকখানি অবহেলিত হলো। আজকে নাগরিক মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা সবাই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করছে। এসব কারণে বাংলা যথার্থ স্থান লাভ করতে পারল না এবং এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে বলে আশাও করা যায় না।

মামুন মুস্তাফা : কথিত আছে, বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতিতে আমাদের ছেলেমেয়েরো না পারছে বাংলা শিখতে না পারছে ইংরেজি। তারা বিশ্বে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। এর উত্তরণে করণীয় কী?

আনিসুজ্জামান : ভাষা শিক্ষার সমস্যাটা শুরু হচ্ছে স্কুলে। স্কুলের শিক্ষকরা বাংলা এবং ইংরেজি কোনো ভাষাই যথেষ্ট যত্নের সঙ্গে, গুরুত্বের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের শেখাতে পারছেন না। ফলে এরা যখন উপরে আসছে, ওই দুর্বলতা সঙ্গে করে নিয়ে আসছে। মফস্বল থেকে যারা আসছে, তারাও কিন্তু অনেকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে আসছে। যারা বাংলা মাধ্যমে পড়ে আসছে, তারা স্নাতক স্তরে ইংরেজিতে যখন পড়ানো হচ্ছে, তারা খুব অসুবিধা বোধ করছে এবং পিছিয়ে পড়ছে। এসবের একটি সুষ্ঠু সমাধান আমাদের খুঁজে বের করা দরকার। আমি মনে করি, সমস্যাটা আমরা সবাই উপলব্ধি করেছি, কিন্তু সমাধানে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছি।

মামুন মুস্তাফা : জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যমসহ আমাদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক জগতে বর্তমানে এক ধরনের বাংলা ভাষার ব্যবহার দেখা যাচ্ছে, বিশেষত টিভি নাটকের ক্ষেত্রে যা আমাদের প্রমিত বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

আনিসুজ্জামান : এটা শুরু হয়েছে, বেতার— এফএম ব্যান্ডের যে বেতার কার্যক্রম সেখান থেকে। সেখানে ডিজেরা বাংলা, ইংরেজি, আঞ্চলিক ভাষা মিলিয়ে একটা বাংলা ভাষার রূপ দাঁড় করিয়েছে, যেটি প্রমিত নয়। টেলিভিশন এবং জাতীয় প্রচারমাধ্যমে, ঠিকই বলেছ যে, নাটকের ক্ষেত্রে আমরা আঞ্চলিক ভাষার অথবা কোনো অঞ্চলের ভাষা নয়, এক ধরনের মিশ্রিত ভাষার প্রয়োগ দেখছি। এটি প্রচারিত হওয়ার ফলে তরুণ সমাজ এটাকেই শিষ্ট বাংলা বলে গ্রহণ করছে, তারা এই বাংলায় কথা বলছে। ফলে এক ধরনের বাস্তবতার নির্মাণ করতে গিয়ে এই ভাষার সংলাপ ব্যবহার শুরু হয়েছে। এটি আমার মতে ক্ষতিকর। কেননা প্রমিত বাংলার ব্যবহার আবশ্যক। নিশ্চয়ই বাস্তবতার খাতিরে আঞ্চলিক বাংলা ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু যে বাংলা কোনো অঞ্চলেরই না, একেবারে কিছু তরুণ-তরুণীর খামখেয়ালিপূর্ণ চিন্তা থেকে উদ্ভূত, সেই বাংলা জাতীয় প্রচারমাধ্যমে স্থান পাওয়া উচিত নয়।

মামুন মুস্তাফা : বাংলা ভাষার উন্নয়নে বর্তমানে বাংলা একাডেমি কার্যক্রম সেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাংলা একাডেমির সভাপতি হিসেবে আপনার মতামত জানতে চাই।

আনিসুজ্জামান : যে-রকম পাঠ্যপুস্তকের কথাটা আমি বললাম। উচ্চশিক্ষার স্তরে বাংলা একাডেমি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে সফলতার পরিচয় দেয়নি। তার কারণ বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রে এগিয়ে আসেননি। এখন বিজ্ঞানের বই তো বিজ্ঞানীরা লিখবেন, এটা তো বাংলা একাডেমির লোক লিখতে পারবে না। তারা এগিয়ে এলে বাংলা একাডেমি এটা প্রকাশ করবে। কিন্তু এই যোগাযোগটা আমাদের হচ্ছে না। এটি আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা বলে আমার মনে হয়। ব্যর্থতা কেবল বাংলা একাডেমির নয়।

মামুন মুস্তাফা : আমরা জানি, একটি রাষ্ট্র গঠনে সেই দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির নিরপেক্ষ দিকদর্শন গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সংস্রবে কাজ করছেন। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন? এর ফলে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে দেশ, জাতি ও সমাজ গঠনে তাঁদের দায়বদ্ধতাই বা কোথায়?

আনিসুজ্জামান : বুদ্ধিজীবীদের বিচার-বিশ্লেষণ, বক্তব্য-দিকনির্দেশনা কখনো কখনো কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে যেতে পারে, তবে তারা যদি রাজনৈতিক দলের কোটরে চলে যান, তাহলে মানুষ তাদের বক্তব্য নিরপেক্ষ বলে গ্রহণ করতে পারে না। আমি যদি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষপাতীও হই, তবু সে-দল ভুল কিছু করলে, আমাকে তা স্পষ্ট করে ভুল বলেই ব্যাখ্যা দিতে হবে। বুদ্ধিজীবীরা অনেক সময়ে এই কাজটি করতে পারেন না, কেননা, তাদের ভয় হয়, তাদের সমালোচনা সেই বিরোধী পক্ষের হাত শক্ত করবে যাদের তিনি দেশের হিতাকাঙ্ক্ষী বলে গণ্য করেন না। দেশ ও সমাজগঠনে ভূমিকা রাখতে হলে এই ভয় কাটিয়ে উঠতে হবে।

মামুন মুস্তাফা : আপনি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। বাঙালির এই মহান বীর সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে কিছু জানতে চাই। সেই সঙ্গে যদি বলেন, এই মহান রাষ্ট্রনায়কের রাজনৈতিক দর্শন বর্তমান বাংলাদেশে তাঁরই উত্তরসূরিদের হাতে কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে?

আনিসুজ্জামান : বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপরিচালনার চার মূলনীতিকে নিজের রাজনৈতিক দর্শনের অভিব্যক্তি হিসেবেই দেখতেন। তবে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনে সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে তিনি কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিলেন, যদিও এটাকে তিনি একটা সাময়িক ব্যবস্থা বলেই অভিহিত করেছিলেন। তিনি যে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তান আমলে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে আন্দোলন করেন এবং যে দৃঢ়তার সঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন, তার মূল্য অপরিসীম। বাঙালিত্ব তার অস্থিমজ্জার সঙ্গে মিশে ছিল, তাই জীবনসংশয় দেখা দিলে তার একমাত্র প্রার্থনা ছিল, এদেশের মাটিতেই যেন তার শেষ শয্যা রচিত হয়। তার রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নের ইচ্ছা তার উত্তরাধিকারীদের অনেকেরই আছে, তবে কেউ কেউ ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় তা বাস্তবায়নে ভয় পান।

মামুন মুস্তাফা : একটি আধুনিক এবং উন্নত রাষ্ট্র গঠনে আগামী প্রজন্মকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জাতি হিসেবে আমাদের কী করণীয় আছে বলে আপনি মনে করেন?

আনিসুজ্জামান : আগামী প্রজন্মকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। কোনো একটি বিষয়ে, কোনো একটি ভাষায়, বিজ্ঞানের কোনো একটি দিকে তার দক্ষতা থাকতে হবে। তবেই সে জাতীয় জীবনে তার ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হবে। এটিই এখন পর্যন্ত হয়ে উঠছে না। আমাদের কিন্তু প্রতিভার অভাব নেই। কিন্তু প্রতিভার লালন এবং এই পথে প্রতিভার বিকাশ এটা হয়ে উঠছে না। এ বিষয়ে আমাদের সবারই যত্নবান হতে হবে।

মামুন মুস্তাফা : ৪৮তম বিজয় দিবস পালনের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে জানতে চাই, আপনার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের অনুভূতি প্রসঙ্গে।

আনিসুজ্জামান : আমি তখন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সামনে বসে। তিনি ডেকেছিলেন তার বক্তৃতা লিখে দেওয়ার জন্যে। সেখানে বসে আমি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের খোঁজ করছিলাম। জানতে পেলাম, তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে থাকার জন্যে। তখন থেকে এক অস্থিরতা কাজ করছিল কখন সারেন্ডার করা হবে। অবশেষে যখন পাকবাহিনী সারেন্ডার করল। তখন মনে হলো, আজ থেকে আমি মুক্ত, আমি এক স্বাধীন দেশের নাগরিক। এর চেয়ে বড় আর কিছু হতে পারে না।

মামুন মুস্তাফা : সবশেষে জানতে চাই, বর্তমান বাংলাদেশের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?

আনিসুজ্জামান : বাংলাদেশের কাছে এই মুহূর্তে আমার প্রত্যাশা, উন্নয়নের প্রসঙ্গে আমি বলেছি যা— বাংলাদেশ বৈষম্য দূর করবে, সমাজে মানুষের মধ্যে যে আর্থিক বৈষম্য আছে, সেটা দূর করবে এবং দক্ষ মানবশক্তি হিসেবে আমাদের নাগরিকদের গড়ে তুলবে।

মামুন মুস্তাফা : আপনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় দেওয়ার জন্যে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

আনিসুজ্জামান : ধন্যবাদ তোমাকেও। বাংলাদেশের খবরের জন্যে শুভকামনা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads