• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
বন সংরক্ষণ আইনের পরিধি বৃদ্ধি প্রয়োজন

ফাইল ছবি

মতামত

বন সংরক্ষণ আইনের পরিধি বৃদ্ধি প্রয়োজন

  • সাঈদ চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯

গত বছর শীত মৌসুমে ভাওয়ালগড়ের ভবানীপুরের গহিন বনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই দেখলাম বনকর্মীরা খুব দৌড়াদৌড়ি করছেন। একজন দেখলাম বনের আগাছা উঠিয়ে দৌড়ে গিয়ে গজারি বনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া আগুন নেভানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। বনের আগুন নেভানোর পর তাদের সঙ্গে কথা হলো বনের ভেতরে এমন আগুনের বিষয় নিয়ে। তাদের আগুন নেভানোর আন্তরিকতায় মনে হচ্ছিল অনেক মানুষই আছেন যারা কাজ করেন অথবা পেছন থেকে কাজ করার জন্য কাজ করে যান। এমন মানুষরা সব সময়ই শ্রদ্ধার জায়গায়ই থাকে। এ রকম মানুষের কাজেই আমরা সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।

বনের ভেতর আগুন নিয়ে অনেক কথা লিখেছি এর আগে। গত শীতের মৌসুমেও হোতাপাড়া থেকে আসার সময় ভেরামতলীর একটি জায়গায় শাল-গজারির গহিন বনে আগুন লাগা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তখন মনে হয়েছিল কীভাবে এই আগুন লাগা বন্ধ করা যায় তা নিয়ে ভাবনা আরো প্রসারিত করা প্রয়োজন। আসলে গহিন বনে কিছু অসাধু মানুষ যখন এ কাজগুলো করে, তখন কিছুই করার থাকে না। বনকর্মীরা রাস্তার ভেতর দিয়ে চেক দিয়ে যাওয়ার সময় যদি এ রকম কিছু দেখেন সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েন তা নেভানোর জন্য কাজ করেন-এমনটাই বলছিলেন গতবার আগুন নেভানোর কাজে অংশগ্রহণকারী দুই বনমালী। তারা বলেছিলেন যে, আগুন যাতে লাগানো বন্ধ হয় তার জন্য মাইকিংও করা হয়ে থাকে। সচেতনতামূলক কাজের অংশ হিসেবে অনেক সময়ই মাইকিং করা হয়। কিন্তু অনেকটা হেলাখেলার বসেই নাকি অনেকে বনে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে যায়! এমনও শোনা যায়, কেউ খেলার ছলে সিগারেট ধরানোর পর জ্বলন্ত সিগারেট ফেলেই বনে আগুন দিয়ে চলে যায়।  আর পুড়তে থাকে পুরো বনের মাটি, গজারিসহ সব গাছের শেকড়, পোকামাকড়! ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় ওই অংশের পুরো জীববৈচিত্র্যের পুরোটা!

এভাবে আর কত? এক্ষেত্রে মানুষের আইন না জানার ব্যাপারটিও থাকতে পারে। বনে আগুন দেওয়াও আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা আছে। আগুন না দেওয়ার ব্যপারে মানুষকে আইন জানাতে হবে। আইনের ক্ষেত্রেও এর ব্যাপকতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনকে নতুনভাবে প্রণয়ন করাও খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বনে এমন কোনো কাজ করা যাবে না যা বনের ভারসাম্য নষ্ট করে, যা বনের বৃক্ষের, প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য ক্ষতিকর তাই দণ্ডনীয় অপরাধ।

বন সংরক্ষণ আইনটি ১৯২৭ সালে প্রণীত এবং এখন পর্যন্ত ওই আইনটি অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। সংশোধিত আইন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেও শাস্তির ক্ষেত্রে হয়তো বড় শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব। কিন্তু বন সংরক্ষণ আইন আবার পুনরায় সংশোধনী আকারে প্রকাশ করে, সে অনুযায়ী বনে যারা আগুন দেয় অথবা বন ধ্বংসের মতো কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। 

সরকারের এ জায়গাটিতে আরো অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। বিট অফিস প্রয়োজনে বনের মধ্যে আরো বাড়াতে হবে অথবা বনকর্মীর সংখ্যা বাড়িয়ে বনের রক্ষণাবেক্ষন বাড়াতে হবে। যদি তা না করা যায়, তবে বনের মধ্যে এমন আগুন দেওয়ার ফলে জীববৈচিত্র্য চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হতেই থাকবে। শাল-গজারি বন রক্ষার্থে সরকারের আরো বড় পরিকল্পনা আশা করছি। বনের পাশে বসত করে এমন কারো কারো সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেউ কেউ বনে আগুন দেয় বনের ছাঁটি সংগ্রহের জন্য, ছাই সংগ্রহের জন্য। এই ছাই সংগ্রহ করে তারা ধান খেতের সার হিসেবে ব্যবহার করে। সুতরাং মানুষকে সচেতন করারও কোনো বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষকে এদিক দিয়ে বোঝাতে হবে যে, বনে আগুন দিলে কী কী ক্ষতি হয় আর অন্যদিকে আইনের আওতায় আনার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।

ঢাকার অক্সিজেন ফ্যাক্টরি হলো এই ভাওয়াল ও মধুপুরের শাল-গজারির বন। বর্তমানে ঢাকার বায়ুতে এসপিএমের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কার্বনসহ অন্য ক্ষতিকর গ্যাসের ব্যাপ্তিও বাড়ছে। সিসার পরিমাণও বেড়েছে এবং আরো বাড়বে কারণ ভারী শিল্পের পরিমাণ দিন দিনই বাড়ছে। এ অবস্থায় ঢাকার অক্সিজেন সরবরাহের জন্য শুধু ঢাকার ভেতরে গাছ বাড়ানো নয়, প্রয়োজন ঢাকার চারপাশে গ্রিন জোন তৈরি করা। গ্রিন জোনটি হবে এমন যেন পুরো একটি স্টেডিয়ামের মধ্যে সবুজ মাঠের মতো। ঢাকার চারপাশে থাকবে বৃক্ষ, মাঝখানে থাকবে রাজধানী। আর এ কারণেই ভাওয়াল ও মধুপুরগড়ের যত্ন নিতে হবে। শুধু তাই নয়, পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতেও বনের ভেতর আগুন দিয়ে বন পুড়িয়ে সেখানে রোপণ করা হয় অন্য বৃক্ষ। বান্দরবানের গহিন বনে গিয়ে দেখেছিলাম বনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে সেখানে তামাক পর্যন্ত চাষ করা হচ্ছে! অনেক ক্ষেত্রে পুরনো বৃক্ষ কেটে সেগুলো বান্দরবানের শঙ্খ নদ দিয়ে পাচার হচ্ছে। আর ওই জায়গাগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে সেখানে অন্য ফসল করে কেউ কেউ জীবিকা নির্বাহ করছে। এ বিষয়গুলো পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জলজ পরিবেশ ও স্থলজ পরিবেশের ভারসাম্য হারাচ্ছে এই বনাঞ্চলগুলো।

পরিবেশ বন ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এ ব্যাপারে সুদৃষ্টি দেবেন, তাই আশা করছি। আইন সংশোধনের ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর ও আইন মন্ত্রণালয় একই সরলরেখায় থেকে কাজ করবেন এটাই প্রত্যাশা। বনে আগুন দেওয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। আগুন দেওয়া বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে বন কাটা বন্ধে আরো পদক্ষেপ নিতে হবে। কাঠের ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য আরো পদক্ষেপ নিতে হবে। অথবা নির্দিষ্ট জাতের গাছ রোপণ বেশি করে তা থেকে কাঠের চাহিদা পূরণ করার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। স’মিলগুলোর লিস্ট সরকারের ভালোভাবে যাচাই করা প্রয়োজন। অবৈধ স’মিলগুলো বন্ধেও কাজ করা প্রয়োজন বন রক্ষার্থে।  যদি তা না করা যায় তবে তা হবে চরম ধ্বংসের কারণ। আমরা চাই পরিবেশ বাঁচুক তার আপন শক্তিতে, সবুজে ও প্রকৃতির মতো করে।

লেখক : সদস্য

উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি

শ্রীপুর, গাজীপুর

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads