• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জৈষ্ঠ ১৪২৯

মতামত

সচিবালয়ে সাংবাদিক নিগ্রহ ও দেশের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ২০ মে ২০২১

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই দৈনিক বাংলার বাণীর সম্পাদক, রাজনীতির মেধাবী মুখ শেখ ফজলুল হক মণি দীর্ঘ আট কলামজুড়ে রঙিন হেডলাইনে লিখেছিলেন, ‘মোনায়েমী আমলাদের দিয়ে মুজিবের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়’। মনি ভাইয়ের এই সংবাদে তাৎক্ষণিক তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়, এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছিলেন- ‘শেখ মণির এই থিওরি’ প্রশাসনকে দ্বিধাবিভক্ত করবে এবং প্রশাসনে অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।

আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আমাদের দেশের প্রশাসন বিভিন্ন কিসিমের শাসনামলে যেভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, অসহিষ্ণু এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ মূর্তিতে

আবির্ভূত হয়েছে, তাতে প্রমাণিত হয়েছে মণি ভাইয়ের কথাই সঠিক ছিল। এটা কোনো গোষ্ঠীর প্রতি কটাক্ষ ছিল না। মণি ভাইয়ের এই বক্তব্য ছিল একটি নির্ভুল মূল্যায়ন ও রাজনৈতিক হাইপোথেসিস।

আজ অধিকাংশ আমলা যেভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠন করে দেশে-বিদেশে বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসা পরিচালনাসহ রাজকীয় জীবনযাপন করছেন, তাতে প্রমাণিত হয় আমলাতন্ত্রের একটি অংশ আজ রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়েছে। আমলাতন্ত্রের একাংশের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ আজ সুশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

আমাদের জাতির পরম সৌভাগ্য-দেশে আজ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতাসীন। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ রাষ্ট্র পরিচালনার শীর্ষে। বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়ে গেছেন। কিন্তু ঘাতকের কালো পিস্তলের থাবার নিচে শাহাদত বরণ করায় মুক্তির সংগ্রামটি করে যেতে পারেননি। এই মহৎ কাজটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব রেখে গেছেন তার প্রিয় কন্যা শেখ হাসিনার জন্য।

বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে জননেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন রূপকল্প ’২১ ও উন্নত বাংলাদেশ ’৪১-এর। আজ শেখ হাসিনাই ভালো বলতে পারবেন জোট সরকারের রেখে যাওয়া আমলাতন্ত্রের একটি অংশ তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে কী দুর্ভেদ্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সফল উন্নয়ন অর্জন করতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। শেখ হাসিনা তথা জাতির পরম সৌভাগ্য এই যে, গত একযুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, তা কেবল অকল্পনীয়ই নয়, অশ্রুতপূর্বও বটে।

বর্তমান সরকারের সামনে আজ আর কোনো বিরোধী শক্তি নেই। শেখ হাসিনাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিও নেই। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে এমন শক্তির আবির্ভাব আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যমানও নয়।

এমন অবস্থায় আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, অগণতান্ত্রিক শক্তি, ক্ষমতালোভী চক্র নিশ্চুপ বসে নেই। দেশ-বিদেশে চলছে সুগভীর ষড়যন্ত্র। যে প্রকারেই হোক শেখ হাসিনাকে পর্যুদস্ত করতে হবে এটাই তাদের এজেন্ডা। এটাকে সফল করতে হলে চাই দেশে অরাজকতা ও বিচ্ছৃঙ্খলা সৃষ্টি। এই লক্ষ্য অর্জন করতে বিশেষ মহলকে উসকে দিয়ে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করাই এখন কায়েমি উচ্চাভিলাষী মহলের একমাত্র লক্ষ।

এই লক্ষ্য পূরণে জামায়াত-শিবিরসহ যেসব প্রতিক্রিয়াশীল মহল প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আত্মগোপন করে আছে, যেসব স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী সর্বস্তরে বিশেষ করে প্রশাসনে অনুপ্রবেশকারী হয়ে অবস্থান করছে, তারা সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় আছে। মোক্ষম সময়ে ইন্ধন জুগিয়ে দেশে উত্তাল ও অরাজকপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য হাসিলের চেষ্টা করবে। এতে কোনো প্রকার সন্দেহ ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই যে, গত সোমবার সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মেধাবী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যে ন্যক্কারজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে তা এমনি একটি ষড়যন্ত্র যা সরকারকে চরম বেসামাল পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করা যায়। ঘটনা সম্পর্কে দুপক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থান সবার কাছে পরিষ্কার। সচিবালয়ে কী ঘটেছিল, তা জানার জন্য দেশের বিবেকপ্রসূত জনগণকে কোনো তদন্ত কমিটির রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনার কিছুই নেই। এটা দিনের মতো পরিষ্কার যে, একটি অস্থিতিশীল ও অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করাই এর মূল লক্ষ্য। এ জন্যই সাংবাদিক সমাজকে বেছে নেওয়া হয়েছে। কারণ সাংবাদিক সমাজকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানো স্বার্থান্বেষী মহলের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এর কারণ, বর্তমান সরকার তথা শেখ হাসিনা যে সাংবাদিকবান্ধব এটা সুপ্রমাণিত এবং এজন্য আমলাতন্ত্রের একটি অংশের গাত্রদাহের কারণ।

তাই অনুপ্রবেশকারী স্বাধীনতাবিরোধী চক্র সক্রিয় হয়ে আছে কীভাবে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে জনরোষ সৃষ্টি করা যায়। আর একবার জনরোষ সৃষ্টি করতে পারলে দেশে বর্তমানে উন্নয়নের সচল চাকাকে অচল করে দিয়ে ষড়যন্ত্রকারী চক্রের মূল লক্ষ্যে পৌঁছানোর এজেন্ডা সফল করা যাবে।

সাংবাদিক রোজিনাকে নিয়ে যে গর্হিত, অমানবিক ও উদ্দেশ্যপ্রসূত ঘটনার জন্ম দেওয়া হয়েছে, তাতে কেবল সাংবাদিক সমাজই ক্ষুব্ধ হয়নি; বিস্মিত ও ব্যথিত হয়েছে দেশের আপামর মানুষও। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে গোটা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। এর ফলে সারা বিশ্বে নন্দিত আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকারের সুশাসনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। আমাদের মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, রোজিনা যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ করে করোনা ভ্যাকসিন বিষয়ে লিখতেন তবে নাকি বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতো। অতএব রোজিনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রোজিনা তথা সংবাদপত্রের ওপর এহেন নগ্ন হামলায় জাতিসংঘসহ গোটা সভ্য দুনিয়ায় যে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠেছে, তাতে দেশের ভাবমূর্তি কতটা উজ্জ্বল হয়েছে, মাননীয় মন্ত্রী তার জবাব দেবেন কি?

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads