• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
নান্দনিক মুসলিম স্থাপত্য

ইসলামিক স্থাপনাগুলো সভ্যতা ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

নান্দনিক মুসলিম স্থাপত্য

  • মোস্তফা কামাল গাজী
  • প্রকাশিত ১৯ অক্টোবর ২০১৮

অগণিত মুসলিম মনীষীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টার কল্যাণে বিশ্বজুড়ে আজ ইসলামের মর্মবাণী পৌঁছে গেছে। এই পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় নানা প্রান্তে জন্ম নিয়েছেন ক্ষণজন্মা প্রতাপশালী মুসলিম শাসক। তাদের হাতে নির্মিত অভূতপূর্ব দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন ইসলামিক স্থাপত্য ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে। অপূর্ব সেই ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে রয়েছে মসজিদ, রাজপ্রাসাদ, দুর্গ, সেতুসহ বিভিন্ন ধরনের দালান। পারস্য অঞ্চলের পাশাপাশি ইসলামিক স্থাপনাগুলো গড়ে উঠেছিল ইউরোপ থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত। অটোমান সাম্রাজ্যের বিস্তার ইসলামিক স্থাপনাকে নিয়ে গিয়েছিল অন্যমাত্রায়। ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি ইসলামিক স্থাপনাগুলো সভ্যতা ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শতসহস্র ইসলামিক স্থাপনার মধ্য থেকে কয়েকটি নিদর্শন নিচে উল্লেখ করা হলো।

ষাটগম্বুজ মসজিদ (বাংলাদেশ) : মুসলিম স্থাপত্যের গুরুত্ব ও নান্দনিকতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থাপনার মধ্যে একটি হলো ষাটগম্বুজ মসজিদ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা বাগেরহাট শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত মসজিদটি। পনেরো শতকে নির্মিত হয় এই মসজিদ। ধারণা করা হয়, সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৫-৫৯) আমলে খান আল-আজম উলুগ খানজাহান সুন্দরবনের কোলঘেঁষে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তোলেন। খানজাহান বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল গড়ে তোলেন, যা পরে ষাটগম্বুজ মসজিদ হয়। মসজিদটি ষাটগম্বুজ নামে পরিচিত হলেও এতে মোট গম্বুজ আছে ৮১টি। মসজিদের চার কোণের মিনার বা বুরুজের উপরের ৪টি গম্বুজ বাদ দিলে গম্বুজ সংখ্যা হয় ৭৭টি। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভেতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভেতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। মসজিদটিকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে মর্যাদা দেয়।

নীল মসজিদ (ইস্তাম্বুল) : তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক মসজিদ সুলতান আহমেদ মসজিদ। মসজিদটি তুর্কি স্থাপত্যের এক অনন্য উদাহরণ। ১৯৩৪ সালে ‘হাজিয়া সুফিয়া’-কে মিউজিয়ামে রূপান্তর করার পর এটি ইস্তাম্বুলের প্রধান মসজিদে পরিণত হয়। মসজিদের ভেতরে ঢুকলে মনে হবে সমুদ্র জলরাশির রঙে রাঙানো। ভেতরের দেয়াল নীল রঙের টাইলস দিয়ে সাজানো। বাইরে থেকে এই নীল রঙের ঝিলিক দেখে অনেকেই একে বলেন ‘ব্লু মস্ক’ বা নীল মসজিদ। মসজিদটির মিনার ও গম্বুজগুলো সিসা দিয়ে আচ্ছাদিত এবং মিনারের উপরে সোনার প্রলেপযুক্ত তামার তৈরি ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছে। ১৬০৯ থেকে ১৬১৬ সালের মধ্যে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান আহমেদ বখতি এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিক এ মসজিদটির স্থপতি ছিলেন মুহাম্মদ আগা। মসজিদ কমপ্লেক্সে একটি মাদ্রাসা, একটি পান্থনিবাস এবং প্রতিষ্ঠাতার সমাধি  অবস্থিত।

তাজমহল (ভারত) : বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি তাজমহল। মোগল সম্রাট শাহজাহান তার তৃতীয় স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতি রক্ষার্থে এটি নির্মাণ করেছিলেন। তাজমহল খুব ভোরে গোলাপি, দিনে সাদা আর চাঁদের আলোয় সোনালি রঙের দেখায়। এই অনন্য স্থাপনাটির স্থপতি ছিলেন আহমেদ লাহোরি। তাজমহল নির্মাণের জন্য তিনি ২২ হাজার লোক নিযুক্ত করেন। যারা ছিলেন শ্রমিক, স্টোনকাটার, চিত্রশিল্পী, সুচিকর্মশিল্পী ও ক্যালিগ্রাফার। সম্রাট রাজস্তান, আফগানিস্তান, তিব্বত ও চীন থেকে মার্বেল পাথর আনিয়েছিলেন। এ ছাড়া ২৮ ধরনের মূল্যবান ও আধামূল্যবান পাথর সাদা মার্বেলের ওপর বসানো হয়েছিল। যার মধ্যে আকর্ষণীয় নীলকান্তমণিও ছিল। তাজমহলের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ সালে এবং সম্পন্ন হয়েছিল ১৬৫৩ সালে। এটি সম্পন্ন করতে ২২ হাজার শ্রমিকের ২২ বছর সময় লেগেছিল।

মসজিদে আকসা (জেরুজালেম) : ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ এবং প্রথম কেবলা ‘মসজিদুল আকসা’ বা ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ সুপ্রাচীন শহর জেরুসালেমে অবস্থিত। মহানবী (সা.) মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদুন্নববী ও মসজিদুল আকসার উদ্দেশে সফরকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, যা অন্য কোনো মসজিদ সম্পর্কে করেননি। এর গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ঘরে নামাজ পড়লে এক গুণ, মসজিদে ২৫ গুণ, মসজিদে নববী ও আকসায় ৫০ হাজার গুণ, মসজিদে হারামে এক লাখ গুণ সাওয়াব।’ (ইবনে মাজাহ) হজরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর হজরত ইয়াকুব (আ.) জেরুসালেমে আল-আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন। অতঃপর হজরত সুলায়মান (আ.) জিনদের মাধ্যমে এই পবিত্র মসজিদ পুনর্নির্মাণ করেন। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে পুরো বায়তুল মুকাদ্দাস এলাকা মুসলমানদের অধীনে আসে। ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা নামধারী মুসলিম শাসকদের সহায়তায় সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। এরপর তারা ১০৯৯ সালের ৭ জুন বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে এবং ১৫ জুলাই মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গির্জায় পরিণত করে। ১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ ফাতেমি খিলাফতের কেন্দ্রীয় খলিফার নির্দেশে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (র.) গভর্নর ও সেনাপ্রধান হয়ে মিসরে আগমন করেন। এরপর ১১৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রক্তয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিম বীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (রা.) জেরুসালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। অতঃপর ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর শুক্রবার সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (রা.) বিজয়ী বেশে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন। বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত হওয়ার পর সেখানকার মুসলিমরা প্রায় ৯০ বছর পর ক্রুসেডারদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছিলেন।

ইসফাহানের জামে মসজিদ : ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ইসফাহানের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যবিষয়ক গৌরবের অন্যতম। সেলজুক শাসনামলে নির্মাণ হয় এটি। বারোশ শতাব্দীতে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। আইওয়ান ধাঁচে নির্মিত এর গঠনপ্রণালি হলো চার কোনাবিশিষ্ট একটি প্রাঙ্গণের প্রতি পাশে একটি করে বড় খিলান করা দরজা, যা বিপরীত পাশের দরজার দিক সরাসরি মুখ করে থাকবে। ইসফাহানের জামে মসজিদের এই বৈশিষ্ট্য পরে ইরানের সব মসজিদের বৈশিষ্ট্য হয়ে পড়ে। ইউনেস্কো ২০১২ সালে এই মসজিদটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করে।

গোলাপি মসজিদ (ইরান) : চোখ ধাঁধানো মসজিদগুলোর তালিকা করলেই নাম উঠে আসে গোলাপি মসজিদের। ইসলামিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোরও একটি এটি। ইরানি স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদ ইরানের অন্যতম সুন্দর একটি মসজিদ। গোলাপি মসজিদ নামে পরিচিত এই মসজিদের আসল নাম নাসির উল মুলক মসজিদ। ইরানের শিরাজে অবস্থিত এটি। মসজিদটি অনেক রঙিন কাচ দিয়ে সাজানো হয়েছে। যে কারণে মসজিদের ভেতর লাল-নীল-বেগুনি-গোলাপির দ্যুতি ছড়ায়। নকশার কারুকাজ অতুলনীয়। মসজিদের ভেতরের জলাশয় সবাইকে মুগ্ধ করে। এই মসজিদকে গোলাপি মসজিদ বলার কারণ এতে অনেক গোলাপি রঙের টাইলস নকশা তৈরিতে ব্যবহূত হয়েছে। ১৮৭৬ থেকে ১৮৮৮ সালের মধ্যে মির্জা হাসান আলীর (নাসির উল মুলক) আদেশে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।

আবদুল কাদের জিলানির (রহ.) রওজা (ইরাক) : গাউসুল আজম খ্যাত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানির রওজা ইরাকের বাগদাদ শহরে। তার রওজাকে কেন্দ্র করে বাগদাদে গড়ে উঠেছে কাদেরিয়া সুফি কমপ্লেক্স। জায়গাটিকে বলা হয় কিলানি স্কয়ার। এর ভেতরে রয়েছে সুদৃশ্য মসজিদ, রওজা শরিফ ও বিশাল একটি লাইব্রেরি। লাইব্রেরিতে আছে বহু পুরনো বইয়ের সমাহার। কাদেরিয়া লাইব্রেরি নামে এটি সারা বিশ্বের ইসলাম ঐতিহ্য গবেষকদের কাছে পরিচিত। শাহ ইসমাইলির আমলে রওজাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৫৩৫ সালে অটোমান সুলতান সুলায়মান এই রওজার ওপর বড় গম্বুজ বসান এবং সংস্কার করে আজকের রূপটি দেন।

শিক্ষক : জামিয়া ইসলামিয়া এমদাদুল উলুম বাগ্নিবাড়ি মাদরাসা, সাভার, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads