• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯
সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে কওমি শিক্ষর্থীদের ভাবনা

বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের লোগো

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে কওমি শিক্ষর্থীদের ভাবনা

  • প্রকাশিত ২৬ অক্টোবর ২০১৮

কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর সমমানের স্বীকৃতি আইনি বৈধতা পেয়েছে চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর। আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীন ‘কওমি মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান বিল, ২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তরকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এক্ষেত্রে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির ব্যবস্থা রাখা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের কমিটি তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে সময় সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে। মূলত হেফাজতে ইসলাম যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবেই আইনটি হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, এ আইন সমগ্র বাংলাদেশে দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি, আদর্শ ও নিসাব (পাঠ্যসূচি) অনুসরণে পরিচালিত কওমি মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে ছয়টি কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থাকবে। সেগুলো হলো- বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙা, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ, আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তালিম বাংলাদেশ, তানযীমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশ ও জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ। দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর সমমানের স্বীকৃতি আইনি বৈধতা পাওয়ার পরে এ বিষয়টি নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। কওমি মাদরাসার স্বীকৃতির ভবিষ্যৎ কী? এই স্বীকৃতির মাধ্যমে কি আসলেই কওমির শিক্ষার্থীরা লাভবান হবে? এ বিষয়ে কথা বলেছেন কওমি মাদরাসায় পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন ওয়ালি উল্লাহ সিরাজ

regular_4344_news_1540488858

কওমি সনদের স্বীকৃতিতে সামগ্রিকভাবে জাতির কল্যাণ হবে

তানজিল আমির কওমি মাদরাসা পড়ুয়া মিডিয়াকর্মী। তিনি বলেন, কওমি মাদরাসাগুলোর সনদের স্বীকৃতি দীর্ঘদিনের একটি প্রতীক্ষিত বিষয় ছিল। স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচলা ও দৌড়ঝাঁপ কম হয়নি। হয়েছে অনেক রাজনৈতিক মারপ্যাঁচও। সবকিছু ছাড়িয়ে এখন তা বাস্তব। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছা ও সুদৃঢ় পদক্ষেপে মন্ত্রিসভা ও সংসদে পাস হয়ে কওমি মাদরাসার সনদের মানের গেজেটও প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি কওমি মাদরাসাসংশ্লিষ্ট যে বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে, শুধু তাদের জন্য নয়- পুরো জাতির জন্যই আশীর্বাদ হবে বলে আমি মনে করি। কওমি মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা হলেও তথ্যপ্রযুক্তির এ সময়ে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সঠিকভাবে তাল মেলাতে পারছিল না। বিষয়টি কওমি সিলেবাসের দুর্বলতা ও অপ্রতুলতা নয়, বরং আধুনিক শিক্ষাধারার সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবে। আজ থেকে কয়েক বছর আগে যখন ভোটার তালিকা হালনাগাদের কার্যক্রম চলছিল, তখন দাওরা পড়ুয়া আলেমদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী লেখা হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। কারণ সরকারি হিসেবে এর কোনো মান ছিল না। দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্সের সমমান প্রদানের সবচেয়ে বড় লাভ হলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মূল্যায়ন। স্বীকৃতি গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে শুরুর দিকে দায়িত্বশীল আলেমদের কিছু মতভিন্নতা থাকলেও বর্তমান রূপরেখায় সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তাই এখন দাওরায়ে হাদিসের পাশাপাশি নিচের জামাতগুলোরও স্তরবিন্যাস ও সিলেবাস প্রণয়ন জরুরি হয়ে উঠেছে। তাইসির জামাতকে পঞ্চম শ্রেণি, হেদায়াতুন্নাহু অষ্টম, শরহেবেকায়া এসএসসি- এভাবে নিচের দিকের স্বীকৃতির বিষয়টিও নিশ্চিত করতে পারলে সনদের মান ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে ২০১৩ সালে গঠিত কওমি কমিশনের সুপারিশমালাও কার্যকর হতে পারে। বিশ্বায়নের এ সময়ে কওমি ধারার শিক্ষায় ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সুন্দর সমন্বয় করতে হবে। কারণ আদর্শ ও দক্ষ জাতিগঠনে চাই বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মমুখী সর্বজনীন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা। কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতির মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হোক, এমনটিই প্রত্যাশা।

কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্য অধিকার পেয়েছে

মাওলানা জাওয়াদুল করিম কওমি মাদরাসায় পড়ুয়া সামাজিক উদ্যোক্তা। এই দেশ ও মাটির অনেক গভীরে প্রোথিত কওমির শিকড়। দেশের অন্য শিক্ষা ব্যবস্থার মতোই এটি স্বতন্ত্র একটি শিক্ষা ব্যবস্থা, দেশের বিশাল একটি অংশ এই শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বছরের পর বছর বিশাল এই শ্রেণি তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। লাখ লাখ ছাত্রের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি বা গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। দীর্ঘ সময় পর তাদের সেই ন্যায্য পাওনা তারা পেয়েছে, অধিকারবঞ্চিতরা তাদের স্বাধিকার ফিরে পেয়েছে। কওমির এই শিক্ষার্থীরা তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখে আসছে আগে থেকেই। রাষ্ট্রীয় সনদ বা স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে তাদের কেউ কেউ কওমির নিজস্ব পাঠ চুকিয়ে আলিয়া, স্কুল-কলেজ মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বরাবরের মতো মেধার স্বাক্ষর রেখে আসছে। অনেক প্রতিষ্ঠানও ভালো ফলাফলের কারণে কওমি ছাত্রদের নানা অফারে কাছে টানে। আলিয়া বা স্কুল-কলেজ হয়ে কওমির অনেক ছাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও মেধা তালিকার অগ্রভাগেই থাকত অধিকাংশ সময়। মাদরাসার ছাত্রদের প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈষম্যমূলক আচরণ না থাকলে হয়তো তাদের অগ্রযাত্রা আরো দ্বিগুণ হতো। নানামুখী মেধার অধিকারী বিশাল এই কওমির ছাত্রসমাজ তাদের মেধা বা প্রতিভা প্রকাশের মাধ্যম খুঁজে নিত ভিন্নধারার শিক্ষা ব্যবস্থায়, যা দুরূহ ছিল। কিন্তু কওমি সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির কারণে তাদের প্রতিভা ও মেধাকে আরো বেশি বিকশিত করতে পারবে নিজেদেরই শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে। স্বীকৃতির কারণে দেশ ও জাতির স্বার্থে তাদের মেধা ও প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ বেড়েছে বহুগুণে। নিজেকে সফলতার উচ্চতায় পৌঁছাতে তাদের স্বপ্নের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। দেশ ও জাতির কল্যাণে তাদের অগ্রগামী ভূমিকা রাখার সুযোগও বেড়েছে।

পরিবেশ পরিস্থিতির বিবেচনায় এ স্বীকৃতি একটি মাইলফলক

ইমামুদ্দীন ওবায়েদ শিক্ষার্থী, উচ্চতর আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্র। তিনি বলেন, সমাজে কওমি শিক্ষার অবদান উপলব্ধি করেই বর্তমান সরকার কওমি মাদরাসার শিক্ষা সনদের একটি মান নিশ্চিত করেছে, তাই সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন। স্বীকৃতি আমাদের আরো আগেই প্রয়োজন ছিল। স্বীকৃতি না থাকার কারণে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। অনেকেই আবার হতাশা ও হীনমন্যতায় ভুগেছিলেন। ২০১৭ সালে ভিজিট ভিসা নিয়ে আমি ভারতের উত্তর প্রদেশের লখনৌ শহরে (ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়) দারুল উলূম নদওয়াতুল ওলামায় আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অ্যাডমিশন নিই। অ্যাডমিশনে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তির কার্যাবলি সম্পন্ন করতে সক্ষম হই। কিন্তু স্টুডেন্ট ভিসা না থাকায় ভর্তির কাগজগুলো পূরণ করতে কষ্টকর হয়েছে। পরবর্তী মাস দুয়েক পরে স্টুডেন্ট ভিসা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশে আসি, ভিসার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করি; কিন্তু কোনোভাবে ভিসা পাইনি। এর মূল কারণ হলো আমাদের শিক্ষার রাষ্ট্রীয় কোনো সত্যায়ন বা মূল্যায়ন ছিল না। বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বে নিশ্চিন্তভাবে পড়াশোনার জন্য সরকারি স্বীকৃতির প্রয়োজন, স্বীকৃতি ছাড়া শিক্ষার্থীদের বাইরের দেশে পড়াশোনা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আমার মতো হয়তো অনেকেই বুকে স্বপ্ন নিয়ে ছোটাছুটি করছে দেশ ও দেশের বাইরে উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য, নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য। অবশেষে স্বপ্ন পূরণে হতাশ হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে এসব মেধাবী। তাই আশা করছি, সরকার স্বীকৃতি সংক্রান্ত বিষয়াদি দ্রুত বাস্তবায়ন করে মেধাবীদের পড়াশোনার ব্যাপারে গতিময়তা আনবে এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে আরো সচেষ্ট হবে।

এই স্বীকৃতির মাধ্যমে আশার খুব বেশি কিছু দেখতে পাচ্ছি না

বিথী তাবাচ্ছুম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী। তিনি বলেন, কওমি সনদের প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এই প্রজ্ঞাপন জারি হওয়াটাই যথেষ্ট নয়; বরং সেটা বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি। আমি কওমি মাদরাসায় যখন পড়া শেষ করে বের হয়েছি, তারপর আবার নতুন করে পড়া শুরু করেছি। সেখান থেকে আজ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। একটা পড়া শুধু আখিরাতের জন্য পড়েছি। আর একটা দুনিয়ার জন্য পড়ছি। এভাবে পড়া তো সবার পক্ষে সম্ভব নয়। দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্সের সমমান প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে এই মাস্টার্সের সার্টিফিকেট দিয়ে আমি অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছি কি-না? আসলে সরকার নির্বাচনের আগে তাদের কিছু ভোট বাড়ানোর জন্য এই প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। যদি সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা চাওয়া হয়, তাহলে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকার আধুনিক বিভিন্ন সাবজেক্ট ঢোকানোর চেষ্টা করবে। এটা করা হলে ধর্মীয় শিক্ষায় ব্যাঘাত ঘটবে। আসলে এই প্রজ্ঞাপন, এই স্বীকৃতির মাধ্যমে আশার খুব বেশি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads