• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

কোরআন বিস্ময়কর এক অলৌকিক শক্তি

  • প্রকাশিত ০২ নভেম্বর ২০২০

মুফতি মাহফুজুর রহমান হোসাইনী

 

 

 

মুজিযা হলো নবী-রাসূলগণের প্রতি আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত অলৌকিক বিষয়। মুজিযা  নবী-রাসূলগণের সাথেই বিশেষিত। নবুওয়াতের দাবির স্বপক্ষে আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে নবী-রাসূলদের বহু মুজিযা  দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও আল্লাহতায়ালা বহু মুজিযা  দিয়েছেন। তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও বিস্ময়কর মুজিযা  বা বিস্ময়কর অলৌকিক শক্তি হলো কুরআন। দুনিয়ার প্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে আরবি ভাষা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের আর্বিভাবকালে কাব্য ও সাহিত্য চর্চার দিক থেকে আরবরা ছিল শীর্ষস্থানীয়। আল্লাহতায়ালা একজন নিরক্ষর লোকের কাছে এমন উচ্চাঙ্গের গ্রন্থ নাযিল করলেন যার ভাষা ও ভাবের সুউচ্চ মান দর্শনে  আরবরা হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। ভাষার দিক থেকে কুরআনের মোকাবিলা করা যেমন আরবদের জন্য দুষ্কর ছিল, তেমনি ভাব ও বিষয়াবলির দিক দিয়েও অনুরূপ গ্রন্থ তৈরি করা তাদের জন্য ছিল অসম্ভব। এমনকী কিয়ামত পর্যন্ত এর মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভবপর হবে না। কুরআন রাসূলের অত্যাশ্চর্য মুজিযারূপে কিয়ামত পর্যন্ত অবিকল থাকবে। পৃথিবীর সব ধ্বংস হয়ে গেলেও কুরআন অক্ষুণ্ন থাকবে।

কুরআনে রয়েছে মানব জীবনের সব সমস্যার সমাধান। পৃথিবীকে আলোকিত করতে এই কুরআন নূর বা আলো হয়ে এসেছে। অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিকে সত্যিকার আলোর দিকে নিয়ে আসার জন্য কুরআন হলো নূর বা আলো। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও সুস্পষ্ট গ্রন্থ এসেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে। তিনি নিজ ইচ্ছায় তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন এবং তাদেরকে সরল পথের দিকে হিদায়েত দেন’ (সূরা মায়িদাহ : ১৫-১৬)। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনসহ সব বিষয় কীভাবে পরিচালিত হবে, তার প্রতিটি বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আপনার নিকট কিতাব (কুরআন) নাজিল করেছি। এটি এমন যে তা সবকিছুর সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী আর এটা হেদায়েত, রহমত ও মুসলমানদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ’ (সূরা নাহল : ৮৯)।

কুরআন হলো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ। শুধু মুসলিম নয় বরং পৃথিবীর সব ধর্মের মনিষীগণ একবাক্যে স্বীকৃতি দিয়েছে- ‘কুরআন নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ’। এই কুরআনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। পৃথিবীর মাঝে বিদ্যমান সব গ্রন্থ মানুষের রচনা। আর সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালার কালাম হলো এই কুরআন। তিনি নিজেই তা রচনা করেছেন। অবতীর্ণ করেছেন। পৃথিবীতে মানুষের রচিত প্রতিটি গ্রন্থের শুরুতে ভুল থাকার সম্ভাবনা উল্লেখ করে থাকেন লেখকগণ। কিন্তু কুরআন এর পুরোই ব্যতিক্রম। কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যার ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা নিজেই ১০০% নির্ভুলের গ্যারান্টি দিয়েছেন। তিনি বলেন, এটা সেই কিতাব যাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ মাত্রও নেই”(সূরা : বাকারাহ-২)। কুরআনের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা এই নিঃসন্দেহের ঘোষণা দিয়েই থেমে থাকেন নি, বরং এর সাথে সাথে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে কুরআন অস্বীকারকারীদেরকে আল্লাহতায়ালা চ্যালেঞ্জ করেছেন। আল্লাহ পাক বলেন, (হে নবী) আপনি বলে দিন, সব মানুষ ও জ্বিন মিলে যদি এই কোরআনের অনুরূপ রচনা করার জন্যে একত্র হয় এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়, তবুও তারা কখনো এর অনুরূপ রচনা করতে পারবে না”(সূরা : বনী ইসরাঈল-৮৮)। এখানে আল্লাহতায়ালা বিরোধীদের একটি কুরআন রচনার চ্যালেঞ্জ করেছেন। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা কুরআনের ন্যায় মাত্র দশটি সূরা রচনা করার চ্যালেঞ্জ করেন। আল্লাহপাক বলেন, (হে নবী) তারা কি বলে কোরআন আপনি তৈরি করেছেন? আপনি বলুন, তবে তোমরাও অনুরূপ দশটি সূরা তৈরি করে নিয়ে আসো এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার ডেকে নাও, যদি তোমাদের কথা সত্য হয়ে থাকে (সূরা : হুদ-১৩)।

অন্যত্র আল্লাহতায়ালা আরো কঠিন চ্যালেঞ্জ করেছেন। কুরআনের ন্যায় একটি সূরা বা ছোট্ট একটি সূরা পারলে রচনা করে নিয়ে এসো। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, কোরআন এমন জিনিস নয় যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কেউ তা বানিয়ে ফেলবে। তবে এটি পূর্ববর্তী কালামের সত্যায়ন করে এবং সে সব বিষয়ের বিশ্লেষণ করে যা তোমার প্রতি দেওয়া হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই যে, এটা বিশ্বপালনকর্তার পক্ষ থেকে। মানুষ কি বলে যে, এটি আপনি বানিয়েছেন? (হে নবী) আপনি বলে দিন, তাহলে তোমরা বানিয়ে নিয়ে এসো এর মতো একটিই সূরা। আর আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে সক্ষম হও ডেকে নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক” (সূরা : ইউনুস ৩৭-৩৮)। আল্লাহ পাক আরো বলেন, এতদসম্পর্কে যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মতো একটি (ছোট্ট) সূরা রচনা করে নিয়ে আসো। তোমাদের সেসব সাহায্যকারীদেরকে সঙ্গে নাও, এক আল্লাহকে ছাড়া। যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো। আর যদি তা না পার, অবশ্য তা তোমরা কখনোই পারবে না। তাহলে সে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করো, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর। যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফেরদের জন্য (সূরা : বাকারাহ-২৩-২৪)।

আল্লাহপাক কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ করেছেন এবং তিনিই কুরআনের প্রথম শিক্ষক। স্বয়ং নিজেই কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। ইরশাদ হয়েছে, করুণাময় আল্লাহ! তিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন (সূরা : রহমান : ১-২)। আল্লাহতায়ালা হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন সাহাবায়ে কিরামদের। সাহাবায়ে কিরাম (রা.) তাবেয়ীদের, তাবেয়ীরা তাবে-তাবেয়ীদের, তাবে-তাবেয়ীরা পরবর্তীদের এই কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। এভাবে এক সিনা থেকে আরেক সিনা করে পরিপূর্ণ অক্ষুণ্ন অবস্থায় আজ আমাদের নিকট কুরআন এসেছে। কিয়ামত পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে। কুরআন শিক্ষায় এই শিক্ষকের পদ্ধতি আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই সাব্যস্ত। তাই কুরআনের জন্য শিক্ষক অত্যাবশ্যক। শিক্ষক ছাড়া কুরআন শিখা ও বোঝা কখনো সম্ভবপর নয়। মেধার প্রখরতার দরুন কেউ যদি নিজে নিজেই অধ্যয়ন করে কুরআন বা ইসলামের জ্ঞান অর্জন করতে চায় তবে তা কস্মিনকালেও সঠিক হবে না।

যুগ যুগ ধরে এখন পর্যন্ত নির্ভুলভাবে অক্ষুণ্ন রয়েছে এই কুরআন এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। তবে ইতিহাসে দেখা যায়, প্রতি শতাব্দীতেই কুরআনের বিরুদ্ধে কিছু কুচক্রী মহল মাথাচাড়া দেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছে। কুরআনকে নিঃশেষ করার জন্য তারা চতুর্দিক ষড়যন্ত্র জারি রেখেছে। কুরআনকে বিকৃতি, কুরআনে ভুল সংযোজন, কুরআনের শিক্ষা বন্ধসহ কুরআনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের চক্রান্ত চালিয়েছে। কিন্তু কুরআনের বিরুদ্ধে তাদের বিশাল চক্রান্তের সামান্যতমও ফলপ্রসূ হয়নি; বরং দুনিয়ার বুকে তারা অপমানিত অপদস্থ হয়ে বিনাশ হয়েছে। ভবিষ্যতেও যে এই কুরআনের বিরুদ্ধে কথা তুলবে তার ধ্বংস অনিবার্য। কেননা, আল্লাহতায়ালা নিজেই এই কুরআনকে হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন। আল্লাহ্ ঘোষণা করেন, আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষণ করবো (সূরা হিজর : ৯)।

 

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন, মোমেনশাহী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads