• সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)

  • প্রকাশিত ০৩ নভেম্বর ২০২০

মুফতি নাঈম কাসেমী

 

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ ধরায় অগণিত মহান ব্যক্তি পাঠিয়েছেন মানবজাতির হেদায়েতের জন্য। হজরত আদম (আ.) থেকে নিয়ে আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগপর্যন্ত লক্ষাধিক নবী রাসুল প্রেরণ করেছেন। সকলেই ছিলেন নির্ধারিত কোনো এলাকা বা জাতির নিকট প্রেরিত। আর আমাদের নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, সর্বশেষ নবী, সর্বোত্তম নবী। যিনি সমস্ত নবীদেরও নবী। এই মহামানবকে আল্লাহ তাআলা পাঠিয়েছেন সমগ্র বিশ্ববাসীর নবী হিসেবে। বিশ্ববাসীর শান্তির দূত বানিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি হলেন সামগ্রিক নবী, সকলের নবী। তাই হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজের সারাটা জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। বিশ্ববাসীর সামনে যেই ফরমুলা রেখে গেছেন, তা যদি সকলেই অনুসরণ করে তাহলে পৃথিবীতে কোন অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি হবে না। আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে বলেন, রাসুলের মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ”। এই আদর্শে যদি আমরা আদর্শিত হতে পারি, তাহলে দুনিয়া ও আখিরাতে আমরা কামিয়াব। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তম আদর্শ লিখে বা বলে সারা জীবনেও শেষ করা সম্ভব নয়। তথাপিও কিঞ্চিত লেখার চেষ্টা করেছি।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিটি মানুষের হক যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্বামী-স্ত্রীর হক, সন্তান-পিতামাতার হক, রাজা-প্রজার হক, ধনী-গরিবের, এতিমের হকসহ সবার হকের ব্যাপারে রয়েছে নবীজির আদর্শ। ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবনের প্রতিটি বিষয়েই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ।

* প্রতিটি মানুষের পরস্পরের হকের ব্যাপারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ : হাদিসে পাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন “ প্রকৃত মুসলমান ওই ব্যক্তি যার হাত ও মুখ থেকে অপর ভাই নিরাপদে থাকে।

অন্য এক হাদিসে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় কোনো মানুষের বিপদ দূর করবে, আল্লাহতায়ালা আখেরাতে ওই ব্যক্তির বিপদ দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি দুনিয়ায় কারো কোনো বিষয় সহজ করে দেবে, আল্লাহতায়ালা তার দুনিয়া ও আখিরাতের সব বিষয় সহজ করে দেবেন। আল্লাহতায়ালা ওই বান্দাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সহযোগিতা করবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার ভাইয়ের সহযোগিতা করবে।

আমাদের প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ হলো, কোনো মানুষের ক্ষতি না করা। সব মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করা। চাই সে মুসলমান হক বা হিন্দু হক বা ইহুদি হক বা খ্রিস্টান। মানুষ যে কোনো ধর্মের অনুসারী হোক না কেন, তার সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। মানুষের মনে আঘাত পায় এমন কোনো কথা বা কাজ করা যাবে না। শুধু মানুষ নয়, কোনো পশুকেও অনর্থক কষ্ট দেয়া যাবে না, মারা যাবে না। এটাই আমার নবীর আদর্শ ও শিক্ষা।

* স্বামী-স্ত্রীর হকের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ : স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন এক পবিত্র বন্ধন। উভয়ে যদি একে অপরের হক যথাযথভাবে আদায় করে তাহলে প্রতিটি সংসার হবে সুখের সংসার। স্ত্রীদের লক্ষ করে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন “আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে যদি সেজদা করার অনুমতি থাকত, তাহলে আমি সব স্ত্রীকে আদেশ করতাম যে তোমরা সবাই নিজেদের স্বামীকে সেজদা করো।

অন্য এক হাদিসে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কোনো নারী যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, রমজানের রোজা রাখে, পর্দামতো চলে এবং স্বামীর অনুগত থাকে, তাহলে এমন স্ত্রীর জন্য জান্নাতের সমস্ত দরজা খোলা থাকবে, সে যে কোন দরজা দিয়েই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। একজন স্ত্রীর জন্য তার স্বামীর অনুগত থাকা, স্বামীর কথা মানা অনেক জরুরি বিষয়। স্বামী যতক্ষণ পর্যন্ত গোনাহের আদেশ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার অনুগত থাকা আবশ্যক। অন্যদিকে স্বামীদের লক্ষ করে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন। ‘তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম আর আমি আমার স্ত্রীর কাছে উত্তম। অন্যত্র হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দেয়া সদকা, স্ত্রীর সাথে মুচকি হেসে কথা বলা সদকা। তাই স্ত্রীর সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করা আমাদের নবীর সুন্নত। অনেক মানুষ বাহিরে সবার কাছে ভালো, কিন্তু ঘরে এসে স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করে, এটা ঠিক নয়। স্ত্রীর হক সঠিকভাবে আদায় করতে হবে। উভয়ে যদি একে অপরের হক সঠিকভাবে আদায় করে, তাহলে আমাদের সমাজব্যবস্থা অনেক সুন্দর হয়ে যাবে। পরকীয়ার গ্লানি সমাজ থেকে মুছে যাবে।

* এতিম, মিসকিন, গরিব অসহায়দের হকের ক্ষেত্রে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি এবং এতিমের লালন-পালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব। এটা বলে তিনি (সা.) শাহাদাত আঙুল ও মধ্যমা আঙুলের দিকে ইশারা করেছেন। অন্যত্র হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ওই ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুমিন নয়, যে পরিতৃপ্ত হয়ে রাতে ঘুমায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থেকে যায়। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা যখন গোস্ত পাকাও তখন এর ঝুল বাড়িয়ে দাও এবং গরিব প্রতিবেশীর বাড়িতে একটু পাঠিয়ে দাও। তাই এতিম, গরিব-অসহায়দের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ হলো, সাধ্য অনুযায়ী তাদের সেবা করা, তাদের প্রতি খেয়াল রাখা। খাবার দাবার, পোশাক, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ প্রতিটি বিষয়ে তাদেরকে সহযোগিতা করা। তাদের সাথে মোহাব্বতের সম্পর্ক রাখা। কেননা নবীজি তাদেরকে মোহাব্বত করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে আল্লাহ! আপনি আমাকে মিসকিন অবস্থায় জীবিত রাখেন, মিসকিন অবস্থায় মৃত্যু দেন এবং হাশরের ময়দানে মিসকিনদের সাথে উঠান”। তাই এতিম, গরিব, মিসকিন-অসহায়দেরকে দূরে ঠেলে দেয়া যাবে না। বরং তাদেরকে বুকে টেনে নিতে হবে।

* দিনমজুর ও কাজের লোকের হক প্রতিষ্ঠায় হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ : মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন “তোমরা শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দাও। অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের খাদেম বা কাজের লোক যখন তোমাদের জন্য কষ্ট করে কিছু খাবার তৈরি করে তখন তাদেরকে তোমাদের সাথে বসিয়ে খাবার খায়িয়ে দাও অথবা তাদের হাতে কিছু দিয়ে দাও। তোমরা যা খাও তাদেরেক তাই খাইতে দাও।

* নারী অধিকার বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ : হাদিসে পাকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যদি কোনো পিতা তিন অথবা দুজন কন্যাসন্তানকে সঠিকভাবে লালন-পালন করে এবং তাদের হক সঠিকভাবে আদায় করে তাহলে সেই পিতার জন্য রয়েছে জান্নাত। ঠিক তেমনিভাবে কোনো ভাই যদি তার তিন বা দুজন বোনকে এভাবে লালন পালন করে তাহলে ওই ভাইয়ের জন্যও রয়েছে জান্নাত।

অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কন্যাসন্তান লালন-পালন করতে গিয়ে যদি কোন ব্যক্তি কষ্ট করে এবং ধৈর্য ধারণ করে তাহলে এই কষ্ট তার জন্য জাহান্নাম থেকে বাচার পর্দা হবে। একজন নারীর জীবনের চারটি ধাপ। হয়ত সে মেয়ে, বোন, স্ত্রী, কিংবা মা। যখন সে মেয়ে থাকে তখন তার বাবার দায়িত্ব হলো তার সমস্ত খরচ বহন করা, ভরণ-পোষণ দেওয়া। মেয়ে হিসেবে এটা পাওয়া তার অধিকার।

আর যদি কারো বাবা পরিবর্তে ভাই থাকে তাহলে খরচাদি ও ভরণ-পোশনের দায়িত্ব ভায়ের। এটা বোনের অধিকার, যা তাকে ইসলাম দিয়েছে। এটাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ। এই মেয়েটা যখন কারো স্ত্রী হয় তখন স্বামীর দায়িত্ব ভরণ-পোষণের। এটা স্ত্রীর অধিকার। এই নারী যখন কারো মা হয়, তখন তার সন্তানের দায়িত্ব হল মায়ের খেদমত করা, খরচ বহন করা, মায়ের সমস্ত বিষয়ে খেয়াল রাখা।

ইসলাম নারীকে অধিকার দিয়েছে বেশি। আর পুরুষকে দায়িত্ব দিয়েছে বেশি। কিন্তু বর্তমান সমাজের অনেক মুসলিম মা বোনেরা এটা বুঝেনা বা বুঝতে চায়না। এমনিভাবে মানবজীবনের প্রতিটা বিষয়েই হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ রয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শিক সৈনিক হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন।

 

লেখক : পরিচালক, জামিয়া শায়খ আরশাদ মাদানী, বাংলাদেশ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads