• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

উম্মত-দরদি বিশ্বনবী (সা.)

  • প্রকাশিত ০৭ নভেম্বর ২০২০

মুফতি শরীফুল ইসলাম

 

 

আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে প্রায় লক্ষাধিক নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। নবীদের কাজ ছিল যারা সহজ-সরল, সঠিক পথ ভুলে বিপথে চলা শুরু করেছিল, আল্লাহর পথ ভুলে গিয়ে গাইরুল্লার পথে পরিচালিত হচ্ছিল, সেই পথভোলা মানুষগুলোকে সঠিক পথের দিশা দেওয়া। প্রত্যেক যুগে তখনকার সময়ের নবী-রাসুলকে সর্বোচ্চ ভালোবাসা ছিল পরিপূর্ণ ঈমানের দাবি এবং শর্ত। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের উম্মাতে মুহাম্মদীর ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজের জান-মাল, সন্তান-সন্তুতি, বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন, সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসতে হবে। এ ব্যাপারে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমাদের কাছে তোমাদের সন্তান, পিতা-মাতা এবং সব মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হবো।’ (বুখারি, মুসলিম)। অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমি তোমাদের কাছে তোমাদের পিতৃতুল্য।’ উল্লিখিত হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আমাদের পিতার মতো। পিতা যেমন সন্তানের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তিত থাকেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাঁর উম্মতের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তিত থাকতেন।

পূর্ববর্তী উম্মতগণ নবীদেরকে ভালোবেসেছে। নবীগণ উম্মতদেরকে ভালোবাসেনি বিষয়টি এমন নয়। বরং প্রত্যেক নবী তাঁর উম্মতদেরকেও অনেক ভালোবেসেছেন। উম্মতের ভালো-মন্দ নিয়ে তারা সবসময়ই উদ্বিগ্ন থাকতেন। উম্মতের বিপদাপদে পাশে দাঁড়াতেন। আর আমাদের নবী হলেন হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আমরা তাঁর উম্মত। আমরা হজরত  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর নবী ও রাসুল বলে বিশ্বাস করি এবং স্বীকার করি। আমাদের প্রিয়নবী হজরত  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের সব বিষয় খেয়াল রাখতেন। তিনি (সা.) উম্মতের মুক্তির জন্য বিনিদ্র রজনীতে সিজদায় ডুকরে কাঁদতেন। আমাদেরকে সিরাতে মুস্তাকিমের দিশা দেওয়ার জন্য তায়েফে পাথরের আঘাতে নিজের শরীর মোবারক থেকে রক্ত জড়িয়েছেন। পরক্ষণেই জিবরাঈল আমীন যখন নবীজির ওপর হামলাকারীদের শান্তি দিতে অনুমতি চাইলেন, তখন তিনি (সা.) উম্মতের ধ্বংস না চেয়ে তাদের জন্য মহান মালিকের দরবারে হেদায়াতের দোয়া করেন। যেই আবু জাহেল, ওতবা, শায়বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মারার জন্য ফন্দি আঁটতো, সেই আবু জাহেলদের  হেদায়াতের জন্য বারবার দিনের দাওয়াত নিয়ে যেতেন। শত অবজ্ঞা আর যন্ত্রণা পেয়েও ক্ষান্ত হননি তাঁর মিশন থেকে। এক কথায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তা-চেতনায় সবসময় উম্মতের খায়েরের ফিকির থাকত। তাইতো আমরা দেখতে পাই উম্মত যখন খন্দকের যুদ্ধে না খেয়ে থেকেছে, তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও না খেয়ে থেকেছেন। উম্মত ক্ষুধার তাড়নায় পেটে একটি পাথর বেঁধেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পেটে দুটি পাথর বেঁধেছেন। উম্মতকে একা যুদ্ধে পাঠাননি বরং নিজেও তাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন।

এছাড়াও উম্মতদের ক্ষতিকর বিষয়সমূহ, যেমন : বিপথগামিতা, ত্রুটিযুক্ত আমল, পার্থিব জীবন সঠিকভাবে পরিচালনা করতে না পারা, পরকালীন সব ক্ষতিকর ও অনিষ্ট বিষয় থেকে বাঁচানোর জন্য বিশ্বভূষণে তাশরিফ এনেছেন বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত আলোর দিশারী হজরত  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদের মধ্যে থেকে এক মহামর্যাদাবান রাসুল, যিনি তোমাদের ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদগামী হওয়ার বিষয়ে খুবই উদ্বিগ্ন এবং সৎকর্মের প্রতি ধাবমান হওয়ার বড়ই আশাবাদী। তিনি মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল দয়ালু।’ (সুরা তাওবা-২২৮)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য অবিরাম চেষ্টা করছেন। কোন কাজ করলে নেক আমল হয় এবং কোনটি করলে নাফরমানি হয়, সে সম্পর্কে উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। উম্মতের ইহকালীন ও পরকালীন সব সমস্যা ও সব ধরনের ক্ষতি থেকে বাঁচাতে সবসময় চেষ্টা করেছেন। নিজের সন্তানের মতো করে হাতে কলমে সবকিছু শিক্ষা দিয়েছেন। বিশ্বখ্যাত তাফসিরে ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা কিছু বস্তুকে হারাম করেছেন, অথচ তিনি এটাও অবগত আছেন-তোমাদের অনেকেই তাতে লিপ্ত হবে। আর আমি তোমাদের তা থেকে হেফাজত করছি। অথচ তোমরা পতঙ্গের মতো সেই আগুনে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হচ্ছো।’ উম্মতের সবচেয়ে বড় সমস্যা, মহাক্ষতি হলো দুনিয়াতে ঈমানহারা হওয়া এবং এরই পরিণতিতে আখিরাতে স্থায়ীভাবে জাহান্নামি হওয়া। এধরনের ক্ষতি থেকে উম্মতকে রক্ষা করার জন্য প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশি চিন্তিত থাকতেন। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবসময় ভাবতেন কীভাবে মানুষদেরকে অন্যায়-অবিচারের কাজ থেকে বিরত রাখা যায়। নবীজি নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলেন তার উম্মতের জন্য। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওই সব লোক ঈমান আনছে না, এ কারণে কি তাদের চিন্তায় ও পেরেশানিতে আপনি নিজেকে শেষ করে  দেবেন?’ (সুরা শুরা-৩)

বদরের যুদ্ধে ৩১৩ জন সাহাবী যখন যুদ্ধ করতে গেলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান প্রভুর দরবারে তার সাহাবীদের জন্য দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! এই সাহাবীরা আমার অনেক আদরের, এই সাহাবীদের তুমি মেরো না, এদের তুমি রক্ষা কর। উহুদের যুদ্ধে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাঁত ভেঙেছে, মাথা ফেটেছে। খন্দকের যুদ্ধে মাটি বহন করতে করতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীরে দাগ হয়ে গিয়েছে। এ সবই ছিল উম্মতের প্রতি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মায়া। মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নবী মোহাম্মদ (সা.) মুমিনদের ব্যাপারে এতটুকু স্নেহ-মমতা রাখেন যতটুকু মুমিনগণ নিজেরা নিজেদের ব্যাপারেও স্নেহ-মমতা রাখেন না। অর্থাৎ মানুষ নিজেকে যতটুকু মহব্বত করে নবী (সা.) তার থেকে বেশি সেই উম্মতকে মহব্বত করেন।’ (সুরা আহযাব-৬)

রহমতের নবী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গুনাহগার উম্মতের প্রতি বিশেষ স্নেহশীল ছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক নবী-রাসুলকে কবুলের গ্যারান্টি দিয়ে একটি দোয়া করার অনুমতি মহান আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন। প্রত্যেক নবী ও রাসুল মহান আল্লাহর গ্যারান্টি দেওয়া কবুলিয়াতের দোয়াটি দুনিয়াতেই করে ফেলেছেন। আর মহান আল্লাহ তাদের সেই দোয়াটি কবুল করেছেন। কিন্তু আমি দোয়াটি আখিরাতে আমার গুনাহগার উম্মতের নাজাতের জন্য সংরক্ষণ করে রেখেছি।’ (মুসলিম শরিফ)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই দোয়াটি হলো-রোজ হাশরে গোনাহগার উম্মতের জন্য শাফায়াতের দোয়া। কিয়ামতের দিন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে যখন নবীগণ পর্যন্ত নিজের চিন্তায় পেরেশান থাকবেন, তখন আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচারকার্য আরম্ভ করা ও গোনাহগার উম্মতের জন্য আল্লাহর দরবারে সিজদায় পড়ে দোয়া করবেন এবং নবীজির দোয়া কবুল করা হবে। কিয়ামতের দিন সূর্যের তাপে যখন পিপাসায় বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হবে, তখন আমাদের দয়ার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাউজে কাওছার থেকে তার উম্মতদেরকে পানি পান করাবেন।

কুরআন-হাদিস ও নবীজির বাস্তব জীবনে অনেক এমন নজির আছে, যা প্রমাণ করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে অনেক ভালোবাসতেন। ভালোবাসার প্রতিদান শুধু ভালোবাসার মাধ্যমেই দেওয়া যায়। তাই আমাদের উচিৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা। তাকে ভালোবাসতে হলে তাঁর অনুসরণ করতে হবে। তাঁর দেখানো পথে চলতে হবে। মৌখিক ভালোবাসা কোনো কাজে আসবে না। তাই আমরা যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের পাবন্দ হতে পারি সেটাই হবে তাঁর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তাই এমন কোনো কাজ না করা যার দ্বারা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসার অসম্মান হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : পরিচালক, হালিমাতুস সাদিয়া মহিলা মাদরাসা, ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads