• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

মহানবী (সা.)-এর একাধিক বিবাহ: একটি যৌক্তিক বিশ্লেষণ

  • প্রকাশিত ০৮ নভেম্বর ২০২০

মুফতি নাঈম কাসেমী

 

 

একজন পুরুষের জন্যে একাধিক স্ত্রী রাখা ইসলামের পূর্বে প্রায় দুনিয়ার সব ধর্মেই বৈধ ছিল। হিন্দুস্থান, ইরান, মিসর, বাবেল, অস্ট্রিয়া ইত্যাদি সব দেশেই এই একাধিক বিবাহের প্রথা চালু ছিল। এক প্রসিদ্ধ ঈসায়ি পাদ্রী মিস্টার ডিওন পুর্ট একাধিক বিবাহের সমর্থনে ইনজিল শরিফ থেকে অনেক প্রমাণ দেওয়ার পর লিখেন-এসব দলিল দ্বারা এটাই বুঝে আসে, একাধিক বিবাহ শুধু পছন্দনীয় নয়, বরং এর মাঝে আল্লাহতায়ালা বিশেষ বরকত রেখেছেন। এমনিভাবে ঈসায়ি পাদ্রী ফাক্স জান মিল্টন, ও এজক টিলার পরিপূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। এমনকী ইসলামের পূর্বে একাধিক বিবাহের কোনো সীমা নির্ধারিত ছিল না। একেক জনের অধীনে শত শত স্ত্রীও ছিল। বর্তমান বাইবেলের মাধ্যম জানা যায়-হযরত সুলায়মান (আ.)-এর সাতশ স্ত্রী ছিল। হযরত দাউদ (আ.)-এর ৯৯ স্ত্রী ছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর তিনজন স্ত্রী, ইয়াকুব (আ.) ও মুসা (আ.)-এর চারজন করে স্ত্রী ছিল। আর ঈসায়ি পাদ্রীরাও একাধিক বিবাহে অভ্যস্ত ছিল। কুস্তানতিনিয়ার বাদশারা এবং তাদের অনুসারীরা একাধিক বিবাহে অভ্যস্ত ছিল। হিন্দুদের প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু মানুজিও একাধিক বিবাহকে সমর্থন দিয়েছে। হিন্দুদের অন্যতম বড় ধর্মগুরু শ্রীকৃষ্ণও একাধিক বিবাহ করেছে। (ধর্মশাস্ত্র ৯/১৮৩)।

ইসলামের প্রাথমিক যুগেও এই প্রথা ছিল। কোনো কোনো সাহাবায়ে কেরামের অধীনে দশজন স্ত্রীও ছিল। কিন্তু যখন একাধিক বিবাহের দ্বারা স্ত্রীদের হক নষ্ট হতে লাগল, তখন আল্লাহরাব্বুল আলামীন এই একাধিক বিবাহের প্রথাকে সীমিত করে শর্তসাপেক্ষে একত্রে চারজন স্ত্রী রাখার বিধান দিয়েছেন। সব স্ত্রীর হক যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। যদি কোনো স্ত্রীর হক আদায় করতে না পারে অথবা কারো প্রতি জুলুম হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে একের অধিক বিবাহ করা সম্পূর্ণভাবে নিষেধ। এই হুকুম আসার পর যেসব সাহাবায়ে কেরামের অধীনে একাধিক স্ত্রী ছিল, তারা চারজনকে রেখে বাকি সবাইকে তালাক দিয়ে দিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, যখন হযরত গাইলান (রা.) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন, তখন তাঁর অধীনে দশজন স্ত্রী ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করলেন তুমি চারজনকে রেখে বাকিদেরকে তালাক দিয়ে দাও। হযরত নাওফল (রা.)-এর কাছে পাঁচজন স্ত্রী ছিল, নবীজি একজনকে তালাক দেওয়ার আদেশ দিলেন। (তাফসিরে কাবীর)। স্বাভাবিকভাবে এই নিয়ম অনুযায়ী হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীরাও চারের অধিক না থাকার কথা। কিন্তু এখানে কয়েকটা বিশেষ কারণে আল্লাহরাব্বুল আলামিন নবীজির জন্য চারের অধিক স্ত্রী রাখাকে হালাল, বৈধ ও জায়েজ রেখেছেন।

প্রথমত : হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীরা অন্য মহিলাদের মতো নন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন“‘হে নবীর স্ত্রীগণ তোমরা অন্য সব মহিলাদের মতো নও।’ আর নবীজির স্ত্রীরা হলেন উম্মাহাতুল মুমিনীন  তথা, সব উম্মতের মা। নবীজির পর তাঁরা অন্য কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবেন না। অন্য কোনো পুরুষের জন্যও তাঁদেরকে বিবাহ করা নিষেধ। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী নবীজিও যদি চারজনকে রেখে বাকিদের তালাক দিয়ে দিতেন তাহলে এটা বড় জুলুম হতো। কারণ, তারা সারা জীবনের জন্য একা হয়ে যেত। অন্য কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতো না। একদিকে মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মতো এক মহান ব্যক্তি থেকে বিচ্ছেদ হয়ে যেতো। (যার সংস্রব সব নারী দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নেয়ামত মনে করতো)। অপর দিকে অন্য কারো সাথে এই দুঃখী জীবন পার করারও অনুমতি ছিল না। বিশেষভাবে যাদেরকে নবীজি শুধু এই জন্য বিয়ে করেছিলেন যে, তাদের স্বামী শহীদ হয়ে গিয়েছিল। তাদের কষ্ট দূর করার জন্যই তাদেরকে বিয়ে করেছিলেন। এখন যদি তালাক দেওয়া হয়, তাহলে আরো অনেক বড় কষ্টের কারণ হয়ে যেতো। এ জন্যই আল্লাহতায়ালার হুকুম হলো, চারের অধিক স্ত্রী রাখা একমাত্র নবীজির বৈশিষ্ট্য। অন্য কারো জন্য চারের অধিক স্ত্রী একসাথে রাখার অনুমতি নাই।

দ্বিতীয়ত : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পারিবারিক জীবন হলো সমগ্র উম্মতের জন্য দিন ও দুনিয়ার আদর্শ। অনেক এমন মাসয়ালা আছে যেগুলো নবীজির স্ত্রীদের ছাড়া জানাটা অসম্ভব প্রায়। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক আচার-আচরণ, অভ্যাস, আমলের সাক্ষী হলেন এই সম্মানিতা মায়েরা। অনেক বিষয় এমন আছে যদি তাঁরা বর্ণনা না করতেন তাহলে উম্মতের কাছে অজানাই থেকে যেত। ইলমের বড় একটা অংশ এই উম্মাহাতুল মুমিনীনদের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কখনো কখনো কোনো মাসায়ালার সমাধানের জন্য তাঁদের শরণাপন্ন হয়েছেন।  মানবজাতির  দিনি-দুনিয়াবি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সম্পৃক্ততা তাঁদের সাথে ছিল। এই বিবেচনায় দশ-এগারোজন স্ত্রীও অনেক কম। কারণ, ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধান দুনিয়ার মানুষের কাছে তাঁরা পৌঁছে দিয়েছেন। যেগুলো তাদেরকে ছাড়া জানা অসম্ভব ছিল প্রায়।

এই বিষয়গুলো সামনে থাকার পরেও, সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ কি একথা বলতে পারবে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাহেশাতে নাফসানির তাড়নায় একাধিক বিবাহ করেছেন? এরপরেও যারা না জানার কারণে এমনটি বলতে চায়, তাদের উচিত বিষয়টা মনে রাখা-আরবের কাফেররা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতায় লিপ্ত ছিল। বিভিন্ন ধরনের অপবাদ দিয়েছে। হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে। মিথ্যাবাদী বলেছে। পাগল বলেছে। এই নববী সূর্যের গায়ে দাগ লাগানোর জন্য সব ধরনের ষড়যন্ত্র করে অবশেষে নিজেরাই লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছে। কিন্তু কোনো কাফের কি কখনো খাহেশাতে নাফসানি অথবা নারী বিষয়ে কোনো অপবাদ দিয়েছে? না, কক্ষনো না। ইতিহাস সাক্ষী-নবীজিকে এমন অপবাদ দেওয়ার দুঃসাহস তারা দেখাতে পরেনি। এখানে এসে স্বয়ং অপবাদেরও পা পিছলে গেছে। আর যদি কাফেররা সামান্য পরিমাণও সুযোগ পেতো তাহলে এটাকে আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দুনিয়াবাসীর সামনে পেশ করত। কিন্তু তারা এত বোকা ছিল না যে বাস্তবতার অস্বীকার করে নিজেদের অবস্থান ক্ষুণ্ন করবে। কেননা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্পূর্ণ জীবন মক্কাবাসীর সামনেই ছিল। তারা তো স্বচক্ষে দেখেছে-যৌবনকালের বড় একটা অংশ শুধু একাকিত্ব ও মাওলাপাকের ধ্যানমগ্ন থেকেই কাটিয়ে দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। অতঃপর যখন পবিত্র বয়স পঁচিশ বছর হলো, তখন খাদিজা (রা.)-এর কাছ থেকে বিবাহের প্রস্তাব আসে। যিনি জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করে বার্ধক্যের প্রহর গুনছিলেন। চল্লিশ বছর বয়স ছিল তাঁর। ইতোপূর্বে দুই স্বামীর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন তিনি। দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জননী। তথাপি তিনি এত ভাগ্যবতী ছিলেন যে নববী দরবার থেকে তার আবেদন ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। জীবনের অধিকাংশ সময় তাঁকে সাথে নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাও আবার মাসের পর মাস হেরাগুহার কণ্টকাকীর্ণ অবস্থায় রবের ইবাদতে কাটিয়ে দিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সব সন্তান হযরত খাদিজা (রা.) থেকেই জন্ম গ্রহণ করেছেন। আর খাদিজা (রা.)-এর জীবদ্দশায় অন্য কাউকে বিবাহ করেন নাই। যখন খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেছেন তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স ছিল পঞ্চাশের ওপরে। এই বয়সে এসে দিনি বিশেষ প্রয়োজনে এক এক করে দশজন স্ত্রী একত্রিত হয়ে যায়। যাদের সবাই (শুধু আয়েশা (রা.) ব্যতীত) ছিলেন বিধবা এবং অনেকে এক/দুই সন্তানের জননী। এই অবস্থাগুলো জানার পরও মনে হয় না কোনো বিবেকবান মানুষ এই কথা বলার সাহস করবে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাহেশাতে নাফসানির জন্য একাধিক বিবাহ করেছেন। তাছাড়া যেখানে আরববাসীরা তাদের সবচেয়ে সুন্দরী-রূপসী নারীদেরকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পায়ের কাছে এনে দিতে প্রস্তুত ছিল। এরপরেও তিনি বয়স্কা ও বিধবা নারীদেরকে প্রাধান্য দিয়ে পুরো জীবন তাদেরকে নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন। অথচ তখন অনেক কুমারি মেয়েরা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য নিজেদের জান কুরবান করে দিতে প্রস্তুত ছিল। এই অল্প লেখায় আর বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। সর্বোপরি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একাধিক বিবাহ দিন ইসলামের স্বার্থে ও উম্মতের কল্যাণেই আল্লাহতায়ালা বৈধ রেখেছেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

 

লেখক : পরিচালক, জামিয়া শায়খ আরশাদ মাদানী, বাংলাদেশ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads