• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

ইমাম ইবনে সালাহ : হাদিসে নববীর একনিষ্ঠ রাহবার

  • প্রকাশিত ০৮ নভেম্বর ২০২০

মুজীব রাহমান

 

 

ইমাম ইবনে সালাহর পূর্ণ নাম তাকী উদ্দীন ইবনে আবু নাসর। তিনি ৫৭৭ হিজরি  মোতাবেক ১১৮১ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের ইরবিল শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার উপাধি ছিল আস-সালাহ। এ জন্য তিনি ইবনে সালাহ নামে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁকে শৈশবে তাঁর বাবা স্বনামধন্য একজন শায়েখের কাছে প্রেরণ করেন, যেন সে  কোরআনকে ভালোভাবে হিফজ ও তাজবিদ আয়ত্ত করতে পারে।

তিনি ইলমে ফিকহের প্রাথমিক বিষয়গুলো তাঁর পিতার কাছ থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর তাঁর পিতা তাঁকে হাদিসশাস্ত্রের জ্ঞান অর্জনের জন্য মোসল শহরের শায়েখ আবু জাফর ইবনে আহমাদ ((রহ.))-এর কাছে প্রেরণ করেন। সেখানে তিনি হাদিস বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান অর্জনের জন্য আরো অনেক শায়েখের মজলিসেই আসা যাওয়া করতেন। তিনি শায়েখ ইমামুদ্দিন ইবনে ইউনুস (রহ.)-এর খুব ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি হুমাজান, নাইসাবর, মারো, বাগদাদ ও দামেস্কেও ভ্রমণ করে ওই অঞ্চলের আলেমদের থেকে নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। সে জ্ঞানের আলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেন।

ইমাম ইবনে সালাহর জীবনের গৌরবান্বিত দিক হলো তিনি ছিলেন একজন সফল ও দীপ্তিমান শিক্ষক। তাঁর সময়ে উচ্চস্তরের অনেক আলেমই ছিলেন। কিন্তু তাদের কেউই তাঁর মতো শিক্ষার দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি। তাঁর এ বৈশিষ্ট্য তাঁর রচনাবলি ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি সর্বপ্রথম শিক্ষকতা শুরু করেন জেরুজালেমের আসসালাহিয়্যাহ নামক এক স্কুলে। এ স্কুলটির নামকরণ করা হয়েছিল সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (রহ.)-এর নামে। ইমাম ইবনে সালাহ নিজের তাকওয়া ও ব্যাপক পাণ্ডিত্যের কারণে তার সমকালীন ও পরবর্তী অনেক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বেশ কিছুদিন দামেস্কের আররুওয়াহিয়্যাহ নামক এক স্কুলেও শিক্ষকতা করেন। বাদশাহ আল-আদিলের ছেলে বাদশাহ আল-আশরাফ যখন দারুল হাদিস আল-আশরাফিয়াহ প্রতিষ্ঠা করেন তখন ইমাম ইবনে সালাহকে সেখানকার প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি আশশাম নামক এক স্কুলেও শিক্ষকতা করেছিলেন যা তৎকালীন হোমস শহরের শাসক নাসিরুদ্দিনের স্ত্রী জুমুররুদ খাতুন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালিকান বলেন, ইবনে সালাহ ৬৩২ হিজরির শাওয়াল মাসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ইবনে সালাহ তখন বেশ কিছুদিন তখন তার বাড়িতে অবস্থানও করেছিলেন। তিনি বলেন, ইবনে সালাহ তার দায়িত্ব পালনে খুব সচেতন ছিলেন। তৎকালীন সময়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তার তত্ত্বাবধানে জ্ঞান অর্জন করতেন। যেমন ইবনে খালিকান নিজেই। ফখরুদ্দীন আলকারজী, জায়নুদ্দীন আল ফারুকীসহ আরো অনেকে। ইবনে খলিকান একবার বলেছিলেন, তিনি শুনেছেন, ইবনে সালাহ শাফেয়ী মাজহাবের আল-মুহাতাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলো তার গোঁফ গজানোর আগেই অধ্যয়ন করে ফেলেছিলেন।

ইমাম ইবনে সালাহ তাঁর বর্ণাঢ্যময় জীবনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন ইলমে হাদিসে। কিন্তু তাঁর রচনাবলি শুধু ইলমে হাদিসেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি নানা বিষয়ে বেশকিছু বই রচনা করেন। ইলমে তাফসির ও ইলমে ফিকহেরও বেশকিছু বই রচনা করেছেন। তিনি সায়ানতে সহিহ মুসলিম নামে সহিহ মুসলিমের একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লিখিত বইগুলোর মধ্যে আদাবুল মুফতি ওয়াল মুস্তাফতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সমাদৃত একটি বই। ইমাম ইবনে সালাহ আবু হামিদ আলগাজালির আইনশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আলওয়াসিতের মুশকাল আলওয়াসিত নামে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও চমৎকার একটি ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচনা করেন। এ ব্যাখ্যাগ্রন্থে আলওয়াসিতের কঠিন ও অস্পষ্ট বিষয়গুলোর খুব সুন্দরভাবে সমাধান করেন তিনি। ফতোয়ায়ে ইবনে সালাহ নামে তাঁর একটি ফতোয়া সংকলনও রয়েছে। মানুষ বিভিন্ন সময় তাঁর কাছে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ফতোয়া জানতে আসত তখন তিনি যে ফতোয়াগুলো প্রদান করতেন, পরে সেগুলো দিয়েই ফতোয়ায়ে ইবনে সালাহ নামক সংকলন বের করা হয়।

ইমাম ইবনে সালাহর সবচেয়ে বিখ্যাত বই হচ্ছে মুকাদ্দমাতু ইবনে সলাহ ফী উলুমিল হাদিস। এটি হাদিসের শ্রেণিবিন্যাস বিষয়ক একটি বই। এ বইটিকে হাদিসের ক্ষেত্রে একটি মাস্টারপিস বই হিসেবে গণনা করা হয়। বইটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এর ওপর প্রচুর ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখা হয়েছে। আলেমদের মধ্যে ব্যপকভাবে সমাদৃতও হয়েছে। ইমাম ইবনে সালাহ এই বইটি লেখার ক্ষেত্রে হাদিসের কয়েকটি বইয়ের ওপর নির্ভর করেছিলেন। খতিব আলবাগদাদির আল-কিফায়াহ গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম ইবনে সালাহ ৬৪৩ হিজরি মোতাবেক ১২৪৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ দামেস্কে মৃত্যুবরণ করেন। দলে দলে মানুষ তার জানাজা ও দাফনে অংশগ্রহণ করেছিল।

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক, শিকড় সাহিত্য মাহফিল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads