• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯
সর্বজনীন আদর্শ হজরত মোহাম্মদ (সা.)

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

সর্বজনীন আদর্শ হজরত মোহাম্মদ (সা.)

  • প্রকাশিত ১৭ নভেম্বর ২০২০

মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের জন্য রাসুলের মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (সুরা আহযাব-২১)। হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী। তিনি শুধু মুসলমানদের নবী নন বরং কিয়ামত পর্যন্ত যত বর্ণের, গোত্রের, ধর্মের মানুষ দুনিয়ায় আসবে সবারই নবী। তিনি শুধু মুসলমানদের আদর্শ নন, সকল শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণ, গোত্রের জন্য এক অনুপম আদর্শ। এক কথায় সর্বজনীন আদর্শের আধার মহানবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। পৃথিবীর স্মরণকালের মহা সংকটময় পরিস্থিতিতে, মানবতার ক্রান্তিলগ্নে জন্ম নেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত নিষ্কলুষ মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। শৈশব, কৈশোর ও যুবক বয়সে নবীজি নিজের সরলতা, সততা ও বিশ্বস্ততার দ্বারা মানুষের মন জয় করেছিলেন। খিয়ানতের মহোৎসবের যুগে তিনি ‘আল-আমিন’ বা ‘বিশ্বস্ত’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। সবাই তাঁকে ‘আল-আমিন’ বলেই ডাকত। অন্ধকার যুগে একজন কিশোর ও যুবক কতখানি বিশ্বস্ত হলে অসভ্য ও বর্বর জাতির লোকজনও তাঁকে সম্মানের সঙ্গে স্বতন্ত্র এক উপাধীতে ভূষিত করতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

নবীজি চল্লিশটি বছর নিজেকে প্রস্তুত করে সমাজে একজন আদর্শবান মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। নবুয়াত পরবর্তী মাত্র ২৩ বছরে নিজের আদর্শের ঝলকে তৎকালীন সমাজের অবস্থা পুরো পাল্টে দেন। যে মানুষগুলো একসময় অন্যায় অবিচারের মধ্যে সবসময় নিমজ্জিত থাকতো। সামান্য বিষয় নিয়ে বছরের পর বছর যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো। একজন আরেকজনের সম্পদ কুক্ষিগত করতে কোন দ্বিধা করতো না। সেই মানুষগুলোকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের উত্তম আদর্শ আর চরিত্র মাধুর্য দ্বারা এমনভাবে পরিবর্তন করলেন যে, তারাই এখন পরবর্তী লোকের আদর্শ হয়ে গেছেন। সোনালী অক্ষরে তাঁদের নাম লিখা রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। এমনকি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সে সকল লোকদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে কুরআনে আয়াত নাযিল করেছেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কষ্ঠি পাথর দিয়ে সমাজ এবং সমাজের মানুষদের পরিবর্তন সাধন করেছিলেন তা হলো রাসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুমহান আদর্শ। বর্তমান পৃথিবীর সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা এবং ইসলাম পূর্ব আইয়ামে জাহিলিয়াতের অবস্থা পর্যালোচনা সমীকরণ করলে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, বর্তমান যুগ অন্যায় অবিচার আর পাপাচারের ক্ষেত্রে কোন অংশেই আইয়ামে জাহেলিয়াত থেকে পিছিয়ে থাকবে না। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বর্তমান যুগ আইয়ামে জাহিলিয়াত থেকেও এগিয়ে যাবে। বর্তমান যুগ সংস্কার বা পরিবর্তনের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বহু সংগঠন গড়ে উঠেছে অপসংস্কৃতিযুক্ত এ সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু ফলাফল শূন্য। দিনদিন সমাজ ব্যবস্থা অধঃপতনের নিম্নযাত্রা অব্যাহত রাখছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একটাই পথ, সেটা হলো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ নিজেদের বুকে ধারণ করা এবং সমাজে বাস্তবায়ন করা। নবীজীর দেখিয়ে দেওয়া পথ মাইনাস করে অন্য পথে বা পদ্ধতিতে সমাজের চিত্র পরিবর্তন করার চিন্তা চিন্তাই থেকে যাবে। দিবাস্বপ্নের ন্যায় তা কখনো বাস্তবায়ন হবে না। তাই আমাদের সকলের উচিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের চাদরে নিজেকে আচ্ছাদিত করে সমাজে বাস্তবায়ন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হজরত মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের বাঁকে বাঁকে সকল শ্রেণি পেশার, আবাল বৃদ্ধা বনিতার জন্য সুমহান আদর্শ স্থাপন করে গিয়েছেন। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুকাল থেকেই আমাদের জন্য আদর্শ রেখে গেছেন। মা হালিমার কোলে থাকা অবস্থায় মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন দুধভাই ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুধ পান করার সময় সমতা রক্ষা করতেন। অর্থাৎ তিনি সবসময় এক স্তনের দুধ পান করতেন। অন্য স্তন দুধভাই আবদুল্লার জন্য রেখে দিতেন। শিশু বয়সে ন্যায়-ইনসাফের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন শুধু মহামানবই করতে পারে। আর তা মহান প্রভুর রহমত ছাড়া অসম্ভব। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিশোর থাকা অবস্থায় কাবা ঘর পুনঃনির্মাণের সময় পাথর বহন করার জন্য দাদা আবদুল মুত্তালিব নবীজির পরনে থাকা লুঙ্গি খুলতে উপক্রম হলে সতর খোলার আগেই তিনি বেহুঁশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। যুবক বয়সে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবের গোত্রীয় কোন্দল আর বিবাদ-বিসংবাদের ভয়াবহতায় মর্মাহত হন এবং এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যুবক নবী স্বীয় মেধা ও সাংগঠনিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে গঠন করেছিলেন এক শান্তিসংঘ। যা ইতিহাসে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে অভিহিত। এক ধ্বংসোন্মুখ জাতিকে অনিবার্য বিপর্যয়ের হাত থেকে পরিত্রাণের এক সফল প্রচেষ্টার নাম ছিল সেই হিলফুল ফুজুল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন একজন আদর্শ যুবক তথা পৃথিবীর সব যুবকের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। যিনি সামাজিক সংগঠন তৈরির মাধ্যমে সমাজের পটভূমি পরিবর্তন করেছেন।

যদি কোন ব্যবসায়ী আদর্শ গ্রহণ করতে চায়, সে যেন মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যবসায়ী জীবন অনুসরণ করে। যিনি শতভাগ সততা এবং নিষ্ঠার সাথে অন্যের ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। মালিক কখনো তাঁর কাজে খেয়ানত বা সততার কমতি দেখাতে পারেন নি। যদি কোন স্বামী আদর্শ গ্রহণ করতে চায়, সে যেন মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করে। যিনি একই সময়ে একাধিক স্ত্রীর সাথে সমতা রক্ষা করে চলেছেন। যার প্রতি সকল স্ত্রী সন্তুষ্ট ছিল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কোন স্ত্রীর অভিযোগ ছিল না। যদি কোন পিতা আদর্শ গ্রহণ করতে চায়, সে যেন পিতা মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করে। যিনি তার সন্তানদেরকে এত ভালোবাসতেন। তিনি বলেন, ‘ফাতেমা আমার শরীরের গোশত টুকরা (কলিজার টুকরা)’। যদি কোন বিজিত যোদ্ধা আদর্শ গ্রহণ করতে চায়, তবে সে যেন বদর, মক্কা বিজয়ী মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে শিক্ষা নেয়। যিনি যুদ্ধে জয়ী হয়েও কোন উল্লাস করেননি। বরং শত্রুদেরকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার মাধ্যমে উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যুদ্ধে পরাজিত কোন সেনাপ্রধানের কি আদর্শ হতে পারে সেই আদর্শও মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। যিনি যুদ্ধে হেরে মনোবল হারান নি। বরং শোককে শক্তিতে পরিণত করে ফিরে এসেছেন আকাশসম সাহস নিয়ে।

যদি কোন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী আদর্শ গ্রহণ করতে চায়, সে যেন বিশ্বনেতা হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আদর্শ গ্রহণ করেন। যিনি মদিনায় মাত্র ২ কিলোমিটার জায়গা পেয়েছিলেন ইসলাম প্রচার করার জন্য কিন্তু তার উদার নেতৃত্বগুণ আর উত্তম চরিত্র দ্বারা মাত্র ১০ বছরে সেই ২ কিলোমিটার জায়গাকে ২ লাখ বর্গকিলোমিটারে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন। যদি কোনো বিচারক আদর্শ গ্রহণ করতে চায়, তবে সে যেন ন্যায় ও ইনসাফের মূর্ত প্রতীক, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারপতি হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার আদর্শ বানায়। যিনি বিচার কাজের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও আইনের সমপ্রয়োগের জন্য দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করে তাহলে তার হাত কেটে দাও।’ এমন বিচারক আর বিচার ব্যবস্থা আজ জাদুঘরে বসবাস করছে। যদি কোনো নেতা আদর্শ খোঁজে, সে যেন বিশ্বনেতা হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নেতা হিসেবে আদর্শ গ্রহণ করে। যে নেতা সবসময় তার কর্মীদের পাশে থাকতেন, কর্মীদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতেন, কর্মীদের চিন্তায় যে নেতা বিনিদ্র রজনী পার করতেন, কর্মী ক্ষুধার যন্ত্রণায় পেটে পাথর বাঁধলে তিনিও পেটে পাথর বাঁধতেন। পুরো বিশ্ব এমন এক মহান নেতার কাঙ্গাল।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাঝে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সামগ্রিক জীবনে বিকশিত হয়েছে আরো মহান ও মহত্তম গুণাবলি। তিনি একজন আদর্শ পরোপকারী, আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ প্রচারক, আদর্শ সৈনিক, আদর্শ সেনাপতি, আদর্শ বিপ্লবী, আদর্শ নেতা ও আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক। তিনি শ্রমিকের আদর্শ, তিনি ব্যবসায়ীর আদর্শ, অতিথিপরায়ণতার আদর্শ, বিচারকের আদর্শ। সর্বোপরি পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত তিনি সর্বমানবের কাছে সর্বোৎকৃষ্ট অনুসরণীয়, সর্বজনীন আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবেন। তাঁর মহান আদর্শ ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে। ঘুণেধরা সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হোক বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুমহান আদর্শ দ্বারা।

মুফতি শরিফুল ইসলাম

লেখক : পরিচালক, হালিমাতুস সাদিয়া মহিলা মাদরাসা, ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads