• সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

যারা জান্নাতে যেতে পারবে না

  • প্রকাশিত ২০ নভেম্বর ২০২০

মুহাম্মদ ইমাম হাসান

 

 

দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। আখিরাতের জীবন চিরস্থায়ী। আর আখিরাতের শান্তিময় চিরস্থায়ী বাসস্থান হলো জান্নাত। দুনিয়ার এ জীবনের পরেই শুরু হবে পরকালের সীমাহীন চিরস্থায়ী জীবন। যে জীবনের শুরু আছে শেষ নেই। সে জীবনে যারা সফলকাম হবে তারাই চিরস্থায়ী জান্নাত লাভ করবে। আর যারা ব্যর্থ তাদের জন্যও রয়েছে চিরস্থায়ী জাহান্নাম। দুনিয়ায় এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা জান্নাতে যেতে চায় না। আল্লাহতায়ালা মানুষকে সব অন্যায় থেকে মুক্ত থেকে তাঁর আনুগত্যের বিনিময়ে জান্নাত দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। আর কারা জান্নাতে যেতে পারবেন না; এ প্রসঙ্গে হাদিসে কিছু স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। এখানে কিছু হাদিস উল্লেখ করা হলো।

যারা বেঈমান, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেনি, তারা জান্নাতে যেতে পারবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ঈমানদার ব্যতীত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম) তিনি আরো বলেন, ‘ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না’ (মুসলিম)। যারা প্রতিবেশীর প্রতি জুলুম করে, ভালো ব্যবহার করে না তারাও জান্নাতে যেতে পারবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম)। অহংকারী ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম) পরনিন্দাকারী ও চোগলখোর ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘চোগলখোর বা পরনিন্দাকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম) তিনি আরো বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন সবচেয়ে খারাপ লোকদের দলভুক্ত হিসেবে ওই ব্যক্তিকে দেখতে পাবে যে, যে ছিল দুমুখো- যে একজনের কাছে এক কথা আরেক জনের কাছে ভিন্ন কথা নিয়ে হাজির হতো।’ (মুসলিম)

আত্মহত্যাকারী জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের উপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে যাবে। সেখানে (পরকালে) সব সময় সে ওইভাবে (দুনিয়ার মতো) নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে।’ যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে বিষ তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সব সময় সে ওইভাবে বিষ পান করে নিজেকে মারতে থাকবে অনন্তকাল ধরে।

যে ব্যক্তি কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে, যার দ্বারা সে সবসময় সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম) হারাম ভক্ষণকারী জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হারাম অর্থের মাধ্যমে (যে শরীরে) মাংস বৃদ্ধি পেয়েছে, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। অর্থাৎ যে ব্যক্তি হারাম অর্থ ও অবৈধ উপার্জন দ্বারা দেহ গঠন (জীবিকা নির্বাহ) করেছে, জাহান্নামের আগুনই তার প্রাপ্য।’ (মিশকাত) উপকার করে খোটা দেয়া ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যে উপকার করে খোটা দেয়।’ (নাসাঈ)।

তাকদির (ভাগ্য) অস্বীকারকারী ও অবাধ্য সন্তান জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, মদ্যপায়ী এবং তাকদির অস্বীকারকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সিলসিলা)। জ্যোতিশ, জাদুকর, মাদক তথা নেশাকারী জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পাঁচ শ্রেণির মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (তারা হলো) মদ্যপায়ী, জাদুর বৈধতায় বিশ্বাসী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, চোগলখোর এবং গণক তথা জ্যোতিষ ব্যক্তি।’ (মুসনাদে আহমদ) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোনো ঋণগ্রস্ত মৃতের লাশ (জানাজার জন্য) নিয়ে আসা হলে (তিনি) জিজ্ঞেস করতেন, ‘সে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করেছে কি না? যদি বলা হতো করেছে, তবে জানাজা পড়তেন। অন্যথায় (সাহাবিদের) বলতেন- তোমরা তোমাদের সাথীর জানাজা পড়ে নাও।’ (কিন্তু তিনি নিজে তাতে অংশ গ্রহণ করতেন না)। (মুসলিম) অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘ঋণ ছাড়া শহীদের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (মুসলিম) পুরুষ বেশধারী নারী ও দাইয়ুস জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তিন শ্রেণির লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তারা হলো- ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, দাইয়ুস এবং পুরুষ বেশধারী নারী।’ (সহিহ জামে) অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তিকে দাইয়ুস বলা হয়, যে তার পরিবারের অশ্লীলতা ও কুকর্মকে মেনে নেয়।’ (মুসনাদ আহমদ, নাসাঈ)

ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী শাসক, অহংকারী গরিব ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহ তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদেরকে গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তারা হলো- ‘বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী শাসক এবং অহংকারী গরিব।’ (মুসলিম) কঠোরতা অবলম্বনকারী ও কটূভাষী ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। যে ব্যক্তি মানুষের কাছে এমন বিষয় নিয়ে গর্ব-অহংকার প্রকাশ করে বেড়ায় প্রকৃতপক্ষে যা তার কাছে নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কঠোর প্রকৃতি ও কটূভাষী লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং ওই লোকও নয়, যে এমনসব বিষয়ে মানুষের কাছে গর্ব-অহংকার প্রকাশ করে বেড়ায় প্রকৃতপক্ষে যা তার কাছে নেই।’ (আবু দাউদ) অঙ্গীকার গ্রহণকারী অমুসলিমকে হত্যাকারী জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলিম সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বসবাসকারী কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের পথের দূর থেকে জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।’ (বুখারি)

বিশ্বাসঘাতক শাসক জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যাকে আল্লাহতায়ালা জনসাধারণের শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন কিন্তু সে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং বিশ্বাসঘাতক থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন।’ (মুসলিম) অন্যায়ভাবে মানুষকে প্রহারকারী ও পর্দাহীন নারী জান্নাতে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দুই শ্রেণির মানুষ জাহান্নামে যাবে। যাদের আমি এখনো দেখিনি। (রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে তাদের আত্মপ্রকাশ হয়নি) তারা হলো- এমন কিছু লোক যাদের হাতে থাকবে গরুর লেজের মতো লাঠি। এরা তা দিয়ে জনগণকে প্রহার করবে। আর ওইসব উলঙ্গ-অর্ধউলঙ্গ বেপর্দা নারী যারা (নিজেদের চলাফেরা ও বেশভূষায়) মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করবে এবং নিজেরাও অন্য মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা উটের মতো উঁচু হবে এবং একপাশে ঝুঁকে থাকা চূড়ার মতো কেশরাজি শোভা পাবে। এসব নারী জান্নাতে তো যাবেই না বরং জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না অথচ বহুদূর থেকে জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।’ (মুসলিম)

তবে হতাশা নয়। মহান আল্লাহ্ পাক দয়ার সাগর। তিনি নিজ বান্দার প্রতি অনুগ্রহশীল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তোমাদের সব গুনাহ মাপ করে দিবেন।’ সুতরাং যারা খালেস দিলে উল্লেখিত কাজগুলো থেকে তাওবাহ করে আল্লাহর পথে ফিরে আসবে, আশা করা যায়- আল্লাহতায়ালা তওবাকারী বান্দাকে ক্ষমা করে দিবেন। আর যদি তাওবা করার আগেই মৃত্যুবরণ করে এবং আল্লাহ তাদের ক্ষমা না করেন তবে তাদের পরিণতি চিরস্থায়ী জাহান্নাম। উল্লেখ্য, শিরিক থেকে খুব সাবধান। আল্লাহতায়ালা ‘শিরিক’ সহজেই মাফ করেন না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না, যে ব্যক্তি তাঁর সাথে শরিক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৪৮) আল্লাহতায়ালা আমাদের সব ধরনের পাপ কাজ থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

 

লেখক : ইমাম ও খতিব, টুটালিয়াপাড়া জামে মসজিদ সাভার, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads