• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

দেহের শোভা আবরণ, আত্মার শোভা শিষ্টাচার

  • প্রকাশিত ০৮ ডিসেম্বর ২০২০

এম জহিরুল ইসলাম

 

আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘এই কোরআন সেই পথ দেখায়, যা পুরোপুরি সোজা ও ঋজু। যেসব লোক একে মেনে নিয়ে শিষ্টাচার পালনের মধ্য দিয়ে কাজ করতে থাকবে, তাদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য বিরাট শুভ কর্মস্থল রয়েছে। আর যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, তাদেরকে একথা জানিয়ে দাও যে, তাদের জন্য আমি অত্যন্ত পীড়াদায়ক আজাব প্রস্তুত করে রেখেছি।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত -১০) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মানবতাবোধের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ শিষ্টাচার।’ কথায় বলে, ভদ্র ও সৎ হতে যখন অর্থ ব্যয়ের দরকার হয় না, অথচ ভদ্র আচরণ মানুষকে শ্রেষ্ঠ গুণসম্পন্ন বলে প্রতিপন্ন করতে পারে-তখন ভদ্র ও সৎ না হওয়ার অন্তরালে কোনো যুক্তি নেই। অবশ্য একথা সত্য যে, মানুষ ইচ্ছে করলেই সৎ হতে পারে না। এর জন্য শুধু শিক্ষা নয়, চাই উপযুক্ত সুশিক্ষা। অশিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষের কাছে প্রকৃত ভদ্রতা আশা করা যায় না (সব নিরক্ষর কিন্তু অভদ্র নন)। কারণ অজ্ঞানতার অর্থই অমার্জিত রুচির প্রয়োগ। পরকালের অন্তহীন জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তুলতে হলে এর পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে এই দুনিয়াতেই। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘সেই লোকদের ছাড়া যারা ঈমান এনেছে ও শিষ্টাচারের মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করে তাদের জন্য অশেষ প্রতিফল রয়েছে।’ (সুরা আত-ত্বীন, আয়াত-৬)।

মানবজীবনে শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের প্রয়োজন কতোটুকু তা বলে শেষ করা যাবে না। শিষ্টাচারের অভিধানগত অর্থ ভদ্রতাসূচক আচরণ। গল্প বা পুস্তকে নেপোলিয়নের মতো একজন মহাবীর শিষ্টাচারের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সে কাহিনী কে না জানে? একবার তিনি অতি সামান্য একজন ভিখারীকে পথপ্রদর্শন করে শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের যে নজির রেখে গেছেন তা আজো ইতিহাসে স্মরণীয়। তিনি দেশবাসীকে সর্বদা সদাচার ও ভদ্র হতে উপদেশ দিতেন।

আমাদের সমাজ ও জাতীয় জীবনের উদ্যোক্তা মহাপুরুষেরা একথা জোর দিয়ে বলেছেন, যে কোনো জাতির জীবনকে আদর্শ করে তুলতে হলে শিষ্টাচার ও সৌজন্যের ব্যাখ্যা হূদয়ঙ্গম করে দৈনন্দিন জীবনে এর প্রয়োগে সক্রিয় হওয়া উচিত। আমাদের দেশের অসৌজন্যবোধ ও অশিষ্টাচারের দৃষ্টান্ত অত্যন্ত মর্মান্তিক। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূলে রয়েছে এর অভাব। বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিষ্টাচার সম্পর্কে ধারণা দেওয়া উচিত। ইসলাম ধর্মে শিষ্টাচার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধনে বিবেচিত। তারপরও যদি কেউ অসৎ ও অন্যায়ের পথে অগ্রসর হয়, নিজের চরিত্রগত দোষ সংশোধন করে কলুষমুক্ত জীবনযাপন না করে অসৎপথে অগ্রসর হয়ে মানবসমাজের ক্ষতিসাধন করতে থাকে, তবে তার পারলৌকিক শাস্তি ছাড়াও পার্থিব শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেনো তা দেখে অন্যরা সাবধান হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তওরাতে আমি ইহুদিদের প্রতি এই হুকুমই লিখে দিয়েছি যে, জানের বদলে জান, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের পরিবর্তে দাঁত এবং সব রকম জখমের সমান বদল নির্দিষ্ট।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-৪৫)

ইসলামে শিষ্টাচার শুধু ব্যক্তি বা সমাজজীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তাই এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেও সমপ্রসারিত হয়েছে। একটি জাতি যদি সত্যিকার অর্থে শিষ্টাচারী না হয়, সে জাতির বৈষয়িক উন্নতি সম্ভব নয়। এক সময় মুসলিম জাতি নৈতিক আদর্শে বলীয়ান হয়েছিল বলেই সারা দুনিয়ার ওপর রাজত্ব করেছিল। প্রকৃত কথা এই যে, কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত জাতির লোকেরা অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা না করে। আর যখন আল্লাহ কোনো জাতির অকল্যাণ করার সিন্ধান্ত করেন, তখন তা কারো প্রতিবাদে রুদ্ধ হয় না, না আল্লাহর বিরুদ্ধে এই রকম জাতির কেউ সহায়ক ও সাহায্যকারী হতে পারে।’ (সুরা রাদ, আয়াত-১১)

আমরা আজ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছি। শিষ্টাচারের প্রতি এখন আর তেমন গুরুত্ব দেই না। পশ্চিমা জগতের মতো অসত্য, অন্যায়, শোষণ আর অপরের অধিকার হরণকে নিজের মৌলিক অধিকার বলে স্বীকার করে নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। ফলে আমাদের উন্নতির চেয়ে অবনতিই ইচ্ছে অনেক বেশি। কিন্তু তা বুঝা ও অনুধাবনের জ্ঞানটুকু পর্যন্ত আমাদের লোপ পেয়েছে। দেহের শোভা আবরণ, আর আত্মার শোভা হচ্ছে শিষ্টাচার। এই শিষ্টাচার অনুশীলনের অর্থ হচ্ছে, বাক্য এবং আলাপে রূঢ়তা বর্জন করে যে যতো বেশি অমায়িক, ভদ্র ও পরোপকারী-সে ততো বেশি জনপ্রিয়। যে কোনো জাতির সুনামের বাসনা চরিতার্থ হয় মানবতা রূপ-গুণের বলে। সমাজজীবনে শিষ্টাচার ও সদাচারের মূল্য যে কতোটুকু তা চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই অজানা নয়। পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে গুণাবলির সক্রিয়তা কেউই অস্বীকার করতে পারেন না। মানুষের গুণের কথাই মানুষ স্মরণ রাখে। কে কতো সমৃদ্ধ বা কার রূপ কতো বেশি-এদিকে কেউ দৃষ্টিপাত করে না। শিষ্টাচারবিবর্জিতভাবে অর্থ ও সম্পদ পূঞ্জীভূত করার জন্যে সমাজে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় শোষক ও শোষিত-শ্রেণি। এজন্যে পবিত্র কোরআনে কঠোর ও পীড়াদায়ক শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘একদিন অবশ্যই হবে, যখন এই স্বর্ণ, রৌপ্যের ওপর জাহান্নামের আগুন উত্তপ্ত করা হবে এবং পরে ওটার দ্বারাই সে লোকদের কপালে, পার্শ্বদেশে ও পিঠে চিহ্ন দেওয়া হবে। এটা হচ্ছে সেই সম্পদ-যা তোমরা নিজেদের জন্যে সঞ্চিত করেছিলে। এখন তোমাদের সঞ্চিত সম্পদের স্বাদ গ্রহণ করো।’ (সুরা তওবা, আয়াত-৩৫)

মনে করুন, একটি ভয়ঙ্কর অগ্নিকুণ্ডলী গোটা এলাকা গ্রাস করার জন্য যার জিহ্বা লক লক করছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের তৎপরতা কী হবে? নিশ্চয়ই প্রতিটি ব্যক্তি তখন আগুন নেভানোর তৎপরতায় সক্রিয় হয়ে ওঠবে। ফায়ার ব্রিগেডকে ফোন করবে এবং সাধ্যমতো সব প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে কিংবা কমপক্ষে নিজে সেখান থেকে সরে পড়বে। এ পরিস্থিতিতে যদি কোনো ব্যক্তি এসব তৎপরতায় অংশগ্রহণ না করে এবং আগুন থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান না করে বরং আগুনের বিবরণকে তেল-নুন দিয়ে বর্ণনা করে এবং নিজেও তাতে ঝাঁপ দেয়, তাহলে সে চরম নির্বোধ ও উন্মাদ ছাড়া আর কিই-বা হতে পারে? অথচ সামাজিক দুর্নীতিরূপী যে আগুনের আলোচনা আমরা রাত-দিন করে থাকি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো-এ সম্পর্কে আমাদের তৎপরতা এরকম যে, আমরা ‘তেল-নুন’ মাখিয়ে এর সমালোচনা করি, তারপর নিজেরাই এতে জড়িয়ে পড়ি। রাত-দিন দুর্নীতিবাজ, প্রতারক ও হারামখোরদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করি, অথচ সুযোগ পেলে নিজেও এগুলোয় নির্দ্বিধায় যুক্ত হয়ে যাই। এই কর্মপন্থার দৃষ্টান্ত কি ঠিক এরূপ নয় যে, কোনো ব্যক্তি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের বর্ণনা দিয়ে নিজেই তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সমাজে যখন অন্যায় ও অপকর্ম ব্যাপক রূপ ধারণ করে, তখন আমাদের করণীয় কী, সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের চিন্তা করো। তোমরা যখন সৎপথে রয়েছ, তখন কেউ পথভ্রান্ত হলে তাতে তোমাদের ক্ষতি নেই।’ (সুরা আল-মায়েদা, আয়াত-১০৫) এ আয়াত এই সোনালি মূলনীতি পেশ করে যে, সমাজ ও তার দুর্নীতির সমালোচনায় সর্বদা মুখর থাকার মধ্যে সমস্যার প্রকৃত সমাধান নিহিত নেই; বরং সমস্যার সমাধান এই যে, আমার দায়িত্বে আল্লাহ ও বান্দার যেসব কর্তব্য ও অধিকার রয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে আদায় করা। নিজের দায়িত্ব পালন করা। সর্বপ্রথম নিজে ঠিক হওয়া, তারপর অপরকে সংশোধন করার চেষ্টা করা। মূলত সমাজকে সংশোধন করার সর্বপ্রথম পদক্ষেপ এটাই। স্মরণ করা যেতে পারে, আমি আপনি ও কিছুসংখ্যক মানবসদস্যের সমষ্টির নামই তো সমাজ। যদি প্রত্যেকে সর্বপ্রথম নিজের কথা ভাবে যে আগে আমি ঠিক হয়ে যাই, তাহলে ধীরে ধীরে সমাজ ঠিক হয়ে যাবে। এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন-চার, এভাবে প্রদীপ থেকে প্রদীপ জ্বলতে থাকবে। তখন সমাজ সংস্কারের যে কোনো কর্মসূচি সহজেই মানুষকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। দুর্নীতির যে সাইক্লোন আমরা দেখতে পাচ্ছি, ধীরে ধীরে তা স্তিমিত হয়ে যাবে। মানুষকে মানুষ বানানোর জন্য ব্যক্তি ও আত্মশুদ্ধির দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। কোরআনের এ উজ্জ্বল ফর্মুলার মাঝেই রয়েছে সমাজশুদ্ধির প্রকৃত কর্মকৌশল।

 

লেখক : আলেম, সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads