• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জৈষ্ঠ ১৪২৯
মুনাফিকদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

মুনাফিকদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা

  • প্রকাশিত ১১ ডিসেম্বর ২০২০

নিজেদের মুসলমান দাবি করা সত্ত্বেও অনেকে ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধানের বিরোধিতা করে এবং নানা কায়দায় ধার্মিক মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রকাশ করে তাদের হেয়প্রতিপন্ন করে। ইসলামের ব্যাপারে সাধারণ মুসলমানদের অন্তরে বিভ্রান্তি ও সন্দেহ সৃষ্টি করা এবং ইসলামী আদর্শের বিরোধিতা করাই এদের জঘন্য স্বভাব। শরিয়তের পরিভাষায় এদের মুনাফিক বলা হয়। এদের অপতৎপরতা প্রতিরোধের চেষ্টা করা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। তবে এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও সীমা লঙ্ঘন কাম্য নয়। বরং কোরআন ও সুন্নাহর আদর্শ অনুসরণ করে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা.) তাদের যুগের মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা যেসব উপায়ে করেছেন ঠিক সেসব উপায়ে এ যুগের মুসলমান নামধারী ইসলামবিদ্বেষীদের ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করা কর্তব্য। কোরআনে মুনাফিকদের ব্যাপারে অনেক আয়াত নাজিল হয়েছে। এমনকি ‘সুরা মুনাফিকুন’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরাও নাজিল হয়েছে। কোরআনে মুনাফিকদের আলোচনাগুলো ব্যাখ্যা সহকারে পড়লে বর্তমান যুগের মুনাফিকদের চিহ্নিত করা এবং তাদের ব্যাপারে আমাদের করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। পবিত্র কোরআনের আলোকে মুনাফিকদের অপতৎপরতা প্রতিরোধের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

মুনাফিকদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সতর্ক করা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ যুগের সব মুনাফিককে চিনতেন ও জানতেন। ওহীর মাধ্যমে তাদের সব অপতৎপরতার খবরও পেতেন। এ সত্ত্বেও তিনি কখনো কোনো মুনাফিককে হত্যার আদেশ দেননি। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ মুনাফিকদের হত্যার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি দেননি। কেননা এ বিষয়কে কেন্দ্র করে কাফির-মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে যে, তিনি তাঁর সাথীদের হত্যা করেন। এছাড়া যাকে হত্যা করা হবে তার গোত্রের মুসলমানরা হয়তো এ বিষয়টি সহজভাবে নেবে না। অথবা এ ব্যাপারে আরো কোনো হেকমত থাকতে পারে, যার কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুনাফিকদের হত্যা করতে অনুমতি দেননি। তবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুনাফিকদের হত্যার অনুমতি না দিলেও তাদের প্রতিটি অপতৎপরতার ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-কে সতর্ক করতেন। যখনই মুনাফিকরা কোনো অপতৎপরতায় লিপ্ত হতো, তখনই তারা ভয়ে থাকত কখন তাদের অপতৎপরতার খবর ওহীর মাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুনাফিকরা এ ব্যাপারে ভয় করে যে, মুসলমানদের ওপর না এমন কোনো সুরা নাজিল হয়, যাতে তাদের অন্তরের গোপন বিষয় অবহিত করা হবে। সুতরাং আপনি বলে দিন, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে থাক; আল্লাহ তা অবশ্যই প্রকাশ করবেন যার ব্যাপারে তোমরা ভয় করছ (সুরা তাওবা- ৬৪)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে মুনাফিকদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করার ফলে তাদের কোনো অপতৎপরতাই সফলতার মুখ দেখেনি। বর্তমান যুগে যেসব নামধারী মুসলমান ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কোনো কর্মকাণ্ড করে তাদের অপতৎপরতার ব্যাপারে খোঁজখবর রাখা উচিত। আর তাদের অপতৎপরতার ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করা আবশ্যক। তাহলে তাদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে ইনশাআল্লাহ।

তাদের বিভ্রান্তির উপযুক্ত জবাব দেওয়া : মুনাফিকরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলমানদের ব্যাপারে অনেক বিভ্রান্তিমূলক কথা ছড়িয়েছে। তারা যখনই কোনো বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা করেছে, তখনই আল্লাহতায়ালা ওহী নাজিল করে তাদের বিভ্রান্তির জবাব দিয়েছেন। মুনাফিকরা একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর মুহাজির সাহাবিদের জন্য অর্থ ব্যয় না করতে এবং মদিনা থেকে তাদের বের করে দিতে আনসারদের কাছে অপতৎপরতা চালিয়েছিল। তখন তারা নিজেদের সম্মানিত এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুহাজিরদের লাঞ্ছিত বলে অভিহিত করেছিল। তখন তাদের এ বিভ্রান্তির জবাবে এই আয়াতগুলো নাজিল হয়। ‘তারাই (মুনাফিকরা) বলে, আল্লাহর রাসুলের সাহচর্যে যারা আছে তাদের জন্যে ব্যয় করো না। পরিণামে তারা আপনা-আপনি সরে যাবে। আসমান ও জমিনের ধন-ভান্ডার আল্লাহরই কিন্তু মুনাফিকরা তা বোঝে না। তারাই বলে, আমরা যদি মদিনায় প্রত্যাবর্তন করি তবে সেখান থেকে সম্মানিতরা অবশ্যই লাঞ্ছিতদের বহিষ্কৃত করবে। ইজ্জত তো আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও মুমিনদেরই। কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না (সুরা মুনাফিকুন : ৭-৮)।

বর্তমান যুগে যারা নিজেদের মুসলমান দাবি করেও ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধানের ব্যাপারে বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং ধার্মিক মুসলমানদের হেয় করে কথা বলে, তাদেরকে উপযুক্ত জবাব দেওয়া উচিত। তাদের অপপ্রচারের এমন জবাব দিতে হবে যেন তাদের মুখ একদম বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মুসলমানরা যেন মুসলিম মুখোশধারী এসব ইসলামবিদ্বেষীর ষড়যন্ত্রের কবল হতে সতর্ক থাকতে পারে।

তাদের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা : মুনাফিকরা যখনই ইসলামের কোনো হুকুমের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে কিংবা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করেছে, তখনই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম (রা.) তাদের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। মুনাফিকরা যখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য মসজিদ তৈরি করে এটাকে তাদের ঘাঁটি বানাতে চেয়েছিল, তখন আল্লাহতায়ালা ওহীর মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘আর যারা নির্মাণ করেছে মসজিদ জিদের বশে এবং কুফরির তাড়নায় মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ওই লোকের জন্য ঘাঁটিস্বরূপ যে পূর্ব থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে, আর তারা অবশ্যই শপথ করবে যে, আমরা কেবল কল্যাণই চেয়েছি। পক্ষান্তরে আল্লাহ সাক্ষী যে, তারা সবাই মিথ্যুক (সুরা তাওবা : ১০৭)। এ আয়াত নাজিলের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পারলেন, তখন তাবুক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে তাদের ষড়যন্ত্রের আখড়া ধ্বংস করেন। এর ফলে তাদের ষড়যন্ত্র সমূলে নস্যাত হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে উপযুক্ত প্রতিরোধ গ্রহণ না করতেন, তাহলে তারা মুসলমানদের অনেক ক্ষতি করতে পারত। তাই বর্তমান যুগের মুসলমান নামধারী ইসলামবিদ্বেষীদের ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত প্রমাণ পেলে তা নস্যাত করতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।

প্রয়োজনে তাদের ব্যাপারে কঠোর হওয়া : মুনাফিকরা কাফিরদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র করে। তাই ইসলামে তাদের সঙ্গে কঠোর আচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে নবী! কাফির ও মুনাফিকদের সঙ্গে জিহাদ করুন এবং তাদের সঙ্গে কঠোরতা অবলম্বন করুন। তাদের ঠিকানা হলো দোজখ এবং তা হলো নিকৃষ্ট ঠিকানা (সুরা তাওবা : ৭৩)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘কাফিরদের সঙ্গে অস্ত্রের মাধ্যমে এবং মুনাফিকদের সঙ্গে জিহ্বার মাধ্যমে জিহাদ করুন। আর তাদের প্রতি কোমল আচরণ করবেন না।’ সুতরাং বর্তমান যুগেও যেসব নামধারী মুসলমান প্রকাশ্যে ইসলামের বিরোধিতা করে, তাদের প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। কঠোর ভাষায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হবে।

মুনাফিকীর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা : পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে মুনাফিকদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বর্তমান যুগে যারা মুসলমান দাবি করেও প্রকাশ্যে ইসলামের বিভিন্ন হুকুমের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদেরকে মুনাফিকীর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা যেতে পারে। মুনাফিকদের ঠিকানা চিরস্থায়ী জাহান্নাম। তারা জাহান্নামের সবচেয়ে অতল গহ্বরে অবস্থান করবে। একমাত্র যারা মৃত্যুর আগে খালিস দিলে তাওবা করবে, শুধু তারাই এ ভয়াবহ পরিণতি থেকে বাঁচতে পারবে। আল্লাহতায়ালা এ ব্যাপারে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে মুনাফিকরা থাকবে দোজখের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তোমরা তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী কখনো পাবে না। অবশ্য যারা তওবা করে নিয়েছে, নিজেদের অবস্থার সংস্কার করেছে এবং আল্লাহর পথকে সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে আল্লাহর ফরমাবরদার হয়েছে, তারা থাকবে মুসলমানদেরই সঙ্গে। বস্তুত আল্লাহ শিগগিরই ঈমানদারদের মহাপুণ্য দান করবেন’ (সুরা নিসা : ১৪৫-১৪৬)।

লেখক:মুহাম্মদ আবু আখতার

ইসলামী গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads