• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস

আরবি ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

  • প্রকাশিত ১৮ ডিসেম্বর ২০২০

মুফতি কাজী সিকান্দার

 

 

আজ ১৮ ডিসেম্বর। আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস। প্রতি বছরই এ দিনে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস পালন করা হয়। আরব দেশসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দেশ বেশ আড়ম্বরের সঙ্গেই এ দিবস পালন করে। বিশ্বের অনেক ভাষায় আরবি  ভাষার প্রভাব রয়েছে। অন্যান্য ভাষার সাথে আমাদের বাংলা ভাষাতেও আরবি বিরাট একটি জায়গা করে নিয়েছে। আমরা নিত্যদিন পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অসংখ্য আরবি শব্দ ব্যবহার করি। তার সাথে আরবি আমাদের ধর্মীয় ভাষা। জান্নাতের ভাষা। রাসুলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষা আরবি।  কোরআন ও হাদিসের ভাষা আরবি। তাই ইসলাম ও মুসলমানের অতি গুরুত্বের ভাষা আরবি। জাগতিক দিক থেকে আমার দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ আরব দেশে বসবাস করে জীবিকার তাগিদে। তাই তাদেরকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আরবি ভাষা শিখতে হয়। অপর দিকে একজন মানুষ আলেম হতে হলে আরবি ভাষা শিক্ষা করা অপরিহার্য। সবদিক থেকে আরবি ভাষা আমাদের জীবন চলার ক্ষেত্রে ওতপ্রেতভাবে জড়িয়ে আছে।

আরবি ভাষা দিবস যেভাবে এলো : আরবি ভাষা বিশ্বের আরব রাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য দেশে অতি গুরুত্বের সাথে চর্চা হয়। বিশেষ করে যে দেশে মুসলিম রয়েছে। এটা বহুল ব্যবহূত একটি ভাষা। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে আরবি ভাষা অবহেলিত। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ছিল পাঁচটি। ইংরেজি, ফরাসি, চীনা, রাশিয়ান ও স্প্যানিশ। এখানে আরবদের নিজ মাতৃভাষা ব্যবহারের কোনো সুযোগ ছিল না। অন্য ভাষাতে তাঁদেরকে বক্তব্য প্রদান করতে হতো। এমনকী নথিপত্র আরবি থেকে কোনো দাপ্তরিক ভাষায় অনুবাদ করে উপস্থাপন করতে হতো। সৌদি আরব ও মরক্কো সরকার উদ্যোগী হন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৫৪ সালের ৪ ডিসেম্বর নবম অধিবেশনে ৮৭৮ নং প্রস্তাবে বছরে চার হাজার পৃষ্ঠা আরবিতে লিখিত অনুবাদ প্রকাশের বৈধতা প্রদান করে। সাথে শর্ত দিয়ে দেয় যে, অনুবাদের ব্যয়ভার সংশ্লিষ্ট দেশকে বহন করতে হবে। ১৯৬০ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ আরব দেশগুলোতে আরবি ভাষায় সেমিনার ও জাতীয় সম্মেলন পরিচালনা এবং নথিপত্র ও প্রচারপত্র আরবিতে প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশগুলোতে অন্য ভাষা থেকে আরবিতে এবং আরবি থেকে অন্য ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ১৯৬৮ সালে অনুবাদের সাথে সাথে আরবি ভাষাকে ইউনেস্কোর সাধারণ সভা ও কর্মপরিষদের কার্যকরী ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে সৌদি আরব ও মরক্কোর পাশাপাশি আরব বিশ্বের কূটনৈতিক চাপে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ সভায় ২৮তম অধিবেশনে ৩১৯০ নং সিন্ধান্তে আরবিকে ষষ্ঠ দাপ্তরিক ভাষারূপে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ১৯০তম অধিবেশনে ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে ১৮ ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস পালন করা হয়।

অন্যান্য ভাষা দিবস : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কেবল একটি।  ২১ ফেব্রুয়ারি। এ দিন বাংলাদেশের সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। যা ছিল বিশ্ব দরবারে একমাত্র ভাষার জন্য আত্মত্যাগ। বাংলাদেশীদের এ আত্মত্যাগকে বিশ্ব দরবার মূল্যায়ন করেছে, এ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা, ইউনোস্কোর ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ছুটি ভাষার  পৃথক পৃথক আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের ঘোষণা করা হয়। ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক ফরাসি ভাষা দিবস। ২০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক চীনা ভাষা দিবস। ২৩ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ইংরেজি ভাষা দিবস। ৬ জুন আন্তর্জাতিক রুশ ভাষা দিবস। ২১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক স্প্যানিশ ভাষা দিবস। ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস পালন করা হয়। 

আরবি ভাষার গুরুত্ব : আরবি ভাষার সাথে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের আত্মার সম্পর্ক। এ দেশের আপামর জনসাধরণ আরবি ভাষাকে পরম শ্রদ্ধা করে। মন থেকে ভক্তি করে। হূদয় দিয়েই ভালোবাসে। আরবি ভাষার যেমন রয়েছে ধর্মীয় গুরুত্ব তেমনি রয়েছে বৈষয়িক গুরুত্ব। পৃথিবীর প্রায় ২৮ কোটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা আরবি। ২৫ কোটি মানুষ আরবিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। ২৫টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা আরবি। অপর দিকে অর্থনৈতিক বিবেচনায় আরবি ভাষা বাংলাদেশের জন্য অতি গুরুত্ব রাখে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি ধরা হয় রেমিটেন্স। আর এ রেমিটেন্সের সিংহভাগই অর্জিত হয় আরবি ভাষার দেশসমূহ থেকে। এদেশের জনগণ যখন আরব দেশে যায় তখন তারা ভাষা না জানায় বেশ বিড়ম্বনায় পড়ে। তারা যদি ভালোভাবে আরবি ভাষা জানতো তবে লোকগুলো আরব দেশে নিজেদের অবস্থান আরো মজবুত করতে পারতো। তাদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা আরো বেশি আদায় করে নিতে পারতো।  তাই বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে আরো চাঙ্গা করার লক্ষ্যে হলেও আরবি ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়ার নির্লিপ্ততার কারণে বাংলাদেশে আরবি ভাষা দিবসটির প্রতিও কোনো গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয় না।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তো আরবি ভাষা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ইসলামের যে কোনো বিধান আবিষ্কার করতে হলে আরবি ভাষা জানতে হবে। কোরআন ও হাদিসের সঠিক মর্ম বের করতে হলেও আরবি ভাষা অবশ্যই প্রয়োজন। আরবি ভাষা অধ্যয়ন বা আয়ত্ত করা ছাড়া কোনো লোক ইসলামের কোনো বিষয়ের ওপর ফতোয়া দিতে পারবে না। তাফসির বা কোরআনের ব্যাখ্যা অন্যকে শিখাতে হলে বিধানাবলি বলতে হলে অবশ্যই তাকে আরবি ভাষা জানতে হবে। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি আরবি ভাষা সর্বদিক থেকে আমাদের জন্য অতি প্রয়োজন। তাই আমরা আরবি ভাষা শিখার প্রতি আরো উৎসাহী হই এবং শিখি। এ ভাষা আরো বিস্তারের ক্ষেত্রে সরকারেরও প্রদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

আরবি ভাষা আমাদের জীবনের সফলতার জন্য যে গুরুত্ব ও প্রয়োজন তা আমরা সবাই কমবেশ জানি। যে জাতি যে ভাষাকে কেন্দ্র করে জীবন পরিচালিত করে, সেই জাতির ওই ভাষার মধ্যে তাদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-কালচার প্রষ্ফুটিত হয়। একটি জাতির সংস্কৃতি বহন করে সেই জাতির ভাষা। সেভাষা যত মানুষের দৌড় গোড়ায় পৌঁছবে, সাথে সে জাতির সংস্কৃতিও তার কাছে পৌঁছে যাবে। ইসলামের ভাষা আরবি। এ আরবি ভাষায় ইসলামের সংস্কৃতি বহন করছে। ইসলামী সংস্কৃতি বুঝতে হলে আরবি ভাষাকে বুঝতে হবে। বাস্তব সত্য কথা, ভারত উপমহাদেশে দীর্ঘদিন চলেছে ইসলামী শাসন। শত শত বছর ধরে ইসলাম ও মুসলিম বসবাস করছে। কিন্তু যারা ইসলামের ধারক-বাহক তারা আরবী ভাষাকে কতটুকু জনগণের দরবারে পৌঁছাতে পেরেছেন? কতজন মুসলিম আরবি জানে ও বুঝে? এক্ষেত্রে ইংরেজরা সফল হয়েছে। তাদের ভাষা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের আবাল বৃদ্ধা বনিতা সবাই ইংরজি শব্দ ব্যবহার করছে নিত্য দিন। আমাদের আরবি ভাষা ব্যবহারিক দিককে আরো সহজ করে সবার মুখে মুখে করে দেওয়া সময়ের দাবি। আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে আরবি বলা, লেখা ও বুঝার ব্যাপারে আরো উদ্যোগী হতে হবে। মাদরাসার প্রতিটি ছাত্র অনর্গল আরবিতে কথা বলতে পারে, সে দিকে আজও যদি আমরা সজাগ দৃষ্টি না দিই, তবে আর কত?

 

লেখক : পরিচালক, ইসলাহ বাংলাদেশ আশরাফাবাদ, মাদবর বাজার, কামরাঙ্গীর চর, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads