• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলামের দৃষ্টিতে তর্ক-বিতর্ক

  • প্রকাশিত ২৭ ডিসেম্বর ২০২০

মুহাম্মাদ আবু আখতার

 

মানুষ সাধারণত বিভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। ফলে একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-চেতনা একেক ধরনের হয়। এজন্য প্রায়ই একজনের মতের সাথে আরেকজনের মতের অমিল দেখা যায়। এতে পরস্পর মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। প্রত্যেকে তার মতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুক্তি-তর্ক পেশ করে। তর্কপ্রবণতা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য মানুষ সাধারণত তর্কপ্রিয়। আমাদের চারপাশের মানুষের দিকে লক্ষ করলে এর বাস্তবতা অনুধাবন করা যায়। বিভিন্ন প্রকৃতির কয়েকজন মানুষ একত্রিত হলেই তারা তর্ক-বিতর্ক শুরু করে। এমনকী তুচ্ছ বিষয় নিয়েও অনেক মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে তর্ক-বিতর্ক করে থাকে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে মানুষের এ স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণনা করে বলেন, ‘নিশ্চয় আমি এ কোরআনে মানুষকে নানাভাবে বিভিন্ন উপমার দ্বারা আমার বাণী বুঝিয়েছি। মানুষ সব থেকে অধিক তর্কপ্রিয়।’

(সুরা কাহাফ, আয়াত-৫৪)

বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের তর্ক-বিতর্কের কোনো শেষ নেই। একটা শেষ হলে আরেকটা শুরু হয়| এভাবে একের পর এক চলতেই থাকে। এমনকী কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তেও মানুষ পরস্পরের সাথে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত থাকবে। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কেবল একটা ভয়াবহ শব্দের অপেক্ষা করছে, যা তাদেরকে আঘাত করবে তাদের পারস্পরিক বাকবিতণ্ডাকালে।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত-৪৯) শুধু তাই নয়, পাপী লোকেরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনেও শয়তানের সাথে তর্কে লিপ্ত হবে। তারা তাদের পাপের সব দায়ভার শয়তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু শয়তান সে দায়ভার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাবে। তখন আল্লাহতায়ালা তাদের পারস্পরিক বাকবিতণ্ডা করতে নিষেধ করবেন। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তার সঙ্গী শয়তান বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমি তাকে অবাধ্যতায় লিপ্ত করিনি। বস্তুত সে নিজেই ছিল সুদূর পথভ্রান্তিতে লিপ্ত। আল্লাহ বলবেন, আমার সামনে বাকবিতণ্ডা করো না। আমি তো পূর্বেই তোমাদেরকে আজাব দ্বারা ভয় প্রদর্শন করেছিলাম।’

(সুরা কাহাফ, আয়াত-২৭, ২৮)

তর্ক-বিতর্ক মন্দ স্বভাব হলেও দাওয়াতের ক্ষেত্রে উত্তমপন্থায় বিতর্ক করা মন্দ কোনো বিষয় নয়; বরং প্রশংসনীয়ও বটে। মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান জানাতে উত্তমপন্থায় বিতর্ক করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘আপনার পালনকর্তার পথে আহ্বান করুন হিকমাত ও সদুপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহল, আয়াত-১২৫) উত্তমপন্থায় বিতর্কের সর্বোত্তম  দৃষ্টান্ত হচ্ছে নমরুদের সাথে হজরত ইবরাহীম (আ)-এর বিতর্ক। তিনি কতোই না চমৎকারভাবে নমরুদের খোদা হওয়ার দাবিকে বাতিল প্রমাণ করেন এবং তাকে লা-জাওয়াব করে দেন। আল্লাহতায়ালা সবার শিক্ষার জন্য পবিত্র কোরআনে এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন, ‘তুমি কি সে লোককে দেখনি, যে পালনকর্তার ব্যাপারে বিতর্ক করেছিল ইবরাহিম (আ.)-এর সাথে এ কারণে যে, আল্লাহ সে ব্যক্তিকে রাজ্য দান করেছিলেন। ইবরাহিম (আ.) যখন বললেন, আমার পালনকর্তা হলেন তিনি, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সে বলল, আমিই তো জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটিয়ে থাকি। ইবরাহিম (আ.) বললেন, নিশ্চয়ই তিনি সুর্যকে উদিত করেন পূর্ব দিক থেকে এবার তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত কর। তখন সে কাফের হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ সীমালংঘনকারী সমপ্রদায়কে সরলপথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত- ২৫৮)

 

সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে বাতিলকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশে যে বিতর্ক করা হয় তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। বর্তমান যুগে বাতিলপন্থিরা ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধানের বিরুদ্ধে অনেক খোঁড়া যুক্তি উত্থাপন করে তর্ক করছে। বাতিলপন্থিদের এরূপ অপতৎপরতা শুধু বর্তমান যুগেই সীমাবদ্ধ নয়। যুগে যুগে নবী-রাসুলদের হকের দাওয়াতের বিরুদ্ধে একদল লোক সবসময় বাতিলের পক্ষে বিভিন্ন খোঁড়াযুক্তি উত্থাপন করতো। আল্লাহতায়ালা তাদেরকে কঠিন শাস্তির মাধ্যমে পাকড়াও করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের পূর্বে নূহ (আ.)-এর সমপ্রদায় মিথ্যারোপ করেছিল, আর তাদের পরে অন্য অনেক দল ও প্রত্যেক সমপ্রদায় নিজ নিজ পয়গম্বরকে আক্রমণ করার ইচ্ছা করেছিল এবং তারা মিথ্যা বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়েছিল, যেন সত্যধর্মকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। অতঃপর আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম। কেমন ছিল আমার শাস্তি। (সুরা গাফির, আয়াত-৫)

বর্তমানে একদল লোক আছে ধর্মের ব্যাপারে যাদের তেমন কোনো জ্ঞান নেই। কোনো বিষয়ে কোরআন-হাদিস হতে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপনের কোনো যোগ্যতা নেই। অথচ কোনো প্রকার জ্ঞানার্জন ও দলীল প্রমাণ উপস্থাপন ছাড়াই ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে থাকে। এমনকী আলেমদের দলিলভিত্তিক কোনো মতামতও যদি তাদের পছন্দ না হয় তারা এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি পেশ করে। অনেক সময় আলেমদের সমালোচনা করে এবং তাদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়। এটা মারাত্মক অন্যায় কাজ। যারা জ্ঞান ব্যতীত বিতর্ক করে পবিত্র কোরআনে তাদেরকে অবাধ্য শয়তানের অনুসারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর শয়তানের অনুসারীরা অবশ্যই পথভ্রষ্ট এবং জাহান্নামিদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন,‘ কিছু মানুষ অজ্ঞতাবশত: আল্লাহ সম্পর্কে  বিতর্ক করে এবং প্রত্যেক অবাধ্য শয়তানের অনুসরণ করে। শয়তান সম্পর্কে লিখে দেওয়া হয়েছে যে, যে কেউ তার সাথী হবে, সে তাকে বিভ্রান্ত করবে এবং দোযখের আজাবের দিকে পরিচালিত করবে।’ (সুরা হজ্ব, আয়াত-৩,৪) অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘কিছু মানুষ জ্ঞান, প্রমাণ ও উজ্জ্বল কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে। সে পার্শ্ব পরিবর্তন করে বিতর্ক করে, যাতে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করে দেয়। তার জন্য দুনিয়াতে লাঞ্ছনা আছে এবং কিয়ামতের দিন আমি তাকে দহন-যন্ত্রণা আস্বাদন করাব।’ (সুরা হজ্ব, আয়াত-৮ ও ৯)

 

লেখক : প্রাবন্ধিক, ইসলামী কলাম লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads