• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলামে সময়ের গুরুত্ব

  • প্রকাশিত ২৯ ডিসেম্বর ২০২০

মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান

 

 

 

সেই আদিকাল থেকেই সময়কে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অতীত বিলীন হয়ে গেছে, সেটা কোনোভাবেই ফিরবে না। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, সেটা আল্লাহর হাতেই নির্ধারিত রয়েছে। তাই মূল্যবান হলো বর্তমান। প্রতিদিন সকাল থেকে মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্রম শুরু হয়। বিকেল হয়ে রাত গড়ালেই একটি দিনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। এটি মিলিত হয় অযুত অতীতের সাথে। সময়ের এই পরিক্রমাকে পবিত্র  কোরআনেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন,  ‘মোহাম্মদ শুধু একজন রাসুল বৈ তো নয়। তার আগে বহু রাসুল গত হয়েছে। তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা শহীদ হন তবে কি তোমরা উল্টো পায়ে ফিরে যাবে? আর যে ব্যক্তি উল্টো পায়ে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোনো ক্ষতি করবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে থাকবে তাদেরকে তিনি পুরস্কৃত করবেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৪৪)

মানুষের জীবনে সময়ের মূল্য অত্যধিক। বুদ্ধিমান মানুষ দিবসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্যবান মনে করে কাজ সম্পাদন করে থাকেন। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন সকাল বেলা উম্মতের কল্যাণের জন্য দোয়া করে বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লি-উম্মতি ফি বুকুরিহা’। অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমার উম্মতের সবার কাজে বরকত দিন। (তিরমিযি) একদা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত ইবনে উমর (রা.)-কে লক্ষ করে বললেন, ‘হে ইবনে উমর! তুমি দুনিয়াতে এমনভাবে বসবাস করো যেন তুমি অপরিচিত বা মুসাফির।’ হজরত ইবনে উমর (রা.) বলতেন, ‘সন্ধ্যায় উপনীত হলে তুমি সকালের অপেক্ষা করোনা। আর ভোর বা সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করোনা। অসুস্থতার পূর্বেই সুস্থতাকে কাজে লাগাও। আর ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে কাজে লাগাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৬০৫৩) এজন্য হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) রাতে ঘুম থেকে উঠে অজু করতেন এবং নামাজ পড়তেন। এরপর পাখির মতো সামান্য সময় ঘুমাতেন । তারপর উঠে অজু করে নামাজ পড়তেন। তারপর সামান্য সময় ঘুমাতেন। আবার উঠে নামাজ পড়তেন। এভাবেই তিনি বারবার করতেন। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা)

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সময়ের মূল্য প্রদানের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। তিনি সময়ের কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। তিনি প্রতিদিন সকালে বলতেন, ‘আল্লাহুম্মাজ আল আওয়ালা হাজান নাহারি সালাহা, ওয়া আওসাতাহু ফালাহা, ওয়া আখিরাহু নাজাহা’। অর্থাৎ, হে আল্লাহ! দিনের প্রথম অংশকে আমার জন্য উপকারী বানিয়ে দেন, মধ্যম অংশকে আমার জন্য সাফল্যমণ্ডিত করুন, আর শেষ অংশকে আমার জন্য শুভ করুন।’ তিনি আরো বলেন, পাঁচটি বস্তু আসার পূর্বে পাঁচটি বস্তুকে সুবর্ণ সুযোগ মনে কর। ১. মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে, ২. বার্ধ্যকের পূর্বে যৌবনকে। ৩. অসুস্থ হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে। ৪. দরিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতাকে এবং ৫. ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা হাদিস নং-৩৫৪৬০, সহিহ বুখারি)

পার্থিব জীবনের সময় হলো অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, এটি প্রতারণা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আর আখিরাত হলো অনন্তকালের। সেখানে আল্লাহতায়ালা ঈমানদারদের জন্য অসাধারণ ও বর্ণনাতীত সুখ-শান্তির ব্যবস্থা করেছেন। পরকালীন সাফল্যই মুমিনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর পার্থিব জীবন প্রতারণার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৮৫) আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘এই পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক ছাড়া কিছুই নয়। পরকালের গৃহই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত-৬৪) সুতরাং কোনো মানুষ যদি ইহকালকে প্রাধান্য দেয় এবং মনের খেয়াল খুশিতে মত্ত থাকে তার জন্য আখেরাতের হিসাব হবে অত্যন্ত কঠিন। সময়ের মূল্য অনুধাবন করে আল্লাহর দেখানো বিধান মতো চললেই শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচা যাবে। আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে মানুষ ! নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং পার্থিব জীবন যেন তোমাদের ধোঁকায় ফেলে না দেয় এবং প্রবঞ্চক (শয়তান) যেন কিছুতেই তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে প্রবঞ্চিত না করে।’ (সুরা ফাতির-৫)

অনেক সময় মানুষ ভালো কাজকে আগামীকাল করবে বলে ফেলে রাখে। এটি মস্তবড় ভুল ও চরম বোকামি। আল্লাহ বলেন, ‘অতএব দৌড়ে কল্যাণকর বিষয়াদি অর্জন করো। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর তিনি অবহিত করবেন সে বিষয়, যাতে তোমরা মতবিরোধ করতে।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-৪৮) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত ভালো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। হজরত উকবা বিন হারিছ (রা.) বলেন, একবার রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসরের সালাত আদায় করে দ্রুত নিজের ঘরে ফিরে আসেন। ঘরে প্রবেশ করেই দ্রুত বের হয়ে গেলেন। আমি বললাম এমনটি করার কারণ কী? তিনি বললেন, ঘরে একখণ্ড সোনা রেখে এসেছিলাম। রাত পর্যন্ত তা ঘরে থাকা আমি পছন্দ করিনি। কাজেই আমি তা বিতরণ করে এলাম।’ (সহিহ বুখারি)

ইসলামের প্রাথমিক অবস্থা থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত সমস্ত পুণ্যবান সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী, বুযুর্গ ওলামায়ে কেরাম সবাই সময়ের প্রতি যত্নশীল ছিলেন। তারা সময় নষ্ট করাকে আত্মহত্যার মতোই জঘন্য অপরাধ মনে করতেন। হজরত আবু বকর (রা.) বলতেন, ‘সময়ের চক্র যদিও বিস্ময়কর। কিন্তু মানুষের অলসতা আরো বিস্ময়কর। মানুষের উচিত জীবনের সেই দিনটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করা যা এমনভাবে অতিবাহিত হয়েছে যে, সেখানে কোনো নেক আমল করা হয়নি। হজরত উমর ফারুক (রা.) বলতেন, ‘হে আল্লাহ! সময়ের বরকত ও কল্যাণলাভের জন্য আবেদন করছি। তিনি আরো বলতেন, তুমি সন্ধ্যা পেলে সকালের অপেক্ষা করোনা এবং সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করোনা। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬৪১৬) হজরত আলী (রা.) বলতেন, বর্তমানে চলমান দিনগুলো তোমাদের জন্য কিতাব বা আমলনামার মতো। তাই উত্তম আমল দ্বারা উহাকে স্থায়ী করে রাখো।

হজরত আবু ওয়াইল থেকে বর্ণিত, একবার হজরত আম্মার (রা.) আমাদের সামনে খুতবা দেন। খুতবাটি ছিল সংক্ষিপ্ত ও অলংকারপূর্ণ। খুতবা শেষে তিনি মিম্বর থেকে নামলে আমরা তাকে বললাম, আবদুল ইয়াকীন, আপনি তো সংক্ষিপ্ত ও বাগ্মিতাপূর্ণ বক্তব্য রাখলেন। তবে খুতবাটি দীর্ঘ হলে ভলো হতো। তিনি বলেন, নামাজ দীর্ঘ হওয়া ও বক্তব্য সংক্ষিপ্ত হওয়া ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করে। অতএব, তোমরা নামাজ দীর্ঘ করো বক্তব্য সংক্ষেপ করো। কোনো কোনো বক্তৃতায় জাদুকরি প্রভাব রয়েছে। হজরত দাউদ তায়ী (র.) খাদ্য গ্রহণের সময় রুটির পরিবর্তে ছাতু খেতেন। তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, দাঁত দিয়ে রুটি চিবিয়ে খেতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। আর ছাতু নরম হওয়ায় সময় লাগে না। রুটি চিবিয়ে না খেয়ে ছাতু খেলে ওই সময়ে পঞ্চাশটি আয়াত তিলাওয়াত করা যায়। (সহিহ মুসলিম) বিশিষ্ট সাহাবী হজরত আবু দারদা (রা.) মৃত্যুশয্যায় অসুস্থ হয়ে বলেছিলেন, ‘তিনটি বিষয় না থাকলে দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে চাইতাম না। ১. সাওম বা রোজা পালনকালে দ্বিপ্রহরের তীব্র গরমের তৃষ্ণা। ২. গভীর রাতে সিজদাহ দেওয়া। ৩. জিকিরের মজলিশে আলেমদের সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসা।

মুমিন ব্যক্তি জীবনের কোনো মুহূর্ত নষ্ট হোক তা পছন্দ করে না। কেননা জীবনের আয়ু অতি সামান্য। পুরো জীবনটাই হলো পরীক্ষা ও যাছাইয়ের মুহূর্ত। আখিরাতে এর পুরস্কার আল্লাহর হাতেই। বিখ্যাত তাবেয়ী হজরত হাসান বসরী (র.) বলেন, ‘আমি এমন লোকদের (সাহাবাদের) সংশ্রবে থেকেছি, যারা নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সোনা-রূপার চাইতেও মূল্যবান মনে করতেন।’ অথচ অনেক মানুষ সময়ের ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুটি নেয়ামত দ্বারা উপকার পেতে অনেক মানুষ ব্যর্থ হয়। তাহলো সুস্থতা ও অবসর। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬০৪৯) তবে কারো অধিকার ও কর্তব্য ক্ষুণ্ন না করে শরীয়ত সমর্থিত পন্থায় বিনোদন ও বিশ্রাম করতে অসুবিধা নেই। কেননা, উক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে কাজে উদ্যমতা তৈরি হয়, কর্মের প্রতি নতুন করে স্পৃহা তৈরি হয়।

 

লেখক : সহকারি শিক্ষক (ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads