• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

অন্যায্য মুনাফা বড় অপরাধ

  • প্রকাশিত ০৩ জানুয়ারি ২০২১

এম জহিরুল ইসলাম

 

 

 

মহান আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন। তাদের দিয়েছেন ভালো-মন্দের স্বাধীনতা, যা অন্য কোনো সৃষ্টিকে দেওয়া হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামও সকল অঙ্গনে মানুষের স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করেছে। জাহেলি যুগে যখন হাট-বাজারে মানুষকে ক্রয়-বিক্রয় করা হতো তখন ইসলাম এসে এ জঘন্যতম দাসপ্রথার রীতিকে চিরতরে উৎখাত করেছে। এমনকি দাসপ্রথা উচ্ছেদের লক্ষ্যেই ইসলাম বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি বা জরিমানাস্বরূপ কোনো গোলাম বা দাসকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মানুষ যত ধরনের প্রক্রিয়াতে সম্পদ আহরণ করে থাকে সেগুলোর মধ্যে ব্যবসাতে মানুষের স্বভাবগত স্বাধীনতা বজায় থাকার কারণে ইসলাম ব্যবসাকে উপার্জনের সর্বোত্তম মাধ্যম বলে ঘোষণা করেছে। আল্লাহপাক বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।’ (সুরা আল বাকারা-২৭৫)। হাদিসে এসেছে, হজরত রাফে ইবনে খাদিজ (রা.) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, একদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল, মানুষের যাবতীয় উপার্জনের মধ্যে কোনটি সবচেয়ে পবিত্র?’ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘মানুষ নিজ হাতে যা কামাই করে এবং হালাল ব্যবসার মাধ্যমে যা উপার্জন করে।’ (মিশকাত)।

ব্যবসার প্রসঙ্গ এলেই সেখানে অন্ততপক্ষে বিক্রেতা, মূলধন ও ক্রেতার প্রয়োজন হয়। আর মূলধন বলতে টাকা-পয়সা ও বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য ইত্যাদিকে বোঝায়। সাধারণত কোনো বাজারে, কোনো ব্যবসায় বা কোনো ক্রয়-বিক্রয়ে পণ্যের মালিক বা বিক্রেতাই অধিক প্রভাবশালী হয়। ক্রেতারা বহুলাংশেই তার মুখাপেক্ষী থাকে। তাই বিক্রেতা ইচ্ছা করলে অনেক সময়েই প্রতারণা, সীমা লঙ্ঘন বা ক্রেতাদের ঠকাতে পারে। বিক্রেতা মাপে কম দিতে পারে, অচল বা নষ্ট হয়ে যাওয়া পণ্য দিয়ে দিতে পারে। স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি দাম রাখতে পারে। বর্তমানে ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসায় এসব উৎপাতই বিদ্যমান রয়েছে। ভেজালবিরোধী অভিযান শুরুর পর এটা প্রমাণিত যে, সর্বত্র ভেজাল আর ভেজালের জয়জয়কার। মাপে কম দেওয়া পুরাতন কিছু নয়। আর দ্রব্যমূল্য তো গগনচুম্বী। ইসলাম যে ব্যবসাকে বৈধ এবং উত্তম ঘোষণা করেছে তার স্বরূপ এত ভয়ংকর ছিল না। বাজারে কোনো কিছু কিনতে যাওয়ার ইচ্ছে করলে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ প্রায় সব ক্রেতাকেই অনেকটা বিচলিত হতে হয়। সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় এই বুঝি কোনো ঠকবাজ ঠকিয়ে দিল। সব সময় প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা করতে হয়। অথচ ইসলাম ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়েরই সন্তুষ্টি সাধনের নির্দেশ দিয়েছে। কারো কোনো ভয় থাকবে না, কেউ প্রতারণার আশঙ্কা করবে না।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সন্তুষ্টি সহকারে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ।’ (সুরা আন নিসা-২৯)। এ আয়াতে ‘আন তারাদিন’ দ্বারা ব্যবসায় ক্রেতা ও বিক্রেতার সকল প্রকার উদ্বেগ উৎকণ্ঠাকে দূর করা হয়েছে। এছাড়া পরিমাপে কম দেওয়াকে জঘন্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে আল্লাহপাক বলেন, ‘ধ্বংস সে সকল পরিমাণকারীর জন্য, যারা লোকের কাছ থেকে পরিমাণে পুরোপুরিই গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের দেওয়ার বেলায় পরিমাণে কম দেয়।’ (সুরা আল মুতাফ্ফিফিন : ১-৩)।

মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্যের অবস্থান সর্বপ্রথমে। কারণ সবার আগে মানুষের জীবন বাঁচাতে হয়। তারপরই বাকি সকল প্রয়োজন পূরণ করার কথা আসে। আল্লাহপাক মানুষ সৃষ্টি করার বহুকাল পূর্বেই মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা করে থাকেন। এমনকি দুনিয়াতে যারা অনবরত মহান আল্লাহর সীমা লঙ্ঘনে লিপ্ত তাকে তাদেরও আল্লাহতায়ালা আহার দান করেন। আমরা পৃথিবীতে আগমনকারী অবাধ্য এমন অনেক জাতির কথা জানি যাদের সকলকেই আল্লাহপাক রিজিক প্রদান করেছেন। তাই এটা প্রমাণিত যে, আজকে যারা নানা উপায়ে মানুষের খাদ্যবস্তুর সংকট সৃষ্টি করে বা মানুষের প্রধান মৌলিক চাহিদা পূরণে বাধা সৃষ্টি করে, তারা অত্যন্ত নিকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী। কারণ কারো সঙ্গে শত্রুতা থাকলেও আহার হরণ করে তার বহিঃপ্রকাশ করা যায় না। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, গম, আটা, তৈল, ডিম, দুধ, মাছ, মাংসসহ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যে মূল্যবৃদ্ধি করে এসব লোক মারাত্মক অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। আর এ কাজের জন্য তাদের পরকালে সীমাহীন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির জন্য এসব মন্দ চরিত্রের ব্যক্তিরাই নেপথ্য নায়ক। দিন দিন অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধির ব্যাপারে বিশেষজ্ঞগণ যেসব কারণ উল্লেখ করেন এর মধ্যে পণ্যদ্রব্য গুদামজাত করা অন্যতম। এর মূল লক্ষ্য থাকে, বাজারে পণ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা, যাতে করে পণ্যের দাম দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করবে সে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে।’ (মুসলিম)। অন্যত্র মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লেখ করেন, ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ রাত্র গুদামজাত করল সে আল্লাহপাকের জিম্মাহ থেকে মুক্ত হয়ে গেল।’

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বিক্রেতাদের সর্বদা অধিক মুনাফা করার প্রবণতা অন্যতম। বিক্রেতাদের অনেকেরই প্রবণতা এমন যে, কোনো দ্রব্যে চার পাঁচগুণ লাভ করে একদিনে টাকার কুমির বনে যাওয়া। সব সময়ের জন্য যে-কোনো দ্রব্যের একটি নির্দিষ্ট মূল্য নিরূপণ করে দেওয়া অনুচিত। কারণ, দেশের সব স্থানে ওই দ্রব্যটি বিপণনে সমান শ্রম এবং পুঁজির প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি সব স্থানে এর চাহিদাও সমান থাকে না। তাই দামও ভিন্ন ভিন্ন হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দামের এ সীমিতকরণ না থাকায় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী কোনো ধরনের বিবেকতাড়িত না হয়ে পণ্যের মূল্য বহুগুণে বৃদ্ধি করে বিক্রি করে বা অসহায় ক্রেতা সাধারণ ওই মূল্যে কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি ক্রয়ে বাধ্য হয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতার পক্ষ থেকে মানবতাবোধের অভাবে এমনটি হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এটাকে সীমা লঙ্ঘন বা ক্রেতা জনতার ওপর জুলুম নামে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। আপনি ১০০ টাকার কোনো একটি পণ্যে ৫/১০ টাকা লাভ করতে পারেন। কিন্তু এটি যখন ২০০ টাকা এমনকি ৩০০ টাকা লাভ করার লোভ আপনাকে পেয়ে বসবে সেখানেই আপনার মানবতাবোধ লোপ পাচ্ছে। আর আপনার এ লোভ চরিতার্থ করতে গিয়ে বাজার ব্যবস্থায় মারাত্মক ধস নামছে। নির্দিষ্ট পণ্যটি এক সময় জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে ব্যাপকহারে তাকওয়া (আল্লাহভীতি) জাগ্রত করা এবং পরকালীন জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্রত করে জনগণের মৌলিক মানবীয় গুণাবলি জাগ্রত করতে হবে। অনেক সময় আইনকানুন থাকার পরও এমনকি একটি ধার্মিক সমাজেও বিভিন্ন কারণে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত এবং ফলপ্রসূ বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। অতিরিক্ত খবরদারি নয়, এ ক্ষেত্রে কেউ যাতে এ জাতীয় অপরাধে লিপ্ত না হয় সে উদ্দেশ্যেই সব সময়ের জন্য যথাযথভাবে বাজার পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে মনিটরিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনবোধে সরকার ভর্তুকি দিয়ে নির্দিষ্ট পণ্য স্বল্পমূল্যে বা ন্যায্যমূল্যেও বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারে।

আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কৃষি প্রধান এ দেশে এসব দুর্যোগ অনেক সময় আবাসন এবং প্রাণের ক্ষতি সাধন করলেও সবকটিই কৃষিপণ্যের সীমাহীন ক্ষতি সাধন করে থাকে। তাই কাঙ্ক্ষিত সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়। এমনকি উৎপাদিত এবং বিক্রয়যোগ্য ফসলাদিরও ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। স্বভাবতই এক্ষেত্রে অনেক চাহিদার মুখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায় হুহু করে। তাই প্রত্যেক বছরে এসব প্রায় নিশ্চিত দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি সরকার এবং সাধারণ জনগণের আগে থেকেই ব্যাপকহারে গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে দুর্যোগ-পরবর্তী অবস্থার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে সর্বাপেক্ষা অধিক হারে। এসব ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যবসায়ী সমাজের নীতি-নৈতিকতারও উন্নতি দরকার। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। 

 

লেখক : আলেম, সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads