• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

মসজিদে নববী : মাটির ঘর থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ (২)

  • প্রকাশিত ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

তারিকুল ইসলাম

 

পূর্ব প্রকাশের পর...

‘হজরত মোহাম্মদ ও মদিনার নগরায়ণ’ শীর্ষক এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানানো হয়, মসজিদে নববীর বর্তমান আয়তন নির্মাণকালীন আয়তনের চেয়ে প্রায় শত গুণ বেশি। ঐতিহাসিকগণ বলেন, মসজিদের বর্তমান পরিধি প্রাচীন মদিনা নগরীর প্রায় সবটুকু অঞ্চল বেষ্টন করে নিয়েছে। ড. মুহাম্মদ ওয়াজেদ আখতার লিখেছেন, মসজিদে নববীর বহিরাংশ জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে মিশেছে, অথচ জান্নাতুল বাকী এক সময় প্রাচীন মদিনা নগরীর বাইরে ছিল। এজন্য একথা বলতে সমস্যা নাই যে, বর্তমানে মসজিদে নববী (সা.) সম্পূর্ণ প্রাচীন মদিনায় বিস্তৃত হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সর্বপ্রথম দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) মসজিদের সংস্কারে হাত দেন। ভীড়ের কারণে ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এটির সম্প্রসারণ করেন। মসজিদের চারপাশে জমি ক্রয় করে তিনি এর আয়তন বৃদ্ধি করেন। তবে যেদিকে উম্মাহাতুল মুমিনিনদের গৃহ ছিল, সেদিকটা অপরিবর্তিত রাখা হয়। এরপর ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে (২৯ হিজরি) তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.)ও মসজিদে নববী সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করেন। সাহাবায়ে কেরামের পরামর্শক্রমে তিনি সর্বপ্রথম খোদাইকৃত পাথর ও প্লাস্টারের দেয়াল তৈরি করেন। খোদাইকৃত পাথর ও লোহার ব্যবহারে পিলার ও স্তম্ভ স্থাপন করেন। আর ছাদ নির্মাণ করেন কাঠ দিয়ে।

৭০৭ সালে (৮৮ হিজরি) তৎকালীন খলিফা উমাইয়া শাসক ওলিদ ইবনে আব্দুল মালিকের নির্দেশে মক্কার গভর্নর ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ করেন। এর পরিধি বৃদ্ধি করে ছয় হাজার চারশত চল্লিশ বর্গমিটার করেন। তিনি মসজিদে চারটি মিনার ও একটি মেহরাব স্থাপন করেন। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ স্তম্ভগুলোকে মরমর পাথর ও সোনার কারুকাজ করেন। এসময় স্তম্ভের সংখ্যা ছিল ২৩২ টি। এরপর আব্বাসি খলিফা আল মাহদি ১৬১-১৬৫ হিজরিতে মসজিদের কাজ করেন। মসজিদের আয়তন আট হাজার আটশত নব্বই বর্গমিটারে উন্নীত হয়। আল মাহদি ৬০ টি জানালা ও ২৪ টি দরজা লাগান।

মামলুক শাসনামলেও মসজিদে নববী (সা.)-এর সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়। প্রধান চারটি ফটক ব্যতীত অন্য দরজাগুলোকে পিতল দ্বারা নকশা ও সজ্জিত করা হয়। উসমানি খলিফা সুলতান সুলেমান গম্বুজ মেরামত করেন এবং তার উপর সোনায় মোড়ানো চাঁদ স্থাপন করেন। কৃত্রিম চাঁদ স্থাপন মূলত শুরু হয় এর আগে মামলুক আমলে। ১২২৮ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গম্বুজটি সবুজ রঙে আবৃত করেন। যা এখনো সবুজ রঙেই আচ্ছাদিত রয়েছে। ১২৭৭ হিজরিতে ফাটল দেখা দিলে সুলতান আব্দুল মাজিদ পুনরায় মসজিদের সংস্কার করার প্রতি উদ্যোগী হন এবং কাজ সম্পন্ন করেন। এরপর মসজিদের আয়তন বেড়ে ১০ হাজার তিনশত তিন বর্গমিটার হয়। আল জাজিরার তথ্যানুযায়ী এসময় তিনি পাঁচটি নতুন দরজা সংযুক্ত করেন এবং ১১ মিটার পর্যন্ত প্রাচীরের উচ্চতা বৃদ্ধি করেন। তা ছাড়া ১৭০ টি গম্বুজ ও ৬০০ টি তেলপ্রদীপ স্থাপন করা হয়।

ঐতিহাসিক সুলতান গালিব কুয়েতি জানান, আরব উপদ্বীপের একমাত্র ও সর্বপ্রথম স্থাপনা হিসেবে ১৯০৯ সালে (১৩২৭ হিজরি) মসজিদে নববী (সা.)-তে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। সৌদি যুগ আরম্ভ হলে বাদশাহ আব্দুল আজিজ আল সৌদ ১৯৫০ সালে মসজিদে নববীর পরিধি ১৬ হাজার তিনশত ২৭ বর্গমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। এসময় মসজিদের স্তম্ভ ছিল ৭০৬ টি ও গম্বুজ ছিল ১৭০টি। বাদশাহ আব্দুল আজিজের জামানায় বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে মসজিদে নববীর এক নবযুগের সূচনা হয়। বিশেষ একটি স্টেশন থেকে রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা মসজিদে বিদ্যুৎ সরবারাহ করা হতো। মসজিদে নববীর মুখপাত্র আল হাত্তাব জানন, এসময় এখানে অন্তত দুই হাজার চারশত সাতাশটি বাতি ছিল।

আরব নিউজ জানায়, ১৯৭৩ সালে বাদশাহ ফয়সাল মসজিদের পশ্চিম দিকে প্রায় সাড়ে পঁয়ত্রিশ হাজার বর্গমিটার জায়গার বরাদ্দ দেন এবং সমগ্র এলাকাজুড়ে বৈদ্যুতিক পাখা, সাউন্ড সিস্টেম ও বিশেষ ছাতা স্থাপন করেন। ১৩৯৮ হিজরি সনে বাদশাহ খালিদ বিন আব্দুল আজিজের সম্প্রসারণের পরে বাদশাহ ফাহাদ ফের ১৪০৫-১৪১৪ হিজরিতে মসজিদে নববীর পুনঃসংস্কার করেন। এসময়ই মসজিদের ভেতরের দরজাগুলো প্রশস্ত করা হয় এবং চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন করা হয়। এতে মসজিদের সর্বমোট দরজা সংখ্যা ৮৫ টিতে গিয়ে দাঁড়ায়। এরমধ্যে গম্বুজ, চারটি মিনারা ও ১৩ টি দরজাকে বিশেষ সাজে সজ্জিত করা হয়। সর্বশেষ এবং সবচেয়ে বড় সম্প্রসারণের কাজটি করেন বাদশাহ আব্দুল্লাহ। ২০১২ সালে তাঁর সংস্কারের পর মসজিদে নববীতে একইসঙ্গে প্রায় বিশ লাখ মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা হয়। বাদশাহ আব্দুল্লাহর পরে প্রিন্স সালমান সৌদির শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনিও পূর্ববর্তীদের পদাঙ্ক অনুসরণে মসজিদে নববীর ‍উন্নয়ন অব্যাহত রাখেন। নির্দেশ দেন, হজ্ব ও ওমরাহ পালনকারীদের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে মসজিদে নববীর যাবতীয় সংস্কারের।

স্মৃতিবিজড়িত মিম্বর : যে স্থানে দাঁড়িয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের সামনে খুতবা দিতেন, এটাকে মসজিদে নববীর সবচেয়ে প্রধান ও পবিত্র জায়গাগুলোর মধ্যে শুমার করা হয়। মুবারকপুরী বলেন, মসজিদে নববীর সর্বপ্রথম মিম্বরটি তৈরি করা হয় খেজুরের তক্তা দিয়ে। এতে তিনটি ধাপ বা স্তর ছিল। রাসুলের ওফাতের পরে পরবর্তী খলিফাগণও এই মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। হজরত আবু বকর ও ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে তাঁরা দুজনেই মিম্বরের দ্বিতীয় সিঁড়িতে আরোহণ করে খুতবা প্রদান করতেন। হজরত ওসমান শুরুতে প্রথম সিঁড়িতে পরবর্তী সময়ে রাসুলের মতোই তৃতীয় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে খুতবা দিয়েছেন। কিন্তু ৮৮৬ হিজরিতে আগুন লাগার ঘটনায় মহানবীর মিম্বরটি পুড়ে যায়। এরপর মদিনাবাসী ইট দিয়ে একটি মিম্বর তৈরি করেন। মামলুক শাসনামলে সুলতান কায়েতবাই মরমর পাথরের একটি সুদৃশ্য মিম্বর প্রেরণ করেন।

মেহরাব : ইমাম সাহেব যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজের ইমামতি করেন, ওই জায়গাকে মেহরাব বলা হয়। মসজিদে নববীতে মেহরাব দুইটি। একটি হলো-মসজিদ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে নির্মিত মেহরাব-যেখানে দাঁড়িয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামতি করতেন। এই মেহরাবটি মিম্বরের নিকটবর্তী। বর্তমানে এখান থেকে আজান দেওয়া হয়।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা : রওজা অবস্থিত জায়গাটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিম্বর ও গৃহের মধ্যবর্তী স্থান। বুখারি শরিফে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার গৃহ ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের একটি বাগান। রাসুলের রওজা সবসময় খোলা থাকে। দর্শনের জন্য পুরুষ ও নারী তীর্থযাত্রীদের আলাদা আলাদা সময় নির্ধারিত রয়েছে। এখানে মুসলিম নারী-পুরুষ নফল নামাজ আদায় করেন এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরূদ ও সালাম নিবেদন করেন। মসজিদের অন্যান্য স্থানের তুলনায় রওজায়ে আতহারকে আলাদা সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে মণি-মুক্তা ও হিরা-জহরত। তা ছাড়া এখানের গালিচা ও অন্যান্য বস্তুও খুবই দামি, সুন্দর। হারামাইন শরিফাইনের ব্যবস্থপনা পরিষদ জানিয়েছেন, রওজা শরিফের আয়তন তিনশত ত্রিশ বর্গমিটার। দৈর্ঘে বাইশ মিটার এবং প্রস্থে পনেরো মিটার। রওজায় সবসময় সিকিউরিটির জন্য কর্মকর্তাগণ উপস্থিত থাকেন। তাদের কাজ হলো-এটিকে পরিচ্ছন্ন রাখা এবং ওইসব মানুষদের ঠেকানো যারা রওজায় এসে অবাঞ্ছিত কাজে লিপ্ত হতে চায়।

সবুজ গম্বুজ : মসজিদে নববীর অন্যতম আকর্ষণ হলো-রওজার উপর নির্মিত সবুজ গম্বুজ। এটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর দুই সাথী আবু বকর ও ওমর (রা.)-এর সমাধির উপর ছায়া দান করছে। আলি ইবনে আহমদ আল-সামহুদি তাঁর গ্রন্থ ওয়াফা আল ওয়াফাতে লিখেছেন, রাসুলের রওজার উপরে সর্বপ্রথম গম্বুজ নির্মাণ করা হয় ৬৭৮ হিজরিতে। সুলতান কালাউন এটি কাঠ দিয়ে নির্মাণ করেন। সবুজ গম্বুজটি নিচে বর্গাকৃতি এবং উপরে অষ্টভূজ আকৃতিতে তৈরি করা হয়েছে। আল জাজিরা এনসাইক্লোপিডিয়ার তথ্যমতে, মসজিদে নববীতে আগুন লাগার পর পুনরায় গম্বুজটি নির্মাণ করা হয়। বলা হয়, ওসমানি খলিফা সুলতান গাজি মাহমুদ এটির পুনঃনির্মাণ করেন। রাফাত পাশার ডায়েরির সূত্রে ড. আখতার বলেন, ১৮৩৭ সালে গম্বুজে সবুজ রঙ করার আগে দীর্ঘকাল তাতে সাদা রঙে আচ্ছাদিত ছিল, এরপর কিছুদিন বেগুনি-নীল ছিল। পরে এটিকে সবুজ রঙ দেওয়া হয়।

লাইব্রেরি : মসজিদে নববীতে একটি সুদৃশ্য পাঠাগার রয়েছে। ১৩৫২ হিজরিতে এটি নির্মাণ করেন আওকাফ ডাইরেক্টর আবিদ মাদানি। এখানে অনেকগুলো কিতাব আছে যেগুলো পাঠাগার নির্মাণের আগে থেকেই মসজিদে নববীতে পঠিত হতো। পাঠাগারের পাশাপাশি এই প্রকল্পে অডিও সেকশন রয়েছে। এখানে মসজিদে নববীর ক্লাস, খুতবা এবং ইবাদত সংরক্ষণ করা হয়। টেকনিক্যাল সেকশনে পরিচালনার কাজ করা হয়। এখানে বহু পুরনো দিনের দুর্লভ অনেক বইপুস্তক সংরক্ষিত আছে। অধ্যয়নের জন্য নারী-পুরুষের জন্য আলাদা কক্ষসহ আধুনিক প্রায় সব ধরনের সুবিধা রয়েছে এই পাঠাগারে। হজ্বের মৌসুমে অসংখ্য দর্শনার্থী এখানে জ্ঞানপিপাসা নিবারণের জন্য আসেন। সূত্র: বিবিসি উর্দু

 

লেখক : আলেম, গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads