• শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব

  • প্রকাশিত ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মুফতি মুহিব্বুল্লাহ সাকী

 

 

সব প্রশংসা সেই মহান রাব্বুল আলামীনের জন্য, যিনি আমাদেরকে পরস্পর মনের ভাব প্রকাশের জন্য কথা বলার শক্তি দান করেছেন এবং বাংলা মায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করে বাংলায় ভাষাভাষী হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। ভাষা মহান আল্লাহতায়ালার অনেক বড় একটি নিয়ামত। যার মাধ্যমে আমরা নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকি। বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষায় একমাত্র সম্ভব মানুষের হূদয়ের মণিকোঠায় জায়গা করে নেওয়া। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ, যিনি কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তাঁকে (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম) ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সুরা রহমান, আয়াত-১, ২, ৩, ৪)

ইসলামে মাতৃভাষায় গুরুত্ব অপরিসীম। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে মাতৃভাষা সম্পর্কে অনেক আয়াত নাজিল হয়েছে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম যেখানে রয়েছে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছুর সমাধান। নৈতিক চরিত্র গঠনের পাশাপাশি রয়েছে মানুষের সাথে সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় কথা বলার দিক নির্দেশনা। মানুষ মানুষের মাঝে নেই কোনো ব্যবধান, বর্ণবাদিতা ও বৈষম্যতা। সব মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। আমরা সবাই একই অঙ্গের ন্যায়। বিভিন্ন জাতি-উপজাতি ও ভূখণ্ডের পার্থক্যের কারণে ভাষার ভিন্নতা হলেও তা কখনো আমাদের মাঝে ভেদাভেদ সৃষ্টি করেনি। ইসলাম সব সময় সমাজের প্রচলিত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে আসছে। যদি তা ইসলাম ও শরীয়ত পরিপন্থী না হয়। মাতৃভাষা যে কোনো দেশের যে কোনো সমাজের প্রচলিত ভাষা হতে পারে। ইসলাম সব ভাষাকে অনুমোদন দিয়েছে। পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাঁর আরো এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। (সুরা রুম, আয়াত-২২)

পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই সর্বযুগেই সব নবী-রাসুলগণ নিজ নিজ মাতৃভাষায় মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছেন। জান্নাতের সুসংবাদ ও জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আমি সকল রাসুলকে তাঁর সম্প্রদায়ের ভাষাভাষীর রূপে পাঠিয়েছি, যেন তাদেরকে (ধর্মীয় আদেশ-নিষেধ) স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে পারে।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত-৪) এ আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে হলে মাতৃভাষায় শিক্ষিত হওয়া কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যকীয় কাজ। প্রতিটি মানুষকে সমাজসেবক ও ধর্মীয় স্কলার হতে হলে সর্বপ্রথম তাকে মাতৃভাষায় পারদর্শী হতে হবে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশ বংশের ভেতরে ভাষা ও সাহিত্য প্রাঙ্গণে ছিলেন সর্বাধিক নৈপুণ্যের অধিকারী। ছিলেন আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আনা আফসাহুল আরব।’ তিনি ছিলেন সবচেয়ে স্পষ্টভাষী ও মিষ্টভাষী। তিনি ভাষা আর আদর্শিক চরিত্রের মাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছেন নবীন-প্রবীণ, বৃদ্ধা-বণিতা সব মানুষের হূদয়ের গহীনে। শিশু-কিশোর, বড়-ছোট সবার মন উন্মুখ হয়ে থাকতো তার জবান মোবারকের দিকে, যেভাবে সমুদ্রের তীরে ঝিনুকগুলো এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষায় থাকে। পবিত্র  কোরআনুল কারীম আরবি ভাষায় তথা, নবীজির মাতৃভাষায় নাজিল করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি কোরআনকে আপনার মাতৃভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে মুত্তাকীদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিতে পারেন এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে জাহান্নামের ভয় দেখাতে পারেন।’ (সুরা মারিয়াম, আয়াত-৯৭) অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এমনিভাবে আমি আরবি (মাতৃ) ভাষায় আপনার প্রতি  কোরআন নাজিল করেছি যাতে আপনি মক্কা ও তার আশপাশের লোকদেরকে সতর্ক করেন।’ (সুরা শুরা, আয়াত-৭)

ইসলাম পৃথিবীর সব মাতৃভাষাকে অনুমোদন দিয়েছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। এই ভাষার রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল রক্তিম ইতিহাস। যা পৃথিবীর বুকে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল। শান্তি বর্ষিত হোক রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ও অন্যান্য বীর সন্তানদের উপর। যারা ১৯৫২ সালে একুশে  ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর জুলুম নির্যাতন ও বুলেটের ভয় না করে মাতৃভাষা রক্ষার্থে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, উপরমহল থেকে নিচ পর্যন্ত আমরা সবাই বাংলাভাষা থেকে দূরে সরে গিয়ে ইংরেজি ভাষাকে নিজেদের আইকন বানিয়ে নিয়েছি। এটা সরাসরি ভাষার প্রতি উদাসিনতা ও মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা এবং অবমূল্যায়ন করার শামিল। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত এই মাসে ভিনদেশি ভাষার প্রবণতা কমিয়ে আনতে হবে।

প্রিয়পাঠক! মাতৃভাষায় কথা বলা সুন্নতে নববী। সবাইকে মাতৃভাষার গুরুত্ব দিতে হবে। ভাষার বিশুদ্ধতায় সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা জরুরি। এ ভাষায় মানুষের অন্যান্য জ্ঞানের বিকাশসাধনের পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষার প্রচারপ্রসার ঘটাতে সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে মাতৃভাষার গুরুত্ব বুঝে বুকে ধারণ করার তৌফিক দান করুন। আমিন!

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads