• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

নবীজির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতি

  • প্রকাশিত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আহনাফ আবদুল কাদির

 

 

 

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগমনের পূর্বে আরবজাতি জ্ঞানের দিক থেকে ছিল চরম মূর্খ ও অজ্ঞ। আচরণের দিক থেকে ছিল বর্বর ও অসভ্য। এমন একটি জাতিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খোদাপ্রদত্ত জ্ঞানের আলোকে গড়ে তুলে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেন। সামাজিক ও চারিত্রিক দিক থেকে তিনি শুধু মানুষের আদর্শ শিক্ষকই ছিলেন না; বরং সবার জন্য অনুকরণীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত কিংবদন্তী ছিলেন নবীজি। একজন আদর্শ পিতা, বিশ্বস্ত বন্ধু, ন্যায়পরায়ণ শাসক, আমানতদার ব্যবসায়ী সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে তিনি এতটাই খাঁটি ও নিখুঁত ছিলেন যে, যা তার শত্রুরাও অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য হতো। বিভিন্ন ইসলামি সংস্কার ছাড়াও পৌত্তলিকতা, মদ্যপান, জুয়াখেলা, নারীর অবমূল্যায়ণ প্রভৃতি নিষিদ্ধকরণ এবং তার ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মানবিক রাষ্ট্রনীতি, যা বিশ্ববাসী ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় আজো অনুসরণ করছে। বিশ্বে এ পর্যন্ত অনেক শিক্ষক, পথপ্রদর্শক ও সমাজসংস্কারক এসেছেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনকালে যে ঈর্ষণীয় সফলতা অর্জন করেছেন আর কারো পক্ষেই তা সম্ভব হয়নি।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রত্যক্ষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বৈষয়িক ও নৈতিক জ্ঞানের সমন্বয়ে একদল বিশেষজ্ঞ কর্মী তৈরি করেন, যারা বিশ্বের বুকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী-গুণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আজো জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বুদ্বিজীবী সমাজ তাদের উদাহরণ দিয়ে থাকে। বিশ্বশাসনে ওমরের মতো প্রধানমন্ত্রী, আবু বকরের মতো দয়ালু শাসক আর আলীর মতো জ্ঞানতাপস এবং আরো অসংখ্য মনীষীদের স্বর্ণখচিত ইতিহাস আজো গবেষকদের মুখেমুখে ও লেখনীতে জ্বলজ্বল করছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লক্ষাধিক সাহাবীর প্রত্যেকেই ছিলেন এক একজন জ্ঞানের মশাল। পরবর্তীতে বিশ্বের সর্বত্র তারা জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। শিক্ষার এই মূল প্রেরণা তারা লাভ করেছেন  কোরআনুল কারীমের অসংখ্য নির্দেশনা ও নবীজির অনুপ্রেরণা থেকে। মহাগ্রন্থ  কোরআনুল কারীমের সর্বপ্রথম নির্দেশনাই ছিল ‘ইকরা’, পড়ো। ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল লাযি খালাক’। পড়ো তোমার রবের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানবজাতির অনুকরণীয় শিক্ষক। ওহীর জ্ঞানালোকে মানুষের চিন্তারাজ্যে বিপ্লব সাধনে তিনি সফল হয়েছিলেন। নিজেকে তিনি শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তাই একদিন এক শিক্ষার আসরে তিনি বলে উঠলেন, আমাকে শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল অতুলনীয়। গুণগত মানে আজো তিনি জগৎসেরা শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। সমগ্রজীবনের তেষট্টি বছর বয়সের মধ্যে মাত্র তেইশ বছর তাঁর শিক্ষকজীবন হিসেবে সমাদৃত। যা তাঁর নবুওতী জিন্দেগি হিসেবে পরিচিত। এই তেইশ বছরে নবীজির সংস্পর্শে এসেছে বিভিন্ন গোত্র, দল ও উপদলের মানুষ। তাঁর কাছে আসা এসব গোত্রের মধ্য থেকে কোনো কোনো গোত্রের মধ্যে চলমান ছিল বৈরী সম্পর্ক, ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে চলে আসা কোন্দল ও মারামারি। ছিল ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক ও বিশ্বাসগত দ্বন্ধ। এতো মত ও পথের মানুষ থাকা সত্ত্বেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবাইকে আসমানি শিক্ষার আলোকে একই পতাকার নিচে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছেন। একই উৎস থেকে আগত আদম ও হাওয়ার সন্তানদেরকে আবার একই কেন্দ্রে জড়ো করেছেন। যখন যে বা যারা তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, তার শিক্ষার আসরে সময় দিয়েছেন এবং তার সঙ্গে মিশেছেন তারাই হয়ে উঠেছেন জগৎবিখ্যাত জ্ঞানী ও গুণীজন। তার এসব শিক্ষার্থীদের ‘সাহাবী’ বলা হয়।

পুরুষ সাহাবীদের পাশাপাশি নারীরাও দীন ও শরিয়তের ওপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিনী উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) শুধুমাত্র দীন ও শরীয়তেই নয় বরং সমরশাস্ত্র ও বাগ্নিতার ওপর ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। এমনকী সে যুগে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর যে কোনো অখ্যাত মহিলাগণও ভালো জ্ঞান রাখতেন। ইসলামের ইতিহাসে এরকম অসংখ্য মহিলার উদাহরণ রয়েছে। এমনি একটি উদাহরণ আমরা পাই, হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে। একবার তিনি মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে যুবক-যুবতীদের বিয়ের সুবিধার্থে মহরানার পরিমাণ কমানোর পক্ষে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তৎক্ষণাৎ এক মহিলা কোরআনের আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে তার বক্তব্যের অসারতা প্রমাণে সচেষ্ট হন। এতে ওমর (রা.) নিজের ভুল বুঝতে পারেন। এভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খোদায়ী শিক্ষানীতির মাধ্যমে একটি উন্নত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি গঠনে অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের থেকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব শিক্ষার্থীবৃন্ধ সমাজ বিনির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়ে জাহেলি সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও বর্বরতার অবসান ঘটাতে সমর্থ হন। পৃথিবীজুড়ে অনৈতিকতার বাজার বন্ধ হয়ে নৈতিকতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছে নবীজির সেই শিক্ষানীতি। এই জ্ঞানের জাগরণ ও বিপ্লব এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে, মহানবীর ইনতিকালের মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তৎকালীন বিশ্বের সমগ্র জ্ঞানবিজ্ঞান আরবজাতির আয়ত্তে চলে আসে।

আমাদের জন্য জরুরি যে, আল্লাহপ্রদত্ত শিক্ষা সমাজের সর্বস্তরে বাস্তবায়ন করা। যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রণীত শিক্ষাকার্যক্রম। যা একটি নিরক্ষর জাতিকে এতো অল্প সময়ে এতোটা শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করেছে। তবেই আজকের পৃথিবীতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে যে দৈন্যতা ও অনৈতিকতা বিরাজ করছে আমরা তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো।

 

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

akpatwarz.qp@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads