• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

মাতৃভাষা আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত

  • প্রকাশিত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মো. তামিম সিফাতুল্লাহ

 

 

 

প্রত্যেকেরই তার মায়ের ভাষা তথা মাতৃভাষা মহান আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত এক বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতালা এক নিখুত ও অতুলনীয় স্রষ্টা। সৃষ্টির দিকে নজর করলেই তাঁর নিপুণ দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর এই নিপুন সৃষ্টিতে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। আর সৃষ্টির এই বৈচিত্র্যের পেছনে রয়েছে তাঁর বিশাল মহাপরিকল্পনা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা তাঁর সৃষ্টির বৈচিত্র্য বর্ণনা করে বলেন : ‘হে মানব সম্প্রদায়, অবশ্যই আমি তোমাদের একটি পুরুষ ও একটি নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর আমি তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে করে (এর মাধ্যমে) তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিতি হতে পারো। কিন্তু আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্য সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছে সে, যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)।

এমনিভাবে আল্লাহতায়ালা বৈচিত্র্য দান করেছেন মানুষের মাতৃভাষার ভেতরেও। প্রতিটি মাতৃভাষাই আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি। এই চমৎকার সৃষ্টির মাঝে আল্লাহতায়ালার পরিচয় ফুটে ওঠে। পৃথিবীতে যতগুলো ভাষা রয়েছে প্রত্যেকটি ভাষাই তার জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে। এই ভাষাগুলো কোনো মানুষ বা বিজ্ঞানী পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করেনি। বরং তা এক অদৃশ্য শক্তি বা নিখুত স্রষ্টার মহাপরিকল্পনায় সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘পরম করুণাময় (আল্লাহতায়ালা), তিনি তোমাদের কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন; তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আর তিনি তাকে কথা বলা শিখিয়েছেন।’ (সুরা আর রাহমান : ১-৪)। মানুষ যে ভাষাই কথা বলে তা তার মাতৃভাষা। আর মাতৃভাষা হলো আল্লাহর সৃষ্টি। এটি আল্লাহর নেয়ামত, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কোনো মানুষ বলতে পারেনি যে, এই ভাষা তারা সৃষ্টি করেছে। উপরন্তু এই আধুনিক সময়েও অনেক ভাষার সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ ভাষা সৃষ্টি করতে পারে না, সর্বোচ্চ সে ভাষার আকার আকৃতি পরিবর্তন করে নিজের ভাষা অন্যের বোধগম্য করে নিতে পারে। তাই আমাদের স্বীকার করে নিত হবে যে, প্রতিটি ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি। তাই প্রতিটি ভাষার প্রতি থাকতে হবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তা ছাড়া ভাষা মানুষের জন্য আল্লাহর প্রদত্ত থেকে এক বিশাল নিয়ামত। কারণ অন্যান্য পশুপাখি নির্দিষ্ট একটা শব্দের মাধমে তাদের সকল ভাব প্রকাশ করে। যেমন সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় কুকুর ঘেউ ঘেউ করে, পাখি কিচিরমিচির, বিড়াল মিউ মিউ, গরু হাম্বা হাম্বা ইত্যাদি করতে থাকে। কিন্তু মানুষ একমাত্র প্রাণী, যে তার ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন শব্দ বা কথার মাধ্যমে তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে।

একজন মানুষের কাছে যেমন নিজের ভাব প্রকাশ করার জন্য নিজের মাতৃভাষা তার কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও সহজতর, ঠিক তেমনি ইসলামেও মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর বাণী মানুষের নিকট স্পষ্ট ও বোধগম্য ভাষায় পৌঁছানোর জন্য ইসলাম মাতৃভাষাকে শুধু গুরুত্বই দেইনি বরং মাতৃভাষাকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছে। মহান আল্লাহতায়ালা মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন : ‘আমি প্রত্যেক নবীকেই তাঁর স্ব-জাতির ভাষায় (মাতৃভাষায়) প্রেরণ করেছি, যাতে করে সে তাদের কাছে আমার (আমার আয়াত) স্পষ্ট করে বর্ণনা করতে পারে। (সুরা ইবরাহিম : ৪)। কোরআনের এই শাশ্বত আয়াতই প্রমাণ করে যে, আল্লাহর বাণী মানুষের নিকট পৌঁছাতে মাতৃভাষার গুরুত্ব কতখানি। নবী ও রাসুলগণ যদি তাদের কওমের মাতৃভাষায় আল্লাহর বাণী প্রচার না করে নির্দিষ্ট কোনো ভাষা চাপিয়ে দিতেন তবে তাঁদের উম্মাতরা হেদায়েতের বাণী গ্রহণ করত না। হেদায়েত গ্রহণ না করার অন্যতম অজুহাত হিসেবে ভাষা না বোঝাকে দায়ী করত। তাই মানুষের সকল ওজর আপত্তি নিরসনকারী মহান আল্লাহতায়ালা তাদের নিজেদের ভাষায় ওহি পাঠিয়ে তাদের অজুহাতের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন।

ইসলামে মাতৃভাষার শুদ্ধ ব্যবহারের গুরুত্ব : ইসলাম মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বারোপের পাশাপশি মাতৃভাষা শুদ্ধরূপে উচ্চারণের প্রতিও গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জাতির মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। বিশিষ্ট মুফাসসির ইবনে কাসীর (রহ.) থেকে বর্ণিত-‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী।’ অপরদিকে চরম আল্লাহদ্রোহী ফেরআউনের নিকট তাওহিদের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার জন্য যখন মুসা (আ.) আদিষ্ট হয়েছেন তখন তিনি তার মুখের জড়তার কথা আল্লাহতায়ালার নিকট তুলে ধরেন। স্পষ্ট ও শুদ্ধভাষী হিসেবে ভাই হারুন (আ.)-কে নিজের দাওয়াতী সঙ্গী হিসেবে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন। পবিত্র কোরআন এই কথাকে এইভাবে বর্ণনা করে:  ‘(হে প্রভু) আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে সুন্দর ও স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে। সুতরাং তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন, যাতে করে সে আমাকে সমর্থন করতে পারে।’ (সুরা কাসাস : ৩৪)। আলোচ্য আয়াত থেকে এ কথা স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহর বাণী মানুষের নিকট পৌঁছাতে বিশুদ্ধ ভাষার বিকল্প নেই।

মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চা : আমাদের সমাজে কিছু মানুষের মাঝে একটি কথা খুব বেশি প্রচলিত আছে যে, ইসলামকে শুধু আরবি ভাষাতেই চর্চা করতে হবে। তবে ইসলাম চর্চার জন্য আরবি ভাষা জরুরি, কিন্তু এতে মাতৃভাষা প্রয়োজনও রয়েছে অনেক বেশি। প্রতিটি নবীর কাছে শরিয়তের বিধান নাজিল হয়েছে তাঁর স্বজাতির ভাষায়, যাতে করে তারা এর নিগূঢ় তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারে। আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আরবি। আর তৎকালীন সময়ে আরবি ভাষাই ছিল সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানে বহুল প্রচলিত ও ব্যবহূত ভাষা। তাই কোরআন আরবিতে নাজিল হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র হাদিস ও ইসলামী শরিয়তের হুকুম আহকাম আরবিতেই রচিত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার হওয়ায় তা অনারবিদের কাছে পৌঁছে যায়। তাই ইসলাম চর্চায় আরবি ভাষার পাশাপাশি ইসলামকে সহজ ও বোধগম্য করে তুলতে তাদের নিজেদের ভাষা বোঝার বিকল্প নেই। তা ছাড়া ইসলাম এতে উৎসাহ দিয়েছে। সুতরাং কেউ যদি নিজের মাতৃভাষায় দিন বোঝার চেষ্টা করেন তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আবার কেউ যদি শরিয়তের মূল ‍উৎস থেকে দিন বোঝে তবে তা অধিকতর উত্তম। তাই সাধারণ মানুষের নিকট ইসলামকে সহজভাবে উপস্থাপনের জন্য মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম।

ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষার অপব্যবহার : মানুষের মুখের ভাষা আল্লাহর দান। এই ভাষা কখনো মিষ্টি-মধুর, আবার কখনো তা হয় কর্কশ-কঠিন। এই ভাষাকে ব্যবহারের মাধ্যমে যেমন মানুষের মন জয় করা যায়, মানুষকে আনন্দিত করা যায়, সুখে-দুঃখে উৎসাহ-সান্ত্বনা দেওয়া যায়; ঠিক তেমনি এর মাধ্যমে মানুষের হূদয়কে জিহ্বা নামক তলোয়ার দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা যায়। মানুষের মাঝে ছোট, হেয় প্রতিপন্ন করে অপমান করা যায়। তাই বলা হয় জিহ্বার ব্যবহারেই শত্রু-মিত্র চেনা যায়। আর এই জিহ্বা দিয়ে মানুষ তার শত্রুকে প্রথম আঘাত হানে। জিহ্বার আঘাত এত মারাত্মক যে, আরব কবি ইয়াকুব হামদুনী তা বোঝাতে গিয়ে বলেন : ‘আশা করা যায় তরবারির আঘাতের ক্ষত নিরাময় হবে; কিন্তু জিহ্বার আঘাতের ক্ষত নিরাময় হবে না। তরবারির আঘাতে যদি কোনো ক্ষত হয় তা চিকিৎসার মাধ্যমে সারানো সম্ভব; কিন্তু জিহ্বার মাধ্যমে যে ক্ষত তা সারানো সম্ভব নয়। তলোয়ারের আঘাত একদিন মিশে গিয়ে ভালো হয়ে যাবে; কিন্তু জিহ্বার আঘাত অনন্তকাল থেকে যাবে।’ সুতরাং জিহ্বা আপনার তাই এর যাইচ্ছেতাই ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। একজন আদর্শ ও বিবেকবান মুসলিম তার জিহ্বাকে হেফাজত রাখে। কারণ তার প্রতিটি কথারই হিসাব গ্রহণ করা হবে। আল্লাহতায়ালা কোরআনে ইরশাদ করেন : ‘মানুষ এমন কোনো কথা বলেনা, যা লিপিবদ্ধ করা হয় না। (সুরা ক্বফ : ১৮)।

মুখের ভাষা সংযতকারীর জন্য পুরস্কার হিসেবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ‘যে ব্যক্তি আমাকে জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের নিরাপত্তা দেবে আমি তাকে জান্নাতের নিরপত্তা দেব। (বুখারি : ৬৪৭৪) জিহ্বার মাধ্যমেই মানুষের জীবনের অধিকাংশ অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। তাই যারা নিজেদের জিহ্বা সংযত রাখতে পারে না রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ব্যাপারে বলেন : ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (বুখারি : ৬০১৮, মুসলিম : ৪৭)। সবশেষে আমরা এ কথা বলতে পারি, ভাষা মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশাল নিয়ামত। এই নিয়ামতের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা মানুষের মন জয় করে নিতে পারি। বাংলায় একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ব্যবহারে বংশের পরিচয়। সুতরাং আমাদের মুখের ভাষা ব্যবহারে অত্যন্ত সচেতন হওয়া উচিত। সর্বত্র মাতৃভাষার ব্যবহার করি। অন্যের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, মদিনাতুল উলুম কামিল মাদরাসা, রাজশাহী

E-mail:-tamim.sifatullah82@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads