• শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

আমানত রক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

  • প্রকাশিত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান

 

 

 

আমানত শব্দটির অর্থ নিরাপদ রাখা বা কোনো কিছু গচ্ছিত রাখা। কারো কাছে কোনো অর্থ-সম্পদ, বস্তুসামগ্রী বা কথা গচ্ছিত রাখাকে আমানত বলে। ইবনে মানযুর বলেন, আমানত হলো খিয়ানতের বিপরীত। ব্যাপক অর্থে আমানত অর্থ হলো আস্থা, নিরাপত্তা, তত্ত্বাবধান, বিশ্বস্ততা, হেফাজত ইত্যাদি। মানুষের মধ্যে যেসব সৎগুণাবলি রয়েছে তম্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমানত রক্ষা করা। আমানত রক্ষা করতে নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমানতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ করেছেন। শুধুমাত্র কোনো কিছু গচ্ছিত রাখার নাম আমানত নয়; বরং আমানত রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের কোনো মীমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন মীমাংসা কর ন্যায়ভিত্তিক। আল্লাহতায়ালা তোমাদেরকে সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী।’ (সুরা নিসা-৫৮)

আমানতদারিতাকে আল্লাহতায়ালা মুমিনের বিশেষ গুণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পবিত্র  কোরআনে সুরা মুমিনুনের প্রথম দশ আয়াতে ইমানদারের দশটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। যে গুণগুলো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্বভাবে পরিপূর্ণ ছিল। হজরত ইয়াযিদ ইবনে বাবনুস থেকে বর্ণিত তিনি হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে প্রশ্ন করেছিলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র কীরূপ ছিল? তিনি বলেন, তার চরিত্র তথা স্বভাবগত অভ্যাস  কোরআনেই বর্ণিত আছে। অতঃপর তিনি এই দশটি আয়াত (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১-১০) তিলাওয়াত করে বলেন, এগুলোই হলো রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র। (সুনানে নাসাঈ শরীফ) উক্ত আয়াতগুলোতে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পঞ্চমটি হলো আমানত প্রত্যার্পণ করা। আল্লাহ বলেন, এবং যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে। (সুরা মুমিনুন, আয়াত-৮)

আমানতের কিছু দিক হলো আল্লাহর হক সর্ম্পকিত আরো কিছু দিক হলো হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক সর্ম্পকিত। হাক্কুল্লাহ সর্ম্পকিত যাবতীয় ফরজ ওয়াজিব পালন করা, সতীত্বের হিফাজত, সালাত, জাকাত, রোজা, হজ্ব, জাকাত ইত্যাদি আদায় করা। আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকা। আর হাক্কুল ইবাদ সম্পর্কিত বিষয়গুলো হলো, কারো বস্তুগত আমানত রক্ষা করা। সাথে সাথে মানুষের দোষত্রুটি গোপন করা বা অন্যের সম্মান রক্ষা হয় এই রকম বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে আমানত রক্ষা করা। ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন, দীনের যাবতীয় কর্তব্য আমানতের অর্ন্তভুক্ত । (তাফসিরে কুরতুবী, খণ্ড ১৪, পৃ-১৭৯)

প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে বাল্যকাল থেকেই আমানতদারিতার গুণ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। যার কারণে তৎকালীন আরবের লোকেরা তাকে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বাসী উপাধি দিয়েছিল। কেননা তারা তাদের মালামাল ও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্য নবীজির কাছে রাখতেন। অতঃপর নবীজি তা যথাযথভাবে প্রাপকের কাছে সময়মতো বুঝিয়ে দিতেন।

অনূরূপভাবে তিনি জীবনব্যাপী আমানতের দায়িত্ব পালন করে বিদায় হজ্বের ভাষণে আরাফাতের ময়দানে লক্ষাধিক সাহাবাদেরকে সামনে রেখে বলেন, আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো, আমার উপর অর্পিত আমানত আমি পৌঁছে দিয়েছি। হাদিসে পাকে রয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হতে বর্ণিত, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন তোমার মাঝে চারটি জিনিস থাকবে, তখন দুনিয়ার সবকিছু হারিয়ে গেলেও তোমার কোনো সমস্যা থাকবে না। ১. আমানত রক্ষা করা, ২. সত্যকথা বলা, ৩. সুন্দর চরিত্র, ৪. হালাল উপায়ে রিজিক উপার্জন করা। (মুসনাদে আহমদ-৬৬৫২, মুসতাদরাকে হাকেম-৭৯৮৯) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমানতদারকে ইসলামের অন্যতম নিদর্শন সাব্যস্ত করেছেন। হজরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে এ রূপ উপদেশ খুব কমই দিয়েছেন যাতে এ কথাগুলো বলেন নি যে, যার আমানতদারিতা নেই তার ইমান নেই এবং যার অঙ্গীকারের মূল্য নেই তার দীন-ধর্ম নেই। (মুসনাদে আহমদ-১২৪০৬)

খায়বার যুদ্ধে রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন ইহুদিদের একটি দুর্গ ঘেরাও করেন। সেখানকার ইহুদি নেতার একজন রাখাল একপাল ছাগল নিয়ে নবীজির কাছে আসেন। রাখালটি ছিলেন ওই ইহুদি নেতার বেতনভুক্ত মজুর। তিনি এসে বললেন ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার সামনে ইসলামকে উপস্থাপন করুন। নবীজি তার সামনে ইসলামকে তুলে ধরেন । তিনি সাথে সাথেই ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি হলেন হজরত আসলাম আল হাবশী (রা)। যিনি ছিলেন হাবশার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ। ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি বললেন, আমি এই ছাগলগুলোর মালিকের মজুর। আমার নিকট এগুলো তার আমানত। এখন এই ছাগলগুলো আমি কী করব? রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি এগুলোর মুখ কেল্লার দিকে ঘুরিয়ে এবং মুখে একটু আঘাত করে হাঁকিয়ে দাও, তারা মালিকের কাছে ফিরে যাবে। তিনি তাই করে ছাগলগুলোকে হাঁকিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা তোমাদের মালিকের নিকট ফিরে যাও, আল্লাহ তোমাদের সাথে থাকবেন। ছাগলগুলো মালিকের কাছে পৌঁছে গেলেন। তিনি এমন সাহাবী ইমান গ্রহণের সাথে আমানতের গুরুত্ব অনুধাবণ করেছেন এবং ইসলাম গ্রহণ করে এক ওয়াক্ত সালাত আদায়ের সুযোগও পাননি। শহীদ হয়ে গেছেন। (উসদুল গাবা ১/১০৭)

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মানুষের চারিত্রিক গুণাবলির মধ্যে যে গুলো সবচেয়ে আগে অদৃশ্য হয়ে যাবে তা হলো আমানতদারিতা। আর শেষ পর্যন্ত যা রয়ে যাবে তা হলো নামাজ। তবে এমন অনেক নামাজি আছে, যারা কোনো কল্যাণই অর্জন করতে পারেন না। হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা খিয়ানত করোনা। কেননা খিয়ানত কতই না শাস্তিযোগ্য অপরাধ। (আবু দাউদ) কিয়মতের ময়দানে মানুষের সব আমলনামা পেশ করা হবে। পাপ-পুণ্যের হিসাব করা হবে। পৃথিবীতে যারা আমানতের খিয়ানত করেছিল তাদের পরিণাম হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, কিয়ামতের দিন আমানতের খিয়ানতকারীকে হাজির করা হবে এবং বলা হবে তোমর কাছে গচ্ছিত আমার আমানত ফিরিয়ে দাও। সে বলবে হে আমার প্রতিপালক তা কীভাবে ফিরিয়ে দেব? পৃথিবীতো ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন তার গচ্ছিত আমানতগুলো যেভাবে রাখা হয়েছিল ঠিক সেই ভাবে জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে তাকে দেখানো হবে। অতঃপর তাকে বলা হবে ওইখানে অবতরণ করে এগুলো উত্তোলন করে নিয়ে আস। সে তখন নেমে যাবে জিনিসগুলো ঘাড়ে করে নিয়ে আসতে চাইবে। জিনিসগুলো তার কাছে দুনিয়ার সব পাহাড়ের চাইতেও ভারী মনে হবে। সে মনে করবে এগুলো তুলে আনলে সে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাবে। সে তখন জাহান্নামের শেষ প্রান্তে চবে আসবে তখই উক্ত জিনিসগুলো জাহান্নামের নিচে পড়ে যাবে। এভাবে সে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। (বায়হাকী)

সামাজিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আমানতের চর্চা থাকলে সেই সমাজ কল্যাণে ভরপুর থাকে এবং সর্বত্র শান্তি বিরাজ করে। সমাজের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ তাদের দায়িত্ব যথাথ পালনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার রক্ষা করতে চেষ্টা করে। এতে জনগণও উপকৃত হয়। আল্লাহতায়ালা হজরত ইউছুফ (আ.) সর্ম্পকে বলেন, ইউসুফ বলল, আমাকে দেশের ধনভাণ্ডারে নিযুক্ত করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও অধিক জ্ঞানবান। (সুরা ইউসুফ, আয়াত-৫৫) আল্লাহতায়ালা বলেন, চোখের চুরি ও অন্তরের গোপন বিষয় তিনি জানেন। (সুরা মুমিন, আয়াত-১৯) আত্মসাতের পরিমাণ কম হউক বা বেশি হউক সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে। খায়বারের যুদ্ধে একজন গোলাম হাঠৎ তীরের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, কতই সৌভাগ্য তার! সে জান্নাতি হয়ে গেল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কখনো নয়। শপথ যার হাতে আমার প্রাণ। খায়বরে বণ্টন ব্যতীত সে যে কাপড় নিয়েছে, তা তার জন্য আগুন জালাতে থাকবে। (সহিহ বুখারি)

হজরত ইমরান বিন হুসাইন (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার যুগের লোকেরাই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা। রাবী বলেন, আমি বলতে পারছিনা নবীজি তার যুগের পর দুই যুগ নাকি তিন যুগের কথা উল্লেখ করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, তোমাদের পর এমন লোকেরা আসবে যারা খেয়ানত করবে, আমানত রক্ষা করবে না। সাক্ষ্য দিতে না ডাকলেও তারা সাক্ষ্য দিবে, তারা মানত করবে কিন্তু তা পূর্ণ করবে না। তাদের মধ্যে মেদওয়ালাদের প্রকাশ ঘটবে। (সহিহ বুখারি-২৬৫১)

 

 

লেখক : সহকারী শিক্ষক (ইসলাম ও  নৈতিক শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads