ভাষা আল্লাহতায়ালার বিশেষ নিয়ামত। বান্দার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ। ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার ইচ্ছা, মনের ভাব, হূদয়ের আকুতি, অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। যার মুখে ভাষা নেই, কথা বলার শক্তি নেই, তাকে আমরা বাকপ্রতিবন্ধী বা বোবা বলি। আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষাভাষীর মানুষ পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তাকে শিখিয়েছেন ভাষা।’ (সুরা আর-রহমান, আয়াত- ৩, ৪) বিভিন্ন দেশ ও গোত্রভেদে বিভিন্ন ভাষা দান করেছেন। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, সারা দুনিয়ায় প্রায় সাত হাজারের উপরে ভাষা আছে। ভাষার মাধ্যমে একে অপরের সাথে পরিচয় হয়। যেমন, আরবে আরবি, ইরানে ফার্সি, লন্ডনে ইংরেজি, পাকিস্তানে উর্দু, বাঙালিদের বাংলা ইত্যাদি। আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন গোত্রে নবী প্রেরণ করেছেন, সেই গোত্রের ভাষা দিয়ে। আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি সব নবীকেই স্বজাতির ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বুঝাতে পারে।’ (সুরা ইব্রাহিম, আয়াত-৪)
প্রতিটি মানুষের কাছে তার মায়ের ভাষা হচ্ছে প্রিয় ভাষা। মানুষ কখনো তার মায়ের ভাষাকে অবজ্ঞা কিংবা অবহেলা করে না। মায়ের ভাষার উপর কোনো আঘাত আসুক এটাও কেউ সহ্য করে না। ব্যঙ্গাত্মক বা বিদ্রূপের সাথে ভাষার ব্যবহার হোক এটাও কেউ মেনে নেয় না। মায়ের ভাষার উপর জোরপূর্বক অন্য ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া হোক এটা কেউ বরদাস্ত করতে পারে না। তাই মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে বাঙালিদের অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়া আজ ইতিহাস হয়ে আছে। অনেক ত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে আমরা ফিরে পেয়েছি আমাদের অধিকার। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে। বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছি। কিন্তু আজ সেই গৌরব আমরা ধরে রাখতে পারছি না। রক্তে কেনা মায়ের ভাষাকে আজ বিকৃত করা হচ্ছে! আধুনিকতার নামে ভাষাকে করা হচ্ছে আহত, ক্ষত-বিক্ষত! নিজেকে শিক্ষিত পরিচয় দিতে গিয়ে বাংলার সাথে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলাটা এখন ফ্যাশন হয়ে গেছে। বিশেষ করে টিভিতে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ও এফ.এম রেডিওগুলোতে ভাষাকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে মারাত্মকভাবে। শুধু ভাষা নয়, ভাষা শহীদদেরও করা হচ্ছে অবমাননা! ভাষা শহীদদের স্মরণ করা হচ্ছে নাচ-গান আর ঢোল পিটিয়ে! লাল সবুজের পতাকা গায়ে জড়িয়ে মেতে উঠছে হিন্দিগানে। বিজ্ঞাপন, ফেস্টুন, ব্যানারসহ সবখানে বাংলার পরিবর্তে স্থান করে নিচ্ছে ভিনদেশি ভাষা। স্টার জলসা, জি বাংলাসহ ভারতীয় সিরিয়ালে প্রভাবিত তরুণ প্রজন্মের হিন্দিপ্রীতি সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলছে!
সকালে খালি পায়ে শহীদ-বেধিতে ফুল দিলেও বিকেলে মত্ত হয় হিন্দি গানে। অথচ উচিত ছিল যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের রুহের মাগফিরাত কামনার্থে কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকারের মাধ্যমে তাদের আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করা। তাদের পরিবারের খোঁজ-খবর নেওয়া। ভাষার সঠিক চর্চা, ব্যবহার ও প্রয়োগ করা ইত্যাদি। অথচ আমরা তার বিপরীতে...! আবার অনেকে বাংলাভাষাচর্চাকে বাঁকা চোখে দেখে। বাংলা সাহিত্য চর্চাকে অনর্থক সময় নষ্ট ভাবে। বাংলাভাষাও সাহিত্য আজ অমুসলিম ও অনৈসলামিক শক্তির হাতে। যার ফলে তারা খুব সহজেই বিভিন্ন ইসলামবিদ্বেষী লেখা, বই-পত্রিকা মানুষের হাতে তুলে দিয়ে সাধারণ শিক্ষিত মহলকে ইসলাম থেকে কৌশলে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
বর্তমান যুগ, সাহিত্যের যুগ। আর ভাষা সাহিত্য হলো মানুষের চিন্তার বাহন। সাহিত্যপূর্ণ আলোচনা ও লেখার মাধ্যমে খুব সহজেই মানুষকে নিজের ধর্মমতের দিকে আকৃষ্ট করা যায়। আর ইসলামবিদ্বেষী শক্তিগুলো সেই পথকেই বেছে নিয়েছে। ফলে সাধারণ শিক্ষিত মহল খুব সহজেই তাদের লেখা ও মতের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এর বিপরীতে বিশেষত আলেমসমাজ যদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা না রাখে তাহলে বর্তমান জেনারেশন ইসলাম থেকে বহু দূরে সরে যাবে। আবার অনেকেই মনে করেন, বাংলাভাষাহিন্দুদের ভাষা। এটাতে কোনো পুণ্য নেই! তাদের উদ্দেশ্যেই বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. বলেছেন, ‘বাংলাভাষাকে অন্তরের মমতা দিয়ে গ্রহণ করুন এবং মেধা ও প্রতিভা দিয়ে বাংলা সাহিত্য চর্চা করুন। কে বলেছে, এটা অস্পৃশ্য ভাষা? কে বলেছে, এটা হিন্দুদের ভাষা? বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চায় পুণ্য নেই, পুণ্য শুধু আরবীতে, উর্দুতে, কোথায় পেয়েছেন এই ফতোয়া? এ ভ্রান্ত ও আত্মঘাতী ধারণা বর্জন করুন। এটা অজ্ঞতা, এটা মূর্খতা এবং আগামীদিনের জন্য এর পরিণতি বড় ভয়াবহ।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘আমার কথা মনে রাখবেন। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে হবে। দুটি শক্তির হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। অমুসলিম শক্তির হাত থেকে এবং অনৈসলামী শক্তির হাত থেকে। অনৈসলামী শক্তির অর্থ ওইসব নামধারী মুসলিম লেখক-সাহিত্যিক যাদের মন-মস্তিষ্ক ও চিন্তা-চেতনা ইসলামী নয়। ক্ষতি ও দুষ্কৃতির ক্ষেত্রে এরা অমুসলিম লেখকদের চেয়েও ভয়ংকর।’ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. ১৯৮৪ সালের ১৪ মার্চ কিশোরগঞ্জের জামিয়া এমদাদিয়া মাদরাসায় কথাগুলো বলেছিলেন। তখন থেকেই যদি আমরা তার কথার গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাভাষাও সাহিত্যে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতাম তাহলে এই প্রজন্ম হুমায়ুন আজাদ, কবি শামসুর রহমান, তাসলিমা নাসরিনের মতো ইসলামবিদ্বেষী লেখক-সাহিত্যিকদের দ্বারা প্রতারিত ও প্রভাবিত হতো না। দেরীতে হলেও বর্তমান সময়ে আলেমসমাজের মধ্য থেকে যারা বাংলাভাষা ও সাহিত্যে নেতৃত্ব দিতে বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, বিশেষ করে, মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ, মাওলানা উবাইদুর রহমান নদভী, শরীফ মুহাম্মদ, জয়নাল আবেদীনসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে ওলামায়ে কেরামের রয়েছে বিশেষ অবদান। যা আজ কৌশলে আড়াল করার চেষ্টা চলছে। উল্টোভাবে জাতিকে বুঝানো হচ্ছে ওলামায়ে কেরাম বাংলাভাষা বিরোধী। ভাষা-সাহিত্যে তারা অজ্ঞ! অথচ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভাষা আন্দোলনে ওলামায়ে কেরাম রচনা করেছেন এক সোনালী অধ্যায়। ’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ব্যবস্থাপক পরিষদে নিরীহ বাঙালির বুকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের রক্তাক্ত পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম গর্জে উঠেছিলেন তৎকালীন আলেমসমাজের প্রতিনিধি মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ। বিচার না পেয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি থেকে একমাত্র তিনিই পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ্য করেন, ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করতে হবে।’ যার ফলে মাওলানাকে ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে গ্রেপ্তার করে সরকার। দীর্ঘ ১৮ মাস কারাভোগের পর ১৯৫৩ সালের ৩১ জুন মাওলানা তর্কবাগীশ মুক্তি লাভ করেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জন নাগরিকের মাতৃভাষায় বক্তৃতা দেওয়া আমি গৌরবের বলে মনে করি। শুধু তাই নয়, যে ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সেদিন আমার সন্তানেরা এই জালিম সরকারের গুলির সম্মুখীন হয়েছিল, নিজেদের উত্তপ্ত শোণিতধারা ঢাকার মাটিতে ঢেলে দিয়েছিল, আজ সেই মাতৃভাষায় বক্তৃতা দিতে যারা লজ্জাবোধ করে, আমি বলতে দ্বিধাবোধ করবো না যে, তারা নিজ জাতির সঙ্গে গাদ্দারী করেছে।’ (আলেম মুক্তিযুদ্ধার খোঁজে)
এমনকী মাওলানা তর্কবাগীশ সর্বপ্রথম পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলায় বক্তৃতা করেন এবং বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাপ প্রয়োগ করেন। শুধু তর্কবাগীশ নয় বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চায় মাওলানা আতহার আলী রহ., মুজাহিদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ., শাইখুল হাদিস আজিজুল হক রহ., মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ. কবি আল মাহমুদ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। তবে সেই সোনার অক্ষরগুলোকে পরিষ্কার রাখা ও হেফাজত করার দায়িত্ব আমাদের। আমরা যদি সেগুলোকে হেফাজত না করি তাহলে ইসলামবিদ্বেষী শক্তি সেই সোনার অক্ষরগুলোকে ছুঁড়ে মারবে অনেক দূরে। যেখান থেকে কুড়িয়ে আনা হয়তো অসম্ভব হয়ে যাবে। তাই আমাদের জাগতে হবে। বাংলাভাষার নেতৃত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হবে। পরিশেষে হযরত নদভী রহ. এর কথা দিয়ে ইতি টানছি, ‘বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চা ইসলামবিরোধী শক্তির রহম করমের উপর ছেড়ে দিও না। ওরা লিখবে, তোমরা পড়বে-এ অবস্থা কিছুতেই বরদাশত করা উচিত নয়।’ তাই আসুন! শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়। সত্যিকারার্থে ভাষার শুদ্ধচর্চা করি। সর্বক্ষেত্রে বাংলাভাষাও সাহিত্যচর্চাকে বেগবান করি।
লেখক :মুহাম্মাদ হাবীব আনওয়ার
শিক্ষার্থী, দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসা, চট্টগ্রাম
