• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব

  • প্রকাশিত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

এম জহিরুল ইসলাম

 

 

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে যতগুলো নিয়ামত দান করেছেন, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ামত হলো, ভাষা বা কথা বলার শক্তি। মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যমই হলো ভাষা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি যদি আমার কুদরত ও নিদর্শন দেখতে চাও, আমার অনেক কুদরতই তুমি দেখতে পাবে, তার কয়েকটি বিশেষ কুদরতের মধ্যে একটি হলো মাতৃভাষা। (সুরা রুম, আয়াত : ২২) আল্লাহর শৈল্পিক নিটুণতা কত সুন্দর ও বিচিত্র। তিনি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ভাষাকে ভিন্ন ভিন্ন রূপ দিয়েছেন, যাতে তারা তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। আল্লাহ মানুষকে তাদের মনের আকুতি প্রকাশের জন্য দান করেছেন বাকশক্তি। আল্লাহ অস্তিত্বহীন মানবজাতিকে অস্তিত্ববান করেছেন ভাষার মাধ্যমে। আল্লাহপাক যখন আদমকে (আ.) তৈরি করেছিলেন, তখন তিনি তাকে সকল ভাষা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশের উপযোগী ভাষা।’ এ আয়াতের আলোকে বোঝা যায়, পৃথিবীর সব ভাষা আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট। তাই আল্লাহ কোনো নির্দিষ্ট ভাষা সৃষ্টি করেছেন, এ মত পোষণ করা যাবে না। তবে মুসলমান হিসেবেই প্রত্যেকের প্রিয় ভাষা হলো আরবি। কারণ মহাগ্রন্থ আল কোরআন ও মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষা ছিল আরবি। তাই প্রতিটি মুমিনকে আরবি ভাষাকে ভালোবাসতে হবে ও চর্চা করতে হবে। তবে আরবি ভাষাকে ভালোবাসার অর্থ এই নয় যে, নিজের ভাষাকে ভালোবাসা যাবে না। আমরা দেখতে পাই, সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আল্লাহর নবীর যুগেই অনেক দূরে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত প্রচার করেছেন। যে জাতির কাছে তারা গেছেন তাদেরকে সেই ভাষায় সত্যের বাণী প্রচার করেছেন। বিভিন্ন জাতির কাছে যে ভাষাগুলো ছিল সেগুলোকে আল্লাহ নিষিদ্ধ করে দেননি।

সুরা ইবরাহিমে আল্লাহপাক বলেছেন, আমি দুনিয়ার বুকে অনেক নবী-রাসুল পাঠিয়েছি। কিন্তু আমি এমন কোনো নবী-রাসুল পাঠাইনি, যারা তাদের ভাষা জানত না। যেই জাতির কাছে যে নবী-রাসুলকে পাঠিয়েছি, সে জাতির ভাষায় অভিজ্ঞ করে তাদেরকে আমি পাঠিয়েছি। কাজেই নিজের জাতীয় ভাষাকে আয়ত্ত করা, শ্রদ্ধা করা কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে কর্তব্য। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষা দক্ষতার আরো অপূর্ব নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় ইসলামে। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো জ্ঞান না থাকার পরেও আল্লাহর রাসুলের (সা.) মুখ থেকে নিসৃত শব্দগুলো ছিল ভাষাশৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত উঁচু মাপের। এর কারণ, তার মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আল্লাহপাক বলেছেন, ‘আমি নবী ও রাসুলদের কেন সৃষ্টি করেছি? যাতে তারা সুন্দর এবং সহজভাবে আমার বাণী মানবজাতির কাছে পৌঁছে দিতে পারে।’ তাছাড়া বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা উঁচু ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। আর নবী-রাসুলগণ ছিলেন বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

পৃথিবীর সবার ভাষা আল্লাহর কাছে সমান এবং সব মানুষের মাতৃভাষা সমান গুরুত্বের অধিকারী। এ সম্পর্কে আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণা, আমি (আল্লাহ) প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৫) আল কোরআনে আল্লাহ অন্যত্র বলেন, আমি তোমাকে (রাসূূল) সত্যসহ পাঠেয়েছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে। অন্য ইরশাদ হয়েছে, ‘এমন কোনো সম্প্রদায় নেই, যার কাছে সতর্ককারী পাঠানো হয়নি।’ (সুরা ফাতির, আয়াত : ২৫) অতএব বিশ্বস্রষ্টার পবিত্র বাণী থেকে এটা সুস্পষ্ট, আল্লাহ পৃথিবীর সব অঞ্চল, যুগ ও জনমণ্ডলীর জন্যই নবী-রাসুল ও আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন এবং নাজিলকৃত স্থানের প্রচলিত ভাষাই বিভিন্ন যুগ, জনমণ্ডলী ও স্থানের উপযোগী করে আসমানি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল।

পৃথিবীর কোনো ভাষাই তুচ্ছ বা নিন্দনীয় নয়, সব ভাষাই আল্লাহর নিদর্শনাবলির মধ্যে গণ্য এবং সে হিসেবে সমমর্যাদার অধিকারী। মহাগ্রন্থ আল কোরআন ও বিভিন্ন দৃষ্টান্ত থেকে এটা সুস্পষ্ট, মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম, তা সে যে ভাষাই হোক, ইসলাম কোনো বিশেষ স্থান কাল বা সম্প্রদায়ের জন্য নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে সব মাতৃভাষা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে পৃথিবীতে অনেক ভাষা আছে যা উন্নত বা সাবলীল নয়। ভাষার সঠিকচর্চা বা অনুশীলন না করলে ভাষা উন্নত হতে পারে না। আর তাই বলে উন্নতর ভাষার প্রতি মর্যাদা দেখাতে গিয়ে নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা অসঙ্গত। অনুরূপভাবে, মাতৃভাষার প্রতি অন্ধভক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে অন্যভাষাকে অশ্রদ্ধা করাও অনুচিত, ইসলাম সমতার ধর্ম, মানবতার ধর্ম, ইসলাম কোনো ভাষাকেই তুচ্ছ বলেনি। ইসলামের দৃষ্টিতে সব ভাষার মর্যাদা সমান।

মাতৃভাষা আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত মানবজাতির জন্য অনেক বড় একটি নিয়ামত বা নিদর্শন। তাই মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা করা উচিত। মাতৃভাষা চর্চা ছাড়া কোনো জাতিই উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারবে না। ইসলাম জীবনের সর্বক্ষেত্রে এ সহজাত প্রবণতারই স্বপক্ষে। তাই ইসলামকে বলা হয় ফিৎরাতের (স্বভাব বা প্রকৃতির) ধর্ম। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ল অব নেচার’। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের সহজাত স্বভাব এই ‘ল অব নেচার’ এর অন্তর্ভুক্ত। স্বকীয় প্রতিভা বিকাশের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হলো মাতৃভাষা। কিন্তু তাই বলে অন্য কোনো ভাষা শিক্ষা করা ও চর্চা করা, ইসলাম নিষেধ করে না, বরং উৎসাহ প্রদান করে।

ফেব্রুয়ারি মাস বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য গর্বের মাস। নিজের মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলার জনগণ রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। প্রসঙ্গক্রমে আমাদের স্পষ্ট জেনে নিতে হবে, যে অঞ্চলে মুসলিম থাকবে, সেটিই হবে তার মাতৃভাষা। এই ভাষা অন্য ধর্মাবলম্বীদের ভাষা বলে বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে না। কারণ মাতৃভাষা চর্চা করা আল্লাহর আদেশ, নবী-রাসূূলদের সুন্নাত। তার আরও চমৎকার দৃষ্টান্ত মেলে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে। আবু জেহেল, আবু লাহাব প্রমুখের মাতৃভাষাও ছিল ‘আরবি’। কিন্তু তাই বলে মহানবী (সা.) ধর্মের সঙ্গে ভাষার বিভেদ সৃষ্টি করেননি। আর এভাবেই ইরান ও পারস্য দেশগুলোতে ইসলামের প্রচার ঘটে ভাষার মাধ্যমে। মুসলমানরা যখন ফার্সি ভাষাতেই ইসলাম চর্চা শুরু করল, তখন ফার্সি ইসলামী সাহিত্যে দ্বিতীয় নম্বর ভাষায় সমৃদ্ধ হয়ে যায়। ঠিক একইভাবে মুসলমানরা যদি বাংলাভাষা চর্চা শুরু করে, তারা ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাব এই ভাষায় সৃষ্টি করতে পারে। অনেক মুসলিম কবি যুগ যুগ ধরে ইসলামী সাহিত্য চর্চা করেছেন বাংলায়। কাজী নজরুল ইসলাম পবিত্র কোরআনে বাংলা অনুবাদ কাব্যের রচনার কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার অসুস্থার কারণে তিনি তা সম্পূর্ণ করতে পারেননি। শুধু আমপারা কাব্যের অনুবাদ সমাপ্ত করেছেন। একইভাবে ফররুখ আহমদ, বেনজীর আহমদ, কায়কোবাদ, আল মাহমুদসহ আরো অনেক কবি ও সাহিত্যিক বাংলা ভাষায় ইসলামী ভাবধারাকে প্রচার করেছেন।

বাংলাভাষা চর্চা করা মুসলমানদের জন্য আবশ্যক এবং বাংলায় ইসলামী ভাবধারা প্রচার ও ইসলামী সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা তাদের কর্তব্য। ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্বের যে নজির, তা হয়তো অন্য কোনো ধর্মে পাওয়া যাবে না। ইসলাম মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতে শিখিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, আমরা তা করি না। আমরা ভাষা দিবসকেও অপসংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন করে রেখেছি। যে মহান ব্যক্তিরা বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শহীদ হয়েছেন, আমরা তাদেরকে রীতিমতো অসম্মান করে চলেছি। আমরা ভাষা দিবসকে ৮ ফাল্গুনের পরিবর্তে ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করি। ৮ ফাল্গুন মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা দরকার, যাতে এ ভাষার জন্য যে ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছেন তাদের সঙ্গে সঙ্গতি থাকে। একদিকে আমরা এই দিবসকে বাংলা ভাষার দিবস হিসেবে পালন করি, কিন্তু তা পালন করি ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি। একজন ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি, মুসলমানের জন্য তার নিজের ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করা ইবাদত ও ঈমানি দায়িত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিজের মাতৃভাষাকে ত্যাগ করা ঈমানের অংশ নয় বরং এতে পাণ্ডিত্য গ্রহণ করা উচিত। যাতে বাংলাভাষা, কোটি কোটি মুসলমানদের এই ভাষার মাধ্যমে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। আমাদের মনে রাখা উচিত, যে জাতি নিজের ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে- সে জাতি নিজেই সমৃদ্ধ হতে পারে। আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ হলে এই অঞ্চলের মুসলমানরাও সমৃদ্ধ হবে। মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা ইসলাম চর্চার মাধ্যমে সমাজ থেকে কুসংস্কার বিদূরিত হয়।

ইসলাম জীবনের সম্পূর্ণ ধারক ও বাহক। ইসলাম মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষুদ্র ও বড় জিনিসের ব্যবহার ও গুরুত্বের নজির রেখে গেছে, এর মধ্যে ভাষা চর্চাও অন্যতম। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট, ইসলাম মাতৃভাষাকে যথার্থ মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদানের শিক্ষা দেয়। আর এই শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে সম্মান করতে হবে এবং মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আমরা সংগ্রাম করব এবং প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করব। আল্লাহ পাক একুশের যে গৌরব বাঙালি মুসলমানদের দান করেছেন, তা যেন ইসলামের কল্যাণে, এই দেশের মানুষের কল্যাণে আমরা ব্যবহার করতে পারি এবং এ ভাষার মাধ্যমেই যেন আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, মহান আল্লাহ আমাদের সে তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক, গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads