• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

‘নমুনায়ে আসলাফ’ আল্লামা কাসেমী (রহ.)

  • প্রকাশিত ০৪ মার্চ ২০২১

মুহাম্মাদ আব্দুল কাদির

 

 

আল্লামা কাসেমী (রহ.) ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের মানস-সন্তান। তাঁর হূদয় ছিল উদার। চিন্তা-চেতনা ছিল বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন। ধমনিতে প্রবাহিত ছিল হকের সুমহান চেতনা। মানবতাবোধ, সততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম ছিল তাঁর চরিত্রের অলঙ্কার। সে কারণে দেশের আলিম সমাজের পাশাপাশি সচেতন ঈমানদার জনসাধারণও তাঁর প্রতি বিশেষ আস্থা ও ভালোবাসা পোষণ করতেন।

তিনি ছিলেন দেশবরেণ্য আলেমেদীন। শায়খুল হাদিস। প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ। ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের একজন শায়েখ। পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব। আখলাকে নববীর সাধক। এমনিভাবে তাঁর গুণাগুণ লিখতে গেলে লেখা যাবে শতসহস্র পৃষ্ঠা। রচনা করা  যাবে কয়েকখানা গ্রন্থ। তবুও হয়তো অলেখা রয়ে যাবে এ মহা মনীষীর অগণিত গুণাবলি। যিনি অন্তরের গভীরে সদালালন করতেন, ইলমে ওহীর প্রতি গভীর আজমত ও ভালোবাসা। কাসেমী রাহ.-এর রেখে যাওয়া অমূল্য একটি বাণী হলো, ‘ইলমে ওহী ব্যতীত মানুষের মধ্যে প্রকৃত মানবতাবোধ আসতে পারে না’। এই ইলমে ওহীর শ্রেষ্ঠত্বের কথা তিনি জোড়ালো কণ্ঠে আজীবন প্রচার করে গেছেন। হজরতের জীবদ্দশায়  বারবার বলে গেছেন, ‘ইনহিকাম ও একাগ্রতা ব্যতীত ইলমে পরিপক্বতা অর্জন করা সম্ভব নয়।’

যখন গোটা দুনিয়াতে ধারাবাহিকভাবে উলামায়ে কেরাম ও নেক্কার বুযুর্গগণ একের পর এক চলে যাচ্ছেন। এই ভূখণ্ডেও যখন এমন দশা! ঠিক তখনি তাঁর চলে যাওয়া কতটা বেদনাদায়ক, তা তো বলা-কওয়ারও বাইরে। ইন্তেকালের পর তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারায় আনা হলে শেষবারের মতো তাঁকে একনজর দেখার জন্যে শোকাহত মানুষের ভিড় ও ব্যাকুলতা ছিল অত্যন্ত হূদয়স্পর্শী ও করুণ! দেশের অসংখ্য আলিম ও ধর্মপ্রাণ মানুষ তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁর অগণিত ছাত্র কেঁদে কেঁদে অশ্রু ঝরাতে থাকেন। জানাজায় বায়তুল মুকাররম মসজিদ এবং তার আশপাশজুড়ে ছিল কাসেমীপ্রেমিক জনতার ঢল। এমন গভীর ভালোবাসা আর বেদনা প্রকাশের দৃশ্য সাধারণত দৃষ্টিগোচর হয় না। অনেকের অভিব্যক্তি ছিল, ‘পরিবারের আপনজনদের ইন্তেকালেও এমন বেদনা অনুভব করিনি!’

 

বরেণ্যদের মূল্যায়ন : কয়েক বছর আগের কথা। বরেণ্য মুহাদ্দিস ও ফকীহ শায়েখ আব্দুল মালেক (হাফি.) বসা ছিলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা শামসুল হক (রহ.)-এর সাথে। তখন কথা উঠল যে, হজরত কাসেমী (রহ.) হলেন, শামসুল হক (রহ.)-এর শাগরিদ। তখন শামসুল হক (রহ.) বলে উঠলেন, ‘শাগরিদ তো ওই সময় ছিলেন! এখন তো তিনি মাশাআল্লাহ কত বড় আলেম হয়ে গেছেন! সাথে মাদরাসার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার গুণটিও উল্লেখ করে বললেন, বর্তমানে মাদরাসা ও তালিবে ইলমদের জন্য উৎসর্গিতপ্রাণ মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন! কিন্তু যারা কাসেমী রাহ.কে চেনেন তারা খুব ভালোভাবেই জানেন যে, এই বৈশিষ্ট্যগুলো হজরতের মাঝে বিদ্যমান ছিল পরিপূর্ণভাবে।’ এমনটাই মন্তব্য ছিল- শাগরিদের প্রতি উস্তাদের।

হজরত কাসেমী রাহ.-এর জানাজাপূর্ব আলোচনায় প্রবীণ আলেমেদীন হজরত মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী হাফিজাহুল্লাহ্ আল্লামা কাসেমী (রহ.)কে ‘জামেউল কামালাত’ বা ‘বহুগুণের ধারক’ বলে আখ্যায়িত করেন। দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে শূরার সদস্য মুফতী শফিকুল ইসলাম কাসেমী বলেন, আমি দারুল উলূম দেওবন্দ ও গোটা হিন্দুস্থানের পক্ষ থেকে হজরতের মৃত্যুতে ‘তাযিয়াতে মাসনূনাহ’ জ্ঞাপন করতে এসেছি। তিনি একটি আরবি কবিতা উদ্ধৃত করে বলেন, ‘বহুকাল পেরিয়ে গেলেও মায়েরা এমন সন্তান জন্ম দিতে পারে না।’

ইন্তেকালের পর বেফাকের সভাপতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান জামিয়া মাদানিয়ার মসজিদে রাতের বেলা ভক্তদের উদ্দেশে যে বয়ান করেন, তাতে তিনি বলেন, ‘দেশের প্রতিটি আলেম ও তালেবে ইলম তাঁকে ভালোবাসত।’ সময়ের পরিচিত মুখ। উল্লেখযোগ্য মুহাদ্দিস ও ফকীহ হজরত মাওলানা আব্দুল মালেক কাসেমী তাঁকে অভিহিত করেন ‘নমুনায়ে আসলাফ’ বলে। আল্লামা কাসেমী (রহ.)-এর সুযোগ্য ও বিশিষ্ট শাগরেদ হজরত মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া রাহ. তো অকপটেই বলে গেছেন, ‘আমার জীবনে একশত সতেরজন শিক্ষকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন, আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী।’

দারুল উলূম দেওবন্দের দুটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, ১. বাতিলের সামনে মাথা নত না করা। ২. লোভ ও জুলুমের কারণে হক থেকে বিচ্যুৎ না হওয়া। কোনো সন্দেহ নেই, হজরত কাসেমী (রহ.)-এর মধ্যে এই দুই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। অবশেষে মহান রবের নিকট হূদয়ের একান্ত মিনতি জানাই, তিনি যেন আমাদের পরমপ্রিয় ও পরম শ্রদ্ধেয় হজরত আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী (রহ.)-কে পূর্ণ মাগফিরাত করেন। আপন রহমতের চাদরে ঢেকে নেন। তাঁর যাপিত জীবনের যাবতীয় খিদমত কবুল করেন। তাকে যেন জান্নাতের অতি উঁচু মর্যাদায় সমাসীন করেন। আমিন।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট, বাংলাদেশ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads