• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

বান্দার হক আল্লাহ মাফ করেন না

  • প্রকাশিত ০৬ মার্চ ২০২১

মুফতি নাঈম কাসেমী

 

 

 

এক সাহাবি এসে হজরত  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে শহিদ হয়ে যাই তাহলে কি আমার সব গুনাহ কি মাফ হয়ে যাবে? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: 'তোমরা সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে তবে বান্দার হক সম্পৃক্ত গুনাহ মাফ হবেনা।’ উক্ত হাদিসের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহর দীন জিন্দা করার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিলেও বান্দার হক মাফ হবে না। তাই বান্দার হকের ব্যাপারে খুব সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

হক সাধারণত দুই ধরনের। এক. আল্লাহর হক। দুই. বান্দার হক। আল্লাহর হক বলতে- ইমান, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও জাকাত ইত্যাদি ইবাদতকে বোঝায়। বান্দার হক বলতে বান্দার সঙ্গে সম্পৃক্ত হকগুলোকে বোঝায়। যেমন পারস্পরিক টাকা-পয়সা লেনদেন, টাকা-পয়সার আমানত, কথার আমানত, পারস্পরিক ইজ্জত-সম্মান রক্ষাসহ আরো অনেক কিছু। পিতা-মাতার হক, সন্তানের হক, ভাই-বোনের হক, স্বামী-স্ত্রীর হক ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্বের ভাষণে বান্দার হক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। এ সম্পর্কে ইসলামী শরিয়তের বিধান হলো- যে পর্যন্ত এক বান্দা অন্য বান্দার হক যথাযথভাবে আদায় না করবে অথবা ওই বান্দার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে না নেবে সে পর্যন্ত আল্লাহও তাকে ক্ষমা করবেন না।

একজন মানুষের কাছে অন্য মানুষের টাকা-পয়সা থেকে নিয়ে তার ইজ্জত-আব্রুসহ সবকিছুই আমনত। তা রক্ষা করা প্রত্যেক মানুষের, বিশেষ করে প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। কারও নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, কারো গিবত করা, চুগলখুরি করা, কটু কথা বলা, গালি দেওয়া, কিংবা কারো ইজ্জত-আব্রু নষ্ট হয় এমন আচরণ করে কষ্ট দেওয়ার দ্বারা মূলত তার হক নষ্ট করা হয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাৎ করেন এবং তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি। যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহজাব, আয়াত ৫৭, ৫৮)

তৎকালীন যুগে মুনাফিকরা বিভিন্নভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুমিন মুসলমানদের কষ্ট দিয়ে তাদের হক নষ্ট করতো। আলোচ্য আয়াত দুটিতে আল্লাহ রাসুল ও মুমিন নারী-পুরুষদের কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন। যারা এই হুকুম মানবে তারা সফলকাম হবে। আর যারা মানবে না তাদের জন্য ইহকাল ও পরকালে মহাশাস্তি রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘প্রকৃত মুসলমান তো সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকবে।’ অর্থাৎ কোনো মুসলমান তার হাতের ব্যবহার ও জবানের ভাষা দ্বারা কাউকে কষ্ট দিতে পারে না। শুধু মানুষ কেন? কোনো প্রাণীকেও বিনা অপরাধে কষ্ট দেওয়ার অনুমতি ইসলামে নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দিও না, তাদের লজ্জা দিও না এবং তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজো না।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য কোনো মুসলিমকে কষ্ট দিল, সে মূলত আমাকেই কষ্ট দিল। আর যে আমাকে কষ্ট দিল সে মূলত আল্লাহকে কষ্ট দিল, অর্থাৎ আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করল।’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন কিছু সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ করে বললেন, তোমরা কি জানো মিসকিন কে? সাহাবায়ে কেরাম উত্তরে বললেন যার কাছে টাকা পয়সা নাই সেই তো মিসকিন। তখন হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত মিসকিন হলো ওই ব্যক্তি , যে কিয়ামতের দিন অনেক নামাজ, রোজা ও জাকাত ও দান সদকার নেকি নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু এর সঙ্গে সে এমন অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে। কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে, কারো মাল (অবৈধভাবে) ভক্ষণ করেছে,  কোনো রক্তপাত করেছে এবং কাউকে মেরেছে। অতঃপর হাসরের ময়দানে সকল হকদাররা আল্লাহর দরবারে এসে যার যার হকের কথা বলে বিচার দায়ের করবে তখন সব হকদার তথা (অত্যাচারিত) ব্যক্তিদেরকে  তার  নেকিগুলো দিয়ে দেওয়া হবে। পরিশেষে যদি তার নেকি অন্যদের দাবি পূরণ করার আগেই শেষ হয়ে যায়, তাহলে তাদের পাপরাশি তার ওপর চাপানো হবে। অতঃপর (অন্যদের পাপের বোঝার কারণে) তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এই ব্যক্তি হল আসল মিসকিন ও অসহায়। (তিরমিযি শরিফ)

উপরে উল্লেখিত হাদিসসমূহের প্রতি লক্ষ্য করলে বুঝে আসে, কাউকে কষ্ট দেওয়া, কারও ইজ্জত, আব্রু নষ্ট করা কত বড় অপরাধ। অথচ আমরা অনেকেই অনেক সময় হাসি-তামাশার ছলে অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা ছোট করে মনে কষ্ট দেই, অন্যের নামে মিথ্যা অপবাধ রটাতে থাকি, যা কঠিন গুনাহের কাজ। মনে রাখতে হবে, একজন মুসলমানের জন্য অন্য মুসলমানের ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করা খুবই জরুরি বিষয়। তার প্রতি আমাদের পূূর্ণ খেয়াল রাখতে হবে। দুনিয়ার ক্ষণিকের এই হাসি-ঠাট্টা ও রসিকতার জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। আবার অনেকেই নিজের বোনের হক যা সে পিতার সম্পদ থেকে পাওয়ার কথা তা দেয় না, অথবা এক ভাই অন্য ভাইয়ের সম্পদ আত্মসাত করে ফেলে অথবা গরিব অসহায়দের থেকে জোরপূর্বক ভাবে দখল করে নেয় অথবা এতিমের মাল আত্মসাত করে ফেলে ইত্যাদি। এই সব ভয়াবহ গুনাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে উভয় প্রকার হক যথাযথভাবে আদায় করার এবং সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন।

 

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন মোমেনশাহী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads