• শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

নীরব সাধক : শায়খ হামিদী (রহ.)

  • প্রকাশিত ১৫ মার্চ ২০২১

মুস্তাকিম আল মুনতাজ

 

 

 

চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গল উপজেলাধীন ৫নং কালাপুর ইউনিয়নের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি বরুণা এলাকায় ১৯৪৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রখ্যাত বুযুর্গ সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর সুযোগ্য খলিফা কুতবে দাওরান মুজাদ্দিদে জামান আল্লামা শায়খ লুৎফুর রহমান বণর্ভী রহ. ও  মহীয়সী নারী মরহুমা নুরুন্নাহার মমতাজ বেগমের কোলজুড়ে সুন্দর এ ধরণীতে ভুমিষ্ঠ হন সিলেট বিভাগের বরেণ্য আলেমেদীন, প্রখ্যাত শায়খুল হাদিস, সুদক্ষ পরিচালক, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, নন্দিত গবেষক, মাদানী সিলসিলার সু-উজ্জ্বল দীপাদ্বার, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’র আমীর (সাবেক), ফেদায়ে ইসলাম আল্লামা শায়খ খলিলুর রহমান হামিদী রাহিমাহুল্লাহ। যিনি ‘বরুণার পীর সাহেব’ হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন।

স্বীয় পিতার নিকট হতে তাঁর শিক্ষাজীবনের সূচনা হলেও প্রথমিক কিতাবাদির তা’লিম মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস (রহ.) ও মাওলানা মোশাররফ খান বাহুবলী (রহ.)-এর কাছ থেকে নেন। অতঃপর কিশোরগঞ্জ জামিয়া এমদাদিয়াতে দুই বছর অধ্যায়ন করেন। লেখাপড়াকালীন সময়ে একজন তুখোড় মেধাবী ছাত্র হওয়ার সুবাধে অনেক কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন তিনি। মাওলানা আতহার আলী (রহ.)সহ অন্য উস্তাদগণের ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন সেখানে। ১৩৮৩ হিজরীতে পাকিস্তান করাচির নিউটাউন বিন্নুর মাদরাসায় কয়েক বছর লেখাপড়া করে অত্যন্ত সুনামের সাথে শিক্ষা জীবনের ইতি টানেন তিনি।

করাচি থেকে পড়ালেখা শেষ করে এশিয়ার সর্ববৃহৎ দীনি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন। সেখানে কয়েক মাস সেমাআতের দরস (ক্লাস) করেন এবং হযরত ফখরুদ্দিন মুরাদাবাদী (রহ.)-এর বুখারির সবক নেন। আল্লামা শায়খ খলিলুর রহমান হামিদী (রহ.)-এর উল্লেখ যোগ্য উস্তাদগণ হলেন, মাওলানা আতহার আলী (রহ.), মাওলানা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী (রহ.), মাওলানা ইউসূফ বিন্নূরী (রহ.), মাওলানা ওয়ালী হাসান টুংকি (রহ.) প্রমুখ।

অতঃপর স্বীয় পিতার প্রতিষ্ঠিত মৌলভীবাজারে সর্ব বৃহত্তম দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘জামেয়া লুৎফিয়া আনওয়ারুল উলূম হামিদ নগর বরুণা মাদরাসায়’ কর্ম জীবনের সূচনা করেন। সুনামের সাথে বেশ কয়েক বছর অধ্যাপনা করেন। স্বীয় পিতা জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় ১৯৬৬ সালে মাদরাসার মুহতামিম (প্রিন্সিপাল)-এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মৃত্যুর কয়েকমাস পূর্ব পযন্ত অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর বার্ধক্যজনিত কারণে অবসর নিয়ে সদরে মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন।

একজন প্রতিতযশা মুহাদ্দিস হিসেবে তিনি সর্বজন স্বীকৃত ছিলেন। হাদিসের আসনের সর্বোচ্চ স্থান শায়খুল হাদিস হিসেবে দীর্ঘ ৪০ বছরের অধিক সময় সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সহিহ তিরমিযিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিতাব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দারস (ক্লাস) করে গিয়েছেন। অধ্যাপনার ফাঁকে ফাঁকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ-নসিয়তের মাধ্যমে ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। তাঁর ওয়াজ-নসিয়তে হাজারো পথ ভুলা মানুষ পেয়েছে সঠিক পথের দিশা। বিশেষত তাঁর হূদয়গ্রাহী মোনাজাতে হাজারো মানুষের গণ্ডদেশ বেয়ে অশ্রু ঝরতো অঝোর ধারায়।

আধ্যাত্মিকায় তিনি ছিলেন একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব। সর্বজন স্বীকৃত বুযুর্গ ও স্বভাবজাত ওলী। স্বীয় পিতা শায়খে বণর্ভী (রহ.)-এর কাছে তাসাউফের দীক্ষা লাভ করেন এবং এজাজতলাভে ধন্য হন। শায়খ আব্দুন নূর ইন্ধেশ্বরী এবং হজরত আব্দুল কাদীর এস আই তেতৈয়ার কাছ থেকেও এজাজতপ্রাপ্ত হন। শায়খুল ইসলাম হজরত হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর ভারতের বাশকন্দিরে সর্বশেষ এতেকাফে পিতার সাথে গিয়ে সাক্ষাত করে  দোয়া হাসিল করেন।

শুধু অধ্যাপনা কিংবা ওয়াজ-নসিয়তেই তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন না। লেখালেখির ময়দানেও তিনি ছিলেন সরব। তিনি বেশ কিছু পুস্তক রচনা করেন। তন্মধ্যে- (১) হেফাজতে ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষা, (২) ছয় মন্জিলের বিবরণ, (৩) আনওয়ারুত তিরমিযি উর্দূ (১ ম খণ্ড), (৪) বিখ্যাত মুহাদ্দিস ওয়ালী হাসান টুংকি (রহ.)-এর দারসের করা ১০০০ পৃষ্ঠার নোট (৫) খলিলুর রহমান রচনাবলি (ওনার বিভিন্ন প্রবন্ধাবলির সংগ্রহ) (৬) তাকরিরে বুখারি (পাণ্ডুলিপি), (৭) বিখ্যাত হাদিস বিশারদ হজরত ইউসুফ বিন্নূরী (রহ.)-এর দারসের নোট (৭) শবে বরাতের বয়ান; বইগুলো উল্লেখযোগ্য।

সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বেও তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। স্বীয় পিতার ইন্তেকালের পর থেকে ‘আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’-এর আমির হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়াও মাসিক হেফাজতে ইসলাম পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর সহ-সভাপতি, শেখবাড়ি জামিয়া মাদরাসার উপদেষ্টা, সেইভ হিউম্যনিটি ইউ.কে-এর উপদেষ্টা, ‘আল-খলিল কোরআন শিক্ষা বোর্ড’-এর উপদেষ্টাসহ মৌলভীবাজারের বেশ কয়েকটি মাদরাসার উপদেষ্টা ও অভিবাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আল্লামা শায়খ খলিলুর রহমান হামিদী (রহ.)-এর শারীরিক অবনতি হলে প্রথমে সিলেট ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে আইসিইউতে কয়েকদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও তাহাজ্জুদ (ইশারায়) আদায় করেছেন। উনার এমন কার্যকলাপে ডাক্তারও অবাক হয়েছেন। অতঃপর উনার কথায় স্বীয় বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। বাড়িতে আসার পরও চিকিৎসকগণের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিলেন তিনি। অতঃপর ২০২০ সালের ৯ অক্টোবর শুক্রবার রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে আনুমানিক রাত ৩ ঘটিকার সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। তাঁর এই শূন্যতা অপূর্ণনীয়। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। তিনি তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়েসহ অসংখ্য ছাত্র, ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে গেছেন। তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী স্বীয় পিতার মাকবারার (কবর) পাশে (পারিবারিক কবরস্থান, বরুণা মাদরাসায়) দাফন করা হয়। আল্লাহ তাঁর প্রিয়বান্দাকে রহমতের চাদরে আবৃত রাখুন। আমিন।

 

লেখক : আলেম, শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক ছন্দপাতা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads