• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
ইসলাম শান্তির পয়গাম

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

ইসলাম শান্তির পয়গাম

  • প্রকাশিত ২২ মার্চ ২০২১

বিশ্বের ইসলামবিদ্বেষী প্রচারমাধ্যমসমূহের অবিশ্বস্ততা ও পক্ষপাতদুষ্ট নীতির অশুভ পরিণাম দাঁড়িয়েছে এই যে, বিভিন্ন মহল কর্তৃক আজ বিশ্বের সর্বত্র ইসলামকে জুলুম, বর্বরতা, পাশবিকতা ও সন্ত্রাসের ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ওই প্রচার মিডিয়াগুলো এখন তাদের সংবাদ, প্রতিবেদন, সমীক্ষা, ছায়াছবি, সাক্ষাৎকার, প্রচারপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে অহরহ এ ধারণা সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছে যে, ইসলাম ও শান্তি এমন দুটি পরস্পরবিরোধী বস্তু। তাদের একত্রে সমাবেশ কখনো সম্ভব নয়। ইসলামী শিক্ষাকে মোটামুটিভাবে অধ্যয়ন করলেও উপরোক্ত ধারণা যে অমূলক ও ভিত্তিহীন, তা যে কোনো বিবেকসম্পন্ন লোকের পক্ষে হূদয়ঙ্গম করা মোটেই কঠিন নয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম যেভাবে শান্তি ও নিরাপত্তা, ঐক্য ও সাম্য এবং ইনসাফ ও ন্যায়নিষ্ঠতার প্রতিনিধিত্ব করে, তার বাস্তব দৃষ্টান্ত পেশ করা বিশ্বের কোনো ধর্ম, সভ্যতা বা সমাজ ব্যবস্তার পক্ষে আজো সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। নবী হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের প্রধান লক্ষ্যই ছিল মানুষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। এই অর্থে তিনি ছিলেন বিশ্ববাসীর জন্য রহমত তথা আশীর্বাদস্বরূপ। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মোহাম্মদ! আমি তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭)

সত্যিকারের অর্থে ইসলাম হচ্ছে আগাগোড়া একটি আশীর্বাদ। সন্ত্রাস, জুলুম, অত্যাচার, বর্বরতা ইত্যাদি অসামাজিক অমানবিক অনাচার ও কদাচারের সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্ক নেই। ইসলাম একজন অমুসলিমের কাছে এই দাবি করে যে, সে যেন স্থির, ধীরতা ও বিচক্ষণতার সাথে ইসলাম অধ্যয়ন করে এবং গভীরভাবে তার ক্রিয়াকর্মগুলোও প্রত্যক্ষ করে। আর একজন মুসলিমকে নির্দেশ দেয়, সে যেন অমুসলিম বিশেষ করে আহলে কিতাব তথা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের হিকমত ও বিজ্ঞতার সাথে উপদেশ প্রদান করে। বুঝিয়ে-শুঝিয়ে তাদের ইসলামের তথা শান্তি ও সম্প্রীতি আন্দোলনের নৈকট্যে নিয়ে আসে। তাদের সাথে অযথা তর্ক-বিতর্ক করবে না, আর এমন কোনো আচরণও  করবে না যার ফলে তাদের সাথে হিংসা-বিদ্বেষ বা শত্রুতা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করলেও তা করতে হবে সৌজন্যের সাথে, যুক্তি ও প্রমাণের সাথে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত আহলে কিতাবের সাথে বিতর্ক করবে না। তবে তাদের সাথে করতে পারো, যারা ওদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী। আর বলো, আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাতে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো এক আল্লাহ। আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী।’ (সুরা আনকাবুত : ৪৬) এই আয়াতের মাধ্যমে ইসলামের অনুসারীদের পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা প্রতিপদে স্থিরতা, ধীরতা, বিজ্ঞতা ভদ্রতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। তারা যেন রূঢ় কথার জবাব নম্র কথায় এবং রাগের জবাব সহিষ্ণুতায়, অভদ্রতার জবাব ভদ্রতায় এবং হৈচৈ, চেঁচামেচির জবাব নম্রতা ও গাম্ভীর্যের সাথে প্রদান করে। হ্যাঁ, যদি কেউ বিজ্ঞতাপূর্ণ প্রমাণভিত্তিক কথার জবাব ঔদ্ধত্যের সাথে প্রদান করে তাহলে তার সাথে তারই মানানসই ভাষা ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এ অবস্থায়ও এটা শ্রেয় যে, যথাসম্ভব নম্রতা ও ভদ্রতাকে যেন হাতছাড়া না হয়। পবিত্র কোরআনে মুসলমানদের আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের সাথেও অনুরূপ আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত (বিজ্ঞতা) ও সদুপদেশ দ্বারা এবং ওদের সাথে আলোচনা-পর্যালোচনা (বিতর্ক) কর সদ্ভাবে।’ (সুরা নাহল : ১২৫)

পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন স্থানে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে মুসলমানকে এই শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে যে, তারা যেন সবাইকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে। ভালো দ্বারা খারাপকে প্রতিরোধ করে। সব সময় যেন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দেয় এবং কোনো অবস্থায়ই যেন শান্তি-শৃঙ্খলা ও ন্যায়-বিচারকে হাতছাড়া না করে। তাদের প্রধান চিন্তা যেন এমন হয়, কীভাবে আমি আমার সম্বোধিত ব্যক্তির অন্তরে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করব এবং কীভাবে তাকে দেখাতে সক্ষম হব সরল ও সঠিক পথ। এভাবে যদি তা (মুসলমানের) দলিল-প্রমাণ অন্যদের (অমুসলিমদের) বোধগম্য হয়, তার আচার-আচরণ সভ্য ভব্য হয়, ইসলাম তথা একটি সরল সঠিক দ্বীনকে বোঝানোর লক্ষ্যেই তার কথোপকথন হয়, তাহলে অবশ্যই সে সম্বোধিত ব্যক্তির (অমুসলিমদের) চিন্তাধারার সংশোধন ও প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনে সক্ষম হবে। বিনয় ব্যবহার ও বিনম্র আচরণের প্রতিফল সবসময়ই সুন্দর ও আকর্ষণীয়  হয়ে থাকে। তা পবিত্র কোরআনে নিম্নে আয়াত দ্বারা অতি সহজেই বোঝা যায়। ‘ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো।’ (সুরা হা-মীম সাজদা : ৩৪)

ইসলাম এতই শান্তিপ্রিয় ধর্ম যে, মুসলমানকে যুদ্ধাবস্থায়ও জুলুম ও বাড়াবাড়িমূলক আচরণ থেকে নিরস্ত রাখে। নির্দোষ মানুষকে বিরক্ত করতে নিষেধ করে। যে কারো  সাথে অমানবিক ব্যবহার থেকে দূরে রাখে। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘শত্রুরা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখবে। তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আনফাল ৬১) যারা দুশমনের পেশকৃত সন্ধির আহ্বানে সাড়া দেয়, তারা মূলত ওদের মানবিক ও চারিত্রিক স্পৃহাকে জাগ্রত ও প্রস্ফুটিত করে তোলে। নিজেদেরকে ওদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্রে পরিণত করে। এ জাতীয় লোকদের আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কৃত করেনি, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মুমতাহানা : ৮)

যেসব অমুসলিম মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনোরূপ ষড়যন্ত্র করে না এবং তাদের কোনোরূপ কষ্ট দেয় না, ইসলাম তাদের সাথে দয়া, মায়া, হূদ্যতা, সহানুভূতি, শুভাকাঙ্ক্ষা ও শুভেচ্ছামূলক আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। অবশ্য যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তাদের সাথে তাদেরই কর্মদোষের কারণে ভালো ব্যবহার করা যাবে না সত্য, তবে কোনো অবস্থায়ই বাড়াবাড়িমূলক আচরণ করা যাবে না। বরং বাহ্যিকভাবে হলেও তাদের সাথে যথাসম্ভব সভ্য আচরণ করতে হবে। আর কোনোরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে, তাদের সাথে সব রকমের ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতেও আপত্তির কিছুই নেই। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন এবং পরবর্তী যুগের মুসলিম মনীষীদের জীবনে এমন অসংখ্য ঘটনা পরিদৃষ্ট হয়, যেগুলোতে অমুসলিমদের সাথে দয়ার্দ্র ব্যবহার ও বিনয় নম্র আচরণের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে অমুসলিমদের সাথে সর্বাবস্থায় মানবতাসুলভ দয়ার্দ্র আচরণ করেছেন, তার দৃষ্টান্ত মানব ইতিহাসে বিরল।

মক্কা বিজয়ের মুহূর্তে ইসলামের কট্টর শত্রুদের যাদের অমানুষিক জুলুম অত্যাচারের কারণে একদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশ্রুসজল নয়নে আপন প্রিয় মাতৃভূমি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের তিনি বিনাশর্তে ক্ষমা করে দেন। বিশ্ব-ইতিহাসে এ ধরনের দৃষ্টান্ত শুধু তুলনাহীন নয়, অকল্পনীয়ও বটে। অবশ্য তাঁর এই ব্যবহারের ফলে ওইসব কট্টর শত্রুর হূদয় বলতে গেলে নিমিষের মধ্যেই এমন পরিবর্তন আসে যে, তারা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। দলে দলে ইসলাম তথা শান্তির সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। নবীজির কট্টর শত্রু মক্কাবাসীরা যখন ভয়ানক দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়, তখনো দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনতিবিলম্বে তাদের কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধে যেসব কাফের বন্দি হতো, তিনি তাদের সাথে আপন সহোদরের মতো ব্যবহার করতেন।

তায়েফে আল্লাহর দ্বীন প্রচার করতে গেলে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রস্তর নিক্ষেপে রক্তাক্ত করে তোলা হয়। এতদসত্ত্বেও তিনি তাদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। পরবর্তীকালে যখন তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হন, তখনো তাদের ওপর কোনো প্রকার প্রতিশোধ নেননি। বরং তাদেরকে অকাতরে ক্ষমা করে দেন। আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা-কাজে ও আচার-আচরণে যে নম্রতা, ভদ্রতা ও ধৈর্য-সহিষ্ণুতার নমুনা পেশ করেছেন তা চিরদিন মানুষের জন্য অনুকরণীয়  ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। নবীজি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে নম্রতা যে জিনিসের মধ্যে আছে, সে জিনিস সৌন্দর্যমণ্ডিত। আর নম্রতা যে জিনিসের মধ্যে নেই সে জিনিস দূষণীয়।’ (সহিহ মুসলিম) বিনয়, নম্রতা, দয়া, করুণা, সদাচার, সদালাপ, সদ্ব্যবহার প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য ইসলাম তার অনুসারীদের বার বার তাগিদ দিয়েছে। আর নির্দেশ দিয়েছে কঠোরতা, নির্দয়তা, অনাচার, অবিচার ও বদমেজাজী থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা পরম করুণাময় এবং তিনি প্রতিটি ব্যাপারেই বিনয় ও করুণাকে পছন্দ করেন।’ (বুখারি শরিফ)

রহমতের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মহান রাব্বুল আলামীন নম্রতার ওপর ততটুকু দান করেন, যতটুকু কঠোরতার ওপর করেন না এবং নম্রতা ছাড়া অন্য কিছুর ওপরও অনুরূপ দান করেন না। (মুসলিম শরিফ) বিনয় নম্রতাকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার পছন্দ করাটা এ কথারই ইঙ্গিতবহ যে, এর মধ্যে মানুষের দুনিয়া-আখিরাতের যাবতীয় উপকার ও মঙ্গল নিহিত রয়েছে। অতএব মানুষের উচিত, তারা যেন নিজেদের মধ্যে নম্রতা, স্নেহমমতা ও দয়ার্দ্রতারূপী গুণাবলির প্রসার ঘটায়, যাতে তাদের সামাজিক, সামষ্টিক ও সামগ্রিক জীবন সুখ-শান্তিতে ভরে ওঠে। তারা সব রকম নির্দয়তা, স্বার্থপরতা, অনাচার, কাদাচার, মারামারি, হানাহানি, সন্ত্রাস ও বিশ্বাসঘাতকতা থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হয়। কেননা যে সমাজে বা রাষ্ট্রে পরস্পর স্নেহ-ভালোবাসা বিস্তার লাভ করে, সে সমাজ বা রাষ্ট্র অবশ্য অবশ্যই সুখ-শান্তির জোয়ারে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ।

লেখিকা : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads