• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
আত্মহত্যার কারণ ও প্রতিকার

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

আত্মহত্যার কারণ ও প্রতিকার

  • প্রকাশিত ২৪ মার্চ ২০২১

আত্মহত্যা একটি ভয়ংকর অপরাধ ও মানসিক ব্যাধি। ইসলামে আত্মহত্যা মহাপাপ। পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়জনিত কারণে স্বাভাবিক মৃত্যুকে না মেনে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেই। মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা ও মানসিক বেদনা ও অর্থনৈতিক দৈন্যতা বেড়ে গেলে চরম হতাশা কাজ করে। হতাশাই নিজের মধ্যে নেতিবাচক ধারণাগুলো তৈরি করে। এক পর্যায়ে মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তখনই মানুষ আত্মহত্যা করে। একাজ যারা করেন তাদেরকে আত্মঘাতক বা আত্মহনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করোনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করে, তাকে আগুনে দগ্ধ করব এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত-২৯, ৩০)

যেহেতু মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর দায়িত্ব মহান আল্লাহতায়ালার হাতে তাই মানুষ কোনো অবস্থাতেই এটিকে নিজের হাতে তুলে নিতে পারেনা। আল্লাহতায়ালা ও তাঁর প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং পরকালে এর কঠিন শাস্তির খবরও দিয়েছেন। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বস্তু দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে কিয়ামতের দিন তাকে সে বস্তু দিয়েই শাস্তি প্রদান করা হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৭০০, মুসলিম, হাদিস নং-১১০) অন্যত্র রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে যাবে। সেখানে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে বিষ তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে বিষ খাইয়ে মারতে থাকবে অনন্তকালে ধরে। যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করবে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে, যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে নিজে ফোঁড়তে থাকবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৪৪২) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শার আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে দোজখেও সে নিজেকে সেভাবে শাস্তি দেবে। আয় যে নিজেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, কিয়ামতের দিন সে নিজেকে ওপর থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করবে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান-৫৯৮৭, তাবরানী-৬২১)

আজকাল আত্মহত্যার ঘটনা প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছে। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তরুণ-তরুণীরা এই প্রবণতায় জড়িত হন বেশি। সাথে সাথে উচ্চপদের কর্তা, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, কর্মজীবী, দিনমজুর, ব্যবসায়ীগণ মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে থাকেন। পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় দশ লাখ লোক আত্মহত্যা করে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে দেশে প্রতি বছর দশ হাজার একশত সাতষট্টি জন মানুষ এই পথে পা বাড়ায়। উক্ত সংস্থাটির মতে সারা বিশ্বে অত্মহত্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান তেরোতম। আর আত্মহত্যার চিন্তায় মনঃস্তাত্ত্বিক রোগে ভোগে বিশ্বে প্রায় দশ কোটি মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ১৮/০২/২০২১ তারিখে একটি উদ্বেগজনক তথ্য উপস্থাপন করেছে। সেখানে দেখা যায়, পুরো ২০২০ সালটি ছিল কোবিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের বছর। বিশ্বব্যাপী এতো মৃত্যুর মিছিল আর কোনো মহামারীতে দেখেনি কখনো। বি.বি.এস. বলেছে, ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৫ হাজার ২ জন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে উক্ত নয় মাসে আত্মহত্যায় মারা গেছেন ১১ হাজার মানুষ। অর্থ্যাৎ করোনার চাইতে আত্মহত্যায় মৃত্যুর হার দ্বিগুণ।

বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য মতে পূর্বের বছর গুলোতেও এই প্রবণতার রূপ ছিল ভয়াবহ। ২০১৮ সালে ১১ হাজারের বেশি মানুষ, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ১১ হাজার ৯৫ জন, ২০১৬ সালে ১০ হাজার ৬০০ জন, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৫০০ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছিল। উক্ত হিসাবকে দৈনিক ভাগ করলে গড়ে প্রতিদিন ৩০ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে।

বর্তমান যুগ হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। তাই আত্মহত্যার প্রবণতাতেও যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন কারণ। বিশেষত ব্যক্তি বিশেষের মানসিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতাও আত্মহত্যার কারণ হতে পারে। দৈনন্দিন জীবনের নানা জটিলতা ও প্রযুক্তির প্রতি মানুষের অত্যধিক আসক্তি বাড়লেও আত্মহত্যার প্রবণতার মধ্যে খুব পরিবর্তন হয়নি। মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাগুলো দুর্বল হয়ে গেলে মানুষ অসহায় বোধ করে এবং এক পর্যায়ে আত্মহত্যা করে ফেলে। পৃথিবীজুড়ে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ আত্মহত্যা। যারা মনের দিক থেকে দুর্বল, ধৈর্য ও সহ্য ক্ষমতা যাদের কম অবসাদ ও হেনস্থার  শিকার হয়ে এবং হঠাৎ কোনো পরিবর্তনের সাথে সহনশীল হতে না পেরে বিপদগামী হয়। অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায় মানসিক চাপ। এই চাপ সহ্য করতে না পারলে মানুষটি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে এই পথ বেছে নেন।

একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে আত্মহত্যাকারীদের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ তাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে আপনজনদের সাথে শেয়ার করে থাকেন। ঠিক সেই সময়ে ওই ধরনের মানুষের মনকে অন্যদিকে ধাবিত করতে পারলে বেঁচে যায় একটি জীবন। সত্য প্রমাণিত হয়ে যায় তার জন্য কবিগুরুর অমর বাণী ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে’। মাদকাসক্ত, শিক্ষার অভাব, দাম্পত্য কলহ, যৌন নির্যাতন, প্রেমে ব্যর্থতা, খারাপ ফলাফল, কারো প্রতারণা বা ছলনার শিকার হয়েও মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। মানুষের জীবন অত্যন্ত মূল্যবান এবং এটি আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ। যে মহান প্রতিপালক আসমান-জমিন, মানব-দানব, পানি-বায়ুসহ  সবকিছু সৃষ্টি করেছেন তিনিই আবার এই পৃথিবীকে বানিয়েছেন পরীক্ষাগার রূপে। পৃথিবীতে ভালো-মন্দ, আশা-নিরাশা, দুঃখ-কষ্ট, পাওয়া-নাপাওয়া ইত্যাদি চিরাচরিতভাবে থাকবেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কিছু ভয় ও ক্ষুধা, জান ও মাল এবং ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে পরীক্ষা করবো। আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন। (সূরা বাকারা-১৫৫) পৃথিবীতে মানুষের পরীক্ষার উপকরণ হলো কষ্ট ও দুঃখ। আর ওই দুঃখ-কষ্টই মানুষকে অনেক সময় নিরাশ করে ফেলে। অনেক সময় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা নিজেদের রোগযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা করে থাকে।

ইসলামে জীবন রক্ষা করা যেমন ফরজ তেমনি জীবন ধ্বংসের সকল পথ বা উপায় অবলম্বন নিষিদ্ধ। কেননা ইসলামের একটি চিরন্তন বিধান হলো যে, এতে কোনো বিষয়কে নিষিদ্ধ করলে তার সহযোগী সব বিষয়গুলো নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়। যার ফলে আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পাশাপাশি অনুরূপ অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে দোয়া করতেন। হাদিসে রয়েছে, আবুল ইয়াসার থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ দোয়া করতেন, হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করা  থেকে আশ্রয় চাই, আশ্রয় চাই গর্তে পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ হতে, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই পানিতে ডুবে ও আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ থেকে এবং অতি বার্ধক্য থেকে। আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই মৃত্যুকালে শয়তানের প্রভাব থেকে, আমি আশ্রয় চাই আপনার পথে জিহাদ থেকে পলায়নপর অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা হতে এবং আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই বিষাক্ত প্রাণীর দংশনে মৃত্যুবরণ থেকে।’ (আবু দাউদ-১৫৫২)

আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে সম্মিলিতভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যে সমস্ত কারণগুলো আত্মহত্যাকে উচকে দেয় সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। বিষন্নতা ও মানসিক রোগ দেখা দিলে সুচিকৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। মূলত মানসিক রোগ হয় মস্তিষ্কে রাসায়নিক পদার্থের তারতম্যের মাধ্যমে। তই উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ অনেকাংশেই সেরে যায়। গবেষকরা মনে করেন আত্মহত্যাকারীদের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ আত্মহত্যা আগ্রহ জন্য জনের কাছে প্রকাশ করেন। তখন সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে হবে। সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেও আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী ও চেষ্টাকারীর জন্য সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান রয়েছে। পরিবারের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। সকলের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। বিশেষ করে সন্তানদেরকে শারীরিক, মানসিক চাপ মোকাবিলা করার জন্য ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা দিতে হবে।

স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীর আবেগ অনুভূতিগুলো নিজের মধ্যে জমিয়ে না রেখে অন্যের সাথে শেয়ার করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন তিনি হয়তো অসহ্য যন্ত্রণা ও মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা কষ্টের মোকাবিলা  করেছেন কিন্তু অপরদিকে তার শূন্যতা কখনো পূরণ হবার নয়। কখনো মেনে নেওয়া যায়না এই আত্মহত্যা। বরং তিনি যদি সেই পথ না ধরে সহনশীলতার পথে চলতেন তাহলে হয়ত পরবর্তীতে সফলতার চাবি নিয়ে হাজির হতো তার জন্য অনাগত ভবিষ্যৎ। মানব জীবনের প্রতিদিন নতুন সূর্যোদয়ের মাধ্যমে নতুন নতুন আশার আলো তৈরি হয়। এ বিশ্বাস আমাদের সকলকেই পোষণ করতে হবে। আমাদের উচিত জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত জীবন গঠনে আত্মনিয়োগ করা। একটি আত্মহত্যা মানে একটি জীবনের অপচয়। আর জীবনতো একটাই  যা ফিরবেনা কখনো।

লেখক : সহকারী শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা)

 চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads