• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

স্বাধীনতা যুদ্ধে ওলামাদের অবদান

  • প্রকাশিত ২৬ মার্চ ২০২১

মোহাম্মদ শরীফ

 

 

 

আল্লাহপাক বাঙালি জাতিকে অসংখ্য-অগণিত নেয়ামত দান করেছেন। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত হচ্ছে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। এদেশ এমন এক প্রাকৃতিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড, যার একটি গাছের নিচে ঘাসের ওপর শুয়ে একটু ঘুম গেলেও স্বর্গীয় সুখ অনুভূত হয়। এদেশের এক গ্লাস পানি পান করলে মনে হয় যেন অমিয়সুধা। এটা এমন এক দেশ যা খনিজসম্পদে ভরপুর। এদেশে রয়েছে মনোমুগ্ধকর বন। রয়েছে কয়টি ঋতু, প্রতিটি ঋতুতে রয়েছে ভিন্ন রকম সৌন্দর্য, যা অনুভব করা ছাড়া বোঝানো সম্ভব নয়। ফুলে ফলে সবুজ শস্য-শ্যামলে ঘেরা এদেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মনে হয় এ যেন এক ভূস্বর্গ। এদেশের প্রতিটি মানুষের হূদয় মায়া-মমতা ও সহমর্মিতায় ভরপুর। এটা এমন এক দেশ যেখানে ৯২ শতাংশ মানুষ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও সকল ধর্মের মানুষ নির্বিঘ্নে স্ব-স্ব ধর্ম পালন করতে পারে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। আগে থেকেই ক্ষমতালোভী হায়েনাদের হিংস্রতার শিকার হতে থাকে এ দেশ। চলতে থাকে এবং অদ্যাবধি চলছে এর ধারাবাহিকতা।

উল্লেখ্য, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনাধীন থাকায় জালিম শাসক কর্তৃক এদেশের মানুষ বঞ্চিত হতে থাকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে। বঞ্চিত করা হয় উচ্চশিক্ষা অর্জন থেকে। চালানো হয় জুলুমের স্টিমরোলার। যখন সমাজের প্রতিটি পরতে পরতেই চলতে থাকে খুন, জুলুম, শোষণ, অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার। এমনকি আমার মায়ের মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার পাঁয়তারাও চলতে থাকে। এ দেশকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করার লক্ষ্যে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে ঢাকা শহরে চালানো হয় নির্বিচারে গণহত্যা। হত্যা করা হয় মহান বুদ্ধিজীবীদের। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সামনে সব হত্যাকাণ্ড প্ল্যান হয়ে যায়। মোটামুটি তখন থেকেই খুব জোরেশোরেই শুরু হয় পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন। দিন দিন বেড়েই চলল। এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল এদেশের স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি ও মাদরাসার লাখ লাখ ছাত্রসমাজ। এদের সাথে যোগ দেন দেশের কৃষক, শ্রমিকসহ সমাজের প্রতিটি পেশার মানুষ। এটা যেহেতু কোনো ধর্মযুদ্ধ ছিল না, তাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যোগদান করেছিল এ যুদ্ধে। এ যুদ্ধ ছিল জালিমের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেওয়ার, যাতে সবাই সাম্য বজায় রেখে চলতে পারে, সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। কৃষক তার ন্যায্য অধিকার পায়। এদেশের সন্তানরা উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারে।

এদেশে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় আলেম-ওলামাদের ভূমিকা ছিল ঈর্ষণীয়, অস্বীকার করার অবকাশ রাখে না। ইতিহাসের পাতায় পাতায় তা লিপিবদ্ধ আছে। বলা বাহুল্য, ইতিহাসকে কখনো লুকানো যায় না। এদেশের কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ইতিহাস বিকৃত করতে চাইলেও, এদেশের জনগণের অজানা নয় যে, অসহযোগ আন্দোলন, ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর অসহযোগ ও মুক্তিসংগ্রামসহ জাতির প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে ওলামাদের ভূমিকা কী ছিল? বর্তমানে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেসব পাঠ্যপুস্তকে মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস পড়ানো হয় সেগুলো হচ্ছে অসম্পূর্ণ ইতিহাস। যদি তা-ই না হতো, তাহলে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেম-ওলামাদের যে অগ্রণী ভূমিকা ছিল সেই ইতিহাসগুলোকে কেন লুকিয়ে রাখা হলো? নতুন প্রজন্মকে সত্য ইতিহাসগুলোকে জানা থেকে কেন দূরে রাখা হলো? সেগুলো সম্পর্কে জাতি উদাসীন নয়।

ইতিহাসকে বিকৃত করে দিনের অতন্দ্র প্রহরী আলেম-ওলামা ও দাড়ি-টুপি ওয়ালাদেরকে  ঢালাওভাবে রাজাকার বলে  অপবাদের মে তকমা লেপন করা হয়, আসলে বিষয়টি কি এমন? নাকি সুদূরপ্রসারী কোনো ষড়যন্ত্রের জাল? অথচ উলামা ও দাড়ি-টুপিওয়ালাদের অবস্থান ছিল স্বাধীনতার পক্ষে, বর্বর পাকিস্তানিদের বিপক্ষে যার প্রমাণ অহরহ। ইতিহাস সাক্ষী মাদরাসার প্রিন্সিপাল, শিক্ষক, মুফতি-মুহাদ্দিসগণ মুক্তিযুদ্ধে শুধু অংশগ্রহণ‌ই  করেননি বরং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকেও যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রাগার ও আশ্রয়স্থল করে দিয়েছিলেন। যশোর রেল স্টেশন মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আবুল হাসান যশোরী এবং তার মাদাসার ছাত্র-শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। যার কারণে ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তার মাদরাসায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। এতে প্রায় ২১ জনকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। আহত হন আরো অনেকেই। শহীদ হন মাদরাসার স্বনামধন্য শিক্ষক আল্লামা হাবিবুর রহমানসহ ৫ জন ছাত্র। আর বাকি ১৫ জন মাদ্রাসায় আশ্রয় নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মাদরাসা প্রাঙ্গণে সেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর রয়েছে।

ময়মনসিংহের ইমাম মাওলানা ইরতাজ আলী কাশিমপুরিকে জুমার ইমামতি করতে বাধ্য করা হলে তিনি বলেন, পরাধীন দেশে জুমার ইমামতি করতে পারবো না। এ কারণেই দিবালোকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় মাওলানাকে। এছাড়াও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আরো অনেক ওলামাদের অসংখ্য অবদান রয়েছে। শত সহস্র আলেম-ওলামা মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। সবার বিস্তারিত অবদানের তথ্য এই ছোট্ট প্রবন্ধ উপস্থাপন করা বড়ই দুষ্কর। তবু যাদের কথা স্মরণ না করলে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মৌলভী সৈয়দ, যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম নগর গেরিলা অধিনায়ক ছিলেন। তার কমান্ডে নগর জেলা অপারেশন পরিচালিত হয়। তাদের মধ্যে আরও ছিলেন মাওলানা এমদাদুল হক, মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ, মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, মাওলানা আব্দুর রহমান, মাওলানা আব্দুর রব এবং চট্টগ্রামের ৫২ এর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক, মুহাদ্দিস আব্দুস সোবাহান এবং ঢাকা লালমাটিয়া শাহী মসজিদের মুয়াজ্জিন মৌলভী উসমান গনি, মৌলভী নুরুল আবসার ও সাংবাদিক মাওলানা আব্দুল আউয়াল, মাওলানা মুস্তাফিজ এবং মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ প্রমুখ শত শত ওলামায়ে কেরাম। এদেশের আলেম-ওলামা পীর-মাশায়েখ সব সময় জনচেতনার সঙ্গে শুধু থাকেনি বরং নেতৃত্বও  দিয়েছেন। একাত্তরে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) জাতিকে উদ্দেশ করে বলেন, জুলুম ও ইসলাম কখনো এক হতে পারে না। বাঙালিরা মজলুম সুতরাং বাঙালিদের পক্ষে কাজ করো। তাছাড়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

এদেশের মানুষ কি ভুলতে পারবে বাঁশেরকেল্লার শহীদ তিতুমীরের কথা? ভুলতে পারবে কি হাজী শরীয়তউল্লাহ, পীর দুদু মিয়া , ফকির মজনু শাহসহ আরো অগণিত মুক্তিসংগ্রামী ওলামাদের কথা? ভাষা আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী ও মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ প্রমুখ দেওবন্দী আলেম ওলামাদের সংগ্রামী আন্দোলনের ইতিহাসও কি মিথ্যা? মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ২৪৩ দিন আত্মগোপনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার পরামর্শে অসংখ্য মানুষ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার সহায় সম্পদ লুটপাট করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম, মাওলানা সিদ্দিক আহমদ, মাওলানা ফয়জুর রহমান, মাওলানা আতহার আলীর কথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? ৬ দফা আন্দোলনের অগ্রনায়ক মাওলানা অলিউর রহমানের কথা কি মুছে ফেলার? স্বাধীনতা সংগ্রামের নির্ভীক সৈনিক আলেমগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে কেবল সমর্থনই করেননি বরং পাকিস্তানি বর্বরদের মোকাবিলায় যুদ্ধে যোগদান করেছেন, আহত হয়েছেন, আহত করেছেন, হত্যা করেছেন এবং শহীদ হয়েছেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রামী ওলামার সংখ্যা এক-দুজন নয় বরং দৃষ্টির সীমায় প্রলম্বিত সেই তালিকা। পরিশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা নোমান (রহ.)-এর সেই আক্ষেপমাখা কথা জাতিকে স্মরণ করে দিতে চাই। তিনি বলেছিলেন, আমরা যে আশা করে দেশটাকে স্বাধীন করেছি তা আজো কিন্তু অপূর্ণই রয়ে গেছে। সুতরাং আমাদের দাবি হলো মুক্তিসংগ্রামের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে পড়ানো হোক। সমস্ত পাঠ্যপুস্তক থেকে অবাঞ্ছিত, অসম্পূর্ণ ইতিহাসকে বাদ দিয়ে সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হোক, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক ইতিহাসকে জানতে পারে। দেশের আলেম-ওলামা দাড়ি-টুপিওয়ালাদের দেশের প্রতি যে অবদান রয়েছে, এটা জাতির সামনে উন্মোচিত হোক।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া হামিউসসুন্নাহ মেখল

হাটহাজারী, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads