• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ধৈর্য সফলতার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম

  • প্রকাশিত ২৮ মার্চ ২০২১

হাফিজ শাহ্ আলম সজীব

 

 

পৃথিবী এমন একটা জায়গা যেটা দুঃখ-শোকে পরিপূর্ণ। এখানে সুখের চেয়ে দুঃখের আয়োজনই বেশি। হাসির চেয়ে কান্নার উপকরণই অধিক। মানবজীবনের সূচনা হয় কান্না দিয়ে। এরপর থেকে বয়স, অভিজ্ঞতা ও সহনশীলতার সমাবর্তনে কান্নার প্রকৃতি ও পরিধি পরিবর্তিত হতে থাকে। এর রেশ মিহি থেকে মিহি, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে থাকে। জন্মকালীন অকারণ কান্নার ধীরে ধীরে শত শত, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি একথায় অসংখ্য কারণ তৈরি হতে থাকে। রোগ-শোক ও দুঃখ-দুর্দশা জীবনের গতি রোধ করে। বেঁচে থাকার স্বপ্নগুলোর টুঁটি টিপে ধরে। রঙিন পৃথিবীর চারদিক অন্ধকারে ঢেকে যায়। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে নাশিকায় ভেসে আসে কোটি কোটি স্বপ্ন। আশা আর চাহিদা পুড়ে ছাই হওয়ার অদৃশ্য গন্ধ। কর্ণকুহরে পৌঁছে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আহত হওয়া জরাজীর্ণ জীবনের মৃতপ্রায় হাহাকার। তখন আমরা একে অন্যকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দেই। এটা একটি উত্তম উপদেশ। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা আছরে সফল মানুষদের চারটি গুণ উল্লেখ্য করেছেন। সেগুলোর মধ্যে চার নম্বরটি হলো-‘(সফল মানুষ তাঁরা, যাঁরা অন্যকে) ধৈর্যের উপদেশ দেয়’। (সুরা আছর, আয়াত-৩)

আমরা ধৈর্যের উপদেশ দিলেও, পরিচয়টা দেই না। কখন, কীভাবে, কতটুকু ধৈর্যধারণ করতে হবে তা আমরা বলি না। ধৈর্যধারণেরও নিয়মনীতি ও মহৎ মহৎ পুরস্কার আছে। এক্ষেত্রে সফল ও পুরস্কারপ্রাপ্ত ধৈর্যশীল হতে হলে আমাদেরকে ধৈর্য সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

ধৈর্যের পরিচিতি : ধৈর্যের আরবি হলো ‘সবর’। ‘সবর’-এর শাব্দিক অর্থ হলো বিরত রাখা বা আটকে রাখা। ব্যবহারিক দিক থেকে শব্দটি অবিচলতা, মনকে অস্থিরতা ও অতি উদ্বেগ থেকে বিরত রাখা। জিহ্বাকে অভিযোগপ্রবণতা থেকে সংযত রাখা এবং দুঃখ-ভারাক্রান্ত ও শোকাতুর সময়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কপাল ও বুক চাপড়ে বিলাপ করা থেকে রক্ষা করা। এসব অর্থেও ব্যবহূত হয়। পারিভাষিক অর্থে জুনাইদ ইবনে মুহাম্মদ (রহ.) বলেন, ‘ধৈর্য হলো, অম্লান বদনে কষ্ট সয়ে যাওয়া।’ আমর ইবনে উসমান আল-মক্কী (রহ.) বলেন, ‘ধৈর্য হচ্ছে আল্লাহর পথে অবিচল থাকা এবং তার পক্ষ থেকে আগত বিপদকে প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করা।’ কারো কারো মতে, ‘ধৈর্য হলো প্রবৃত্তি ও কামনার আহ্বানকে উপেক্ষা করে ধর্ম ও বিবেকের আহ্বানে সাড়া দেওয়া।’ (উদ্দাতুস সাবীরিন ওয়া যাখীরাতুশ শাকিরীন, ইবনুল কায়্যিম (রহ.)

ধৈর্যের প্রকারভেদ : বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে ধৈর্য তিন প্রকার। ০১. মহান আল্লাহর ইবাদত ও আদেশ-নিষেধ পালনের ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ। ০২. পাপকাজ ও অপরাধকর্ম থেকে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ। ০৩. আল্লাহর ফয়সালা ও ভাগ্যের লিখনে অসন্তুষ্ট না হওয়ার ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ।

বিধানগত দিক থেকে ধৈর্য পাঁচ প্রকার। প্রথম প্রকার : ওয়াজিব ধৈর্যধারণ। ওয়াজিব ধৈর্যধারণ তিন প্রকার। ক. পাপকাজ পরিত্যাগের ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ। খ. ওয়াজিব আদায়ের ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ। গ. যে সকল বিপদআপদ ও দুঃখদুর্দশার পেছনে মানুষের কোনো হাত নেই সেগুলোতে ধৈর্যধারণ। যেমন- রোগশোক, দুঃখ-দারিদ্র্য ইত্যাদি।

দ্বিতীয় প্রকার : মুস্তাহাব ধৈর্যধারণ। মুস্তাহাব ধৈর্যধারণ তিন প্রকার। ক. মাকরুহ কাজ থেকে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ। খ. মুস্তাহাব কাজে অটল থাকার ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ। গ. প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখার ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ।

তৃতীয় প্রকার : হারাম ধৈর্যধারণ। হারাম ধৈর্যধারণ দুইপ্রকার। ক. ক্ষুৎপিপাসায় মৃত্যুর আশংকা দেখা দিলে পানাহার বর্জনের ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ এবং ক্ষুধায় মৃতপ্রায় হওয়ার পরও মৃত, রক্ত বা শূকরের মাংস না খেয়ে ধৈর্যধারণ। উল্লেখ্য, উপরিউক্ত অবস্থায় ধৈর্যধারণ ও পানাহার বর্জনের কারণে যদি কারো মৃত্যু হয় তবে সে গুনাহগার হবে। কারণ, মহান আল্লাহ মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেন। সুতরাং নিরুপায় অবস্থায় এসব ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ সম্পূর্ণ হারাম ও নিষেধ। খ. হিংস্র পশু, সাপ, আগুন, পানি বা কাফেরের মাধ্যমে নিহত হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া। নির্বিকার বসে থাকাও সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নিষেধ। অবশ্য কেউ যদি ফিতনা ও মুসলমানদের পারস্পরিক যুদ্ধের সময় ধৈর্যধারণ করে এবং কোনো পক্ষ অবলম্বন থেকে বিরত থাকে তবে তা বৈধ। অধিকন্তু এটা শুধু বৈধই নয়, প্রশংসিতও বটে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘তুমি আদমের দুই সন্তানের মধ্যে উত্তম জনের মতো হও।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৩৯৬১) অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তুমি অন্যায়ভাবে নিহত বান্দা হও। হত্যাকারী বান্দা হয়ো না।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৩৫৭, তিরমিযি, হাদিস নং-২২০৪)

চতুর্থ প্রকার : মাকরুহ ধৈর্যধারণ। মাকরুহ ধৈর্যধারণ চারপ্রকার। ক. খাদ্যপানীয়, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং স্ত্রীর সঙ্গে সংসর্গের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পর্যায়ে ধৈর্যধারণ। অর্থাৎ, খাদ্য-পানীয় ও পোশাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে আপনার অতিরিক্ত কৃচ্ছ্রতা শারীরিক বা মানসিক কষ্ট ও ক্ষতির কারণ হলে তবে তা মাকরুহ। অনুরূপ স্ত্রীর সংসর্গ থেকে দূরে থাকলে যদি সেটা আপনার দৈহিক বা চারিত্রিক ক্ষতির কারণ হয় তবে সেটাও মাকরুহ। খ. নিজের ক্ষতির কারণ না থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীর প্রয়োজনের সময় যৌনমিলন থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে ধৈর্যধারণ মাকরুহ হবে। গ. মুস্তাহাব কাজ না করার মাধ্যমে ধৈর্যধারণ।  ঘ. মাকরুহ কাজ করার মাধ্যমে ধৈর্যধারণ।

পঞ্চম প্রকার : মুবাহ ধৈর্যধারণ। ইসলামে বাধ্যবাধকতা নেই এমন কাজে ধৈর্যধারণ করা হলো মুবাহ। অর্থাৎ,  ধৈর্য ও নিষ্ঠাসহকারে এধরনের কাজগুলো করতে থাকা।

ধৈর্যশীলদের মহৎ মহৎ পুরস্কার : ০১. অপরিমিত প্রতিদান। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় ধৈর্যশীলদের অপরিমিত প্রতিদান দেওয়া হবে।’ (সুরা যুমার, আয়াত-১০) ০২. মহান আল্লাহর সার্বক্ষণিক সঙ্গ ও সান্নিধ্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা ধৈর্যধারণ করো, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সুরা আনফাল, আয়াত- ৪৬) ০৩. তিনটি মহামূল্যবান পুরস্কার। ক. আল্লাহর দয়া। খ. আল্লাহর করুণা। গ. হিদায়াত। পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ প্রদান করুন; যাদেরকে কোনো বিপদ আক্রান্ত করলে তারা বলে, ‘আমরা তো আল্লাহর জন্যই, তাঁর কাছেই তো আমরা ফিরে যাবো। এদের ওপর এদের রবের পক্ষ থেকে বর্ষিত হয় দয়া ও করুণা। আর এরাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৫-১৫৭) ০৪. আল্লাহর অসীম ভালোবাসা। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত-৪৬) ০৫. জান্নাতপ্রাপ্তি ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা। ইরশাদ হয়েছে ‘(পার্থিবজীবনে) তাদের ধৈর্যধারণের বিনিময়ে আমি আজ তাদের এই প্রতিদান দিলাম যে, তারাই সফলকাম (জান্নাতি)।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত-১১১) ০৬. দুর্ব্যবহারকারী শত্রুকে অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত করে দেওয়া। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ভালো আর মন্দ সমান হয় না। (মন্দকে) ভালো দিয়ে প্রতিহত করুন, তাহলে যার সাথে আপনার শত্রুতা সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা ফুসসিলাত, আয়াত-৩৪)

০৭. ক্ষমা ও সৎকাজের মহৎপ্রতিদান। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তবে তারা ব্যতীত, যারা ধৈর্যধারণ ও ভালো কাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহৎপ্রতিদান।’ (সুরা হূদ, আয়াত-১১) ০৮. দ্বিগুণ পুরস্কার। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদেরকে দুবার প্রতিদান দেওয়া হবে; যেহেতু তারা ধৈর্যশীল।’ (সুরা কাসাস, আয়াত-৫৪) ০৯. জিহাদের কঠিন পরিস্থিতিতে ফিরিশতার সাহায্য সুনিশ্চিত। ইরশাদ হয়েছে, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়, যদি তোমরা ধৈর্যধারণ করো, তাকওয়া অবলম্বন করো এবং তারা দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করে, তবে আল্লাহ পাঁচ হাজার চিহ্নিত ফিরিশতা দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত-১২৫) ১০. শত্রুর ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়া হয়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যদি ধৈর্যশীল হও এবং মুত্তাকী হও তবে তাদের (শত্রুদের) ষড়যন্ত্র তোমাদের কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত- ১২০) সর্বোপরি,  ধৈর্যগুণে মানুষ মর্যাদা ও আভিজাত্যের শীর্ষচূড়ায় আরোহণ করে। ধৈর্যকেই পুঁজি করে চিরশান্তির জান্নাতের দিকে ধাবিত হয়। ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার ডানা মেলেই মানুষ জান্নাতের মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ায়। এই ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা মহান আল্লাহর অনুগ্রহ-বিশেষ। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকেই কেবল এই অনুগ্রহ দান করেন। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে সর্বাবস্থায় পরিপূর্ণ ধৈর্যশীল হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামিন।

 

লেখক : ইমাম ও খতিব, পশ্চিম নোয়াগাঁও জামে মসজিদ, বিশ্বনাথ, সিলেট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads