• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯
শবেবরাত করণীয়-বর্জনীয়

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

শবেবরাত করণীয়-বর্জনীয়

  • প্রকাশিত ২৯ মার্চ ২০২১

শবেবরাত অর্থ হলো মুক্তির রাত। মধ্য শাবানের এ রাতে মহান আল্লাহতায়ালা প্রথম আসমানে এসে গুনাহের কাজে লিপ্ত, অভাব-অনটনে আচ্ছন্ন; রোগ-শোকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মুক্তির আহ্বান করেন। তাই এ রাতকে ‘শবেবরাত’ বা ‘মুক্তির রজনী’ বলা হয়। মহান আল্লাহতায়ালা এ রাতে বান্দাদের ডেকে বলেন- যারা পাপ থেকে মুক্তি পেতে চাও, মুক্তি প্রার্থনা করো; আমি মুক্তি দেব। যারা রোগাক্রান্ত আছো, আমার কাছে সুস্থতা চাও; আমি সুস্থ করে দেব। যারা শোকগ্রস্ত আছো, মুক্তি চাও; আমি মুক্তি দেব। এভাবে আল্লাহতায়ালা সারা রাত মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে ডাকতে থাকেন। আল্লাহর এ ডাকে যারা সাড়া দিয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চায় বা কিছু প্রার্থনা করে, তিনি তাদের ক্ষমা করেন এবং দান করেন।

শবেবরাতে করণীয় সম্পর্কে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা শাবানের মধ্য তারিখ রাতে জাগ্রত থাকো এবং দিনে রোজা রাখো।’ অন্য হাদিসে রয়েছে, অর্থ : হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার গৃহে এসে গায়ের কাপড় খুলে না শুয়ে পুনরায় কাপড় পরিধান করে বেরিয়ে গেলেন। এতে আমার আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত লাগলো। আমি ভাবলাম, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হয়তো অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে নিশিযাপন করবেন। তাই আমি খুঁজতে বের হলাম। খুঁজে পেলাম মদিনার [জান্নাতুল বাকী] কবরস্থানে। গিয়ে দেখি তিনি আসমানের দিকে হাত উঠিয়ে মুমিন মুসলমান নর-নারী ও শহীদদের জন্য দোয়া করছেন। এটা ছিল বরাতের রাতের ঘটনা। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা এ রাতে প্রথম আসমানে এসে বান্দাদের ব্যাপকভাবে ক্ষমা করেন। যার পরিমাণ কালব নামক গোত্রের বকরির পশমের চেয়েও বেশি। (তিরমিযি শরিফ, হাদিস নং-৭৩৯)

শবেবরাতে আমরা কী আমল করব এ সম্পর্কে  কোরআন-হাদিস ও ফিকহের কিতাবাদিতে যে কয়টি আমলের কথা বর্ণিত হয়েছে তা হলো- এক. বেশি করে নফল ইবাদত করা। তবে এক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পদ্ধতি হাদিস শরিফে উল্লেখ নেই। তাই অন্যান্য নামাজের ন্যায়ই এ রাতের নামাজ পড়তে হবে। দুই. পরের দিন নফল রোজা রাখা। তিন. এ রাতে বেশি বেশি দোয়া করা। সমস্ত রোগ-শোক, অভাব-অনটন ও দরিদ্র থেকে মুক্তি চাওয়া। বিশেষ করে গুনাহ থেকে মুক্তি চাওয়া। চার. মৃত ব্যক্তিদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা। পাঁচ. জিয়ারতের জন্য কবরস্থানে যাওয়া। যেহেতু এ রাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতুল বাকীতে গিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে স্বদলবলে আড়ম্বরের সাথে যাওয়া নিষেধ। ছয়. এ রাত ইবাদতের রাত। তাই ফুকাহায়ে কেরাম এ রাতে গোসল করা মুস্তাহাব বলেছেন।

শবেবরাত একটি বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ রাত। এ রাতে যে কোনো নেক কাজ করলে যেমন অনেক সাওয়াব পাওয়া যায়, ঠিক তদ্রূপ এ রাতে গুনাহ করলেও তা বড় গুনাহ হয়ে দাঁড়াবে। তাই বিশেষ করে এ রাতে সবরকম গুনাহ থেকে মুক্ত থাকতে হবে এবং বেশি করে আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফের দোয়া করতে হবে। কেননা সব চাওয়ার মাঝে গুনাহ থেকে মুক্তিই হলো বড় চাওয়া। আর তা থেকে মুক্তি পাওয়াই হলো বড় পাওয়া। গুনাহ থেকে মুক্তি পেতে হলে আল্লাহর নিকট খাঁটিভাবে তাওবা করতে হবে।

শবেবরাতের বিশেষ একটি আমল হচ্ছে, মুরদাদের জন্য ঈসালে সাওয়াব। ঈসালে সাওয়াব অর্থ হচ্ছে ‘সাওয়াব পৌঁছে দেওয়া’। যারা দুনিয়া থেকে চলে যান তাদের কাছে আমরা বিভিন্নভাবে সাওয়াব পৌঁছাতে পারি। এর কয়েকটি পদ্ধতি হলো- এক. তাদের জন্য বেশি করে দোয়া করা। দুই. যে কোনো ইবাদত করে তাদের উদ্দেশে সাওয়াব পৌঁছে দেওয়া। তিন. কোরআন তিলাওয়াত করা। চার. জিকির-আজকার করা। পাঁচ. দান-সদকা করা। এছাড়াও যে কোনোভাবে নফল ইবাদত করে এর সাওয়াব তাদের কাছে পৌঁছাতে পারি। এ রাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিন নর-নারী এবং শহীদদের জন্য দোয়া করেছেন, এটা ঈসালে সাওয়াবের অন্তর্ভুক্ত। তাই আমরাও এ রাতে মুরদাদের জন্য যে কোনোভাবে শরয়ী পন্থায় ঈসালে সাওয়াব করতে পারি।

মুসলিম সমাজে শবেবরাতের এ মহান রাতে বিভিন্ন কুসংস্কার-কুসংস্কৃতি ও রসম-রেওয়াজ প্রচলিত হয়ে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে।  কোরআন-হাদিসে এর নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণাদি না থাকলেও কিছু লোক স্বীয় মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে শরীয়ত পরিপন্থি কাজগুলো করেই যাচ্ছে। এরকম কাজগুলোকে তারা উক্ত রাতের বিশেষ আমল হিসেবেও মনে করে। এ রাতের কুসংস্কারসমূহের অন্যতম হলো, হালুয়া-রুটি প্রচলন। শরীয়তে যার কোনো ভিত্তি নেই। নিঃসন্দেহে এটি একটি শরীয়ত গর্হিত কাজ। এ থেকে অবশ্যই সবাইকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়াও এ রাতকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে যেসব কুপ্রথা চালু রয়েছে। তা হলো- এক. পটকা ফুটানো। দুই. মোমবাতি জ্বালানো। তিন. কবরে ফুল বা মালা দেওয়া। চার. মসজিদে বিস্কুট, মিষ্টি-জিলাপি ইত্যাদি নিয়ে হৈ-চৈ, ঝগড়াঝাটি করা। পাঁচ. ছোট বাচ্চাদের আগরবাতি ও মোমবাতি নিয়ে খেলা করা। ছয়. দৌড়াদৌড়ি করা ইত্যাদি। এসব প্রথাও শরীয়তবিরোধী। তাই শরীয়তবিরোধী সব কাজ থেকে নিজে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকেও বিরত রাখতে হবে।

অতএব, আমরা যারা ক্ষমা চাই, মুক্তি চাই জাহান্নাম থেকে, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে এ রাতের গুরুত্ব দিতে চাই; তারা যেন কোনোক্রমেই শরীয়ত গর্হিত এসব কাজে অংশগ্রহণ না করি; বরং পূর্বোল্লিখিত ছয়টি আমলের মাধ্যমে সারা রাত অতিবাহিত করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শরীয়তসম্মত কাজ করার ও শরীয়তবিরোধী রসমগুলো থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন!

লেখক : মুফতি উবায়দুল হক খান

মুহাদ্দিস ও সহকারী শিক্ষাসচিব

জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া, গাজীপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads