• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

ইসলামে সন্ত্রাসবাদের প্রশ্রয় নেই

  • প্রকাশিত ৩১ মার্চ ২০২১

সন্ত্রাস আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রথিত। সন্ত্রাসবাদ আজ এতোই ব্যাপক হয়ে গেছে যে, তারাই যেনো আজ সমাজের দিক নির্দেশক। মায়ের গর্ভ থেকে কেউ সন্ত্রাসী হয়ে জন্মায় না। একজন মানুষকে সন্ত্রাসী হতে সহায়তা করে অগ্রজ সন্ত্রাসের দল। আর এর পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে সমাজে বাস করা কিছু ভদ্র মানুষ। বিপথগামী মানুষ যখন ধীরে ধীরে সামাজিক নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন থেকেই তাকে বাধা দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কে দেবে বাধা? সবাই মনে করে, আমার সঙ্গে তো হয়নি কিছু। কারো আবার ইচ্ছে থাকলেও সম্মান হারানো বা ঝামেলা এড়ানোর জন্য খোলা চোখেও অন্ধ সেজে থাকে। আর এভাবেই দিন দিন সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়ে চলছে এবং একজন ছোট সন্ত্রাসীও গড ফাদারে পরিণত হতে থাকে। একটি সমাজে টাউট, বাটপার, সন্ত্রাসী ও গড ফাদারদের চাইতে অনেক অনেক বেশি ভালো মানুষের সংখ্যা। কিন্তু এরপরেও সন্ত্রাসীরা দাপিয়ে বেড়ায়। শুধু তাই নয়, একেবারে আইন, বিচার, সালিশ ও প্রশাসন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে থাকে তাদের পদচারণা। অতিষ্ঠ করে তোলে জনজীবন। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন পর্যন্ত কোণঠাসা হয়ে পড়ে তাদের অপতৎপরতায়। এসব একদিন দুদিনে হয় না। দিনের পর দিন ভদ্রলোকদের নীরবতাই এর জন্য দায়ী।

মানুষকে বলা হয় সামাজিক জীব। সৃষ্টিগতভাবে সামাজিকতার উপাদান মানুষের মধ্যে রয়েছে। সব বিষয়ে কাউকে নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পদে পদে মানুষকে পরনির্ভর ও পরমুখাপেক্ষী হতে হয়। তারপরও মানুষ সামাজিকতার উপাদানগুলো উপেক্ষা করে অসামাজিক হয়ে ওঠে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, আদর্শিক লড়াইয়ে, পার্থিব দুনিয়ার মোহগ্রস্ত হয়ে মানুষ সংঘাতে লিপ্ত হয়। সহিংসতা ও সন্ত্রাস করে রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে। অথচ মানুষ হত্যা, সন্ত্রাস ও ত্রাস সৃষ্টি যে কোনো ধর্ম, মতাদর্শ ও সভ্যতাবিরোধী। খুনাখুনি ও রক্তপাত কেউ পছন্দ করে না। প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। তাদের ধর্ম সন্ত্রাস। সারা বিশ্বেই খুন-খারাবি হচ্ছে। ইসলাম গ্রহণের কারণে নয়, পূর্ণ ইসলাম না থাকার কারণেই মানুষ সন্ত্রাসী হয়। মুসলমান সন্ত্রাসী হওয়ার পথে কোরআনই সবচেয়ে বড় বাধা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৯৩)

ইসলাম ধর্ম মতে, কোনো মুসলমান হাজারো অপরাধ করলেও তার সমুদয় পাপের সাজা ভোগ করে সে জান্নাতে যাবে। কোনো মুসলিম অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে না। অথচ এ আয়াতে হত্যাজনিত অপরাধের কারণে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, একটি অন্যায় হত্যাকে ইসলাম বিশ্বমানবতাকে হত্যার সমতুল্য বলে ঘোষণা করেছে। কোরআন বলছে, ‘নরহত্যা কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করা ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-৩২) কোথাও কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেখলে অন্যদের উচিত নির্যাতিত ব্যক্তির সাহায্যে এগিয়ে আসা। আল্লাহ বলেন, ‘আর যে কারো প্রাণ রক্ষা করল, সে যেন (বিশ্বের) সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-৩২) এ ছাড়া বহু আয়াতে হত্যার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা একে অন্যের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না...এবং একে অন্যকে হত্যা কোরো না।’ (সুরা নিসা, আয়াত-২৯)

ইসলাম অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকেও হত্যায় উৎসাহিত করে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(রহমানের বান্দা তারাই) যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্যর ইবাদত করে না, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে না।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত-৬৮) হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর মতে, এ আয়াতটি অমুসলিমদের হত্যার ব্যাপারে নাজিল হয়েছে। কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে পরকালের শাস্তির পাশাপাশি পার্থিব জীবনেও তার জন্য মৃত্যুদণ্ড (কিসাস) কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এভাবেই ইসলাম হত্যা, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদীদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইসলাম কখনোই হত্যা, নৈরাজ্য সৃষ্টি, সহিংসতা ও সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয় না। পৃথিবীতে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে নিষেধ করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে পছন্দ করে না।’ (সুরা কাসাস, আয়াত- ৭৭) অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ফিতনা (দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধ) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর।’ (সুরা বাকারা, আয়াত- ১৯১)

অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করাকে ইসলাম বিশ্বমানবতার মৃত্যুতুল্য গণ্য করেছে। আর মুসলমানদের পারস্পরিক রক্তপাতের বিরুদ্ধে হাদিস শরিফে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া গোনাহর কাজ আর তাকে হত্যা করা কুফরি।’ (বুখারি, হাদিস নং-৬০৪৪) বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, একদল মুসলিম অন্য দলের ওপর অস্ত্রাঘাত করছে। অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের (মুসলমানদের) ওপর অস্ত্র উঠাবে, সে আমাদের (ধর্মের) দলভুক্ত না।’ (বুখারি : ৬৮৪৪) অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে গোটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনো মুসলমানের হত্যার চেয়েও অধিক সহনীয়।’ (নাসায়ি, হাদিস নং-৩৯৯২) কেউ অন্যায়ভাবে  হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হলে ইসলাম তার জন্য মৃত্যুদণ্ড বা কসাস আইন প্রবর্তন করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান দেওয়া হলো।’ (সুরা বাকারা, আয়াতঃ ১৭৮)

সন্ত্রাস দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি হলো, তাদের হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে কিংবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত-পা কেটে ফেলা হবে কিংবা তাদের দেশান্তরিত করা (বন্দি) করা হবে।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত- ৩৩) কোরআনের এসব বাণী বুকে ধারণ করেই সাহাবায়ে কেরাম রাষ্ট্রীয় সংকট নিরসন করেছেন। হজরত উমর (রা.) মজলিসে শুরায়ে আম ও খাস নামে পৃথক দুটি পরামর্শ পরিষদ গঠন করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের সমাধান করতেন। হজরত ওসমান (রা.) বারবার বিরোধীপক্ষের সঙ্গে সংলাপে বসেন। তবুও তিনি দমন-পীড়ননীতি অনুসরণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করেননি। একপর্যায়ে তাঁকেই জীবন দিতে হয়েছে। তবুও তিনি সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করেননি। হজরত আলী (রা.) ও হজরত মুয়াবিয়া (রা.) এর মধ্যকার ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তিও ঘটে পরস্পর সন্ধি স্থাপনের মাধ্যমে। দুই পক্ষের সামান্য উদারতা বহু মানুষের জান-মাল ও জীবন-জীবিকা রক্ষা করতে পারে।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান খুবই পরিষ্কার। এখানে ভুল বুঝার কোনো সুযোগ নেই এবং কোনো ব্যাখ্যা বা ছুতা ধারে সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেওয়া বা বৈধ জ্ঞান করার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশসহ গোটা পৃথিবীতে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ এখন আতঙ্কের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। ব্যক্তিগত সন্ত্রাস, গোষ্ঠীগত সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, এক কথায় প্রতিটি সেক্টরকেই সন্ত্রাসবাদ গ্রাস করে নিচ্ছে। যারা প্রতিনিয়ত উগ্র সন্ত্রাসী কাজ করছে, তারা সমাজের প্রচণ্ড ক্ষতি করছে। তাদের এহেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সমাজের শান্তি আজ হুমকির সম্মুখীন। প্রকৃতপক্ষে এরা জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনছে। যারা ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়, তারা মুসলিম জাতিকে কলঙ্কিত করার লক্ষ্যে বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। তাই ইসলামের সাথে তাদের দূরতম সর্ম্পকও নেই। তাদের ব্যাপারে অবশ্যই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সমাজ থেকে সন্ত্রাস চিরতরে দূরীকরণে সকলে মিলে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। সব কিছুর মূলেই হলো ঐক্যবদ্ধতা। সন্ত্রাস নির্মূলে চাই ভুক্তভোগীর ঐকান্তিক ইচ্ছা ও দৃঢ় মনোবল। মনে রাখতে হবে সন্ত্রাসীদের চাইতে নিরীহ মানুষের সংখ্যই বেশি। আর নিরীহ জনতা যখন ঐক্যবদ্ধ হয় তখন যত বড় সন্ত্রাসীই হোক সে লেজ গুটাতে বাধ্য।

লেখক : মোস্তফা কামাল গাজী

প্রাবন্ধিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads