তারেক সাঈদ
ইসলামের উত্থানের সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে এবং সভ্যতার গতিধারায় এক বিস্ময়কর পরিবর্তন সূচিত হয়। ইউরোপ যখন অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার ও স্বৈরাচারের গভীর ঘুমে অচেতন তখন এশিয়া আফ্রিকায় ইসলামের আলোকধারা জ্ঞান ও সভ্যতামণ্ডিত নতুন এক বিশ্বের জন্ম দেয়। যুগ যুগ ধরে গবেষণা ও সৃষ্টিশীল কাজে তাঁদের একাগ্রতা প্রমাণিত। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা সভ্যতার বিকাশকে করেছে আরো গতিশীল। গণিত, রসায়ন, পদার্থ, জীববিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস সর্বত্রে ছিল তাঁদের অগ্রণী পদচারণা। বহু মুসলিম বিজ্ঞানী দিগন্ত উন্মোচনকারী আবিষ্কার করে গোটা বিশ্বের চেহারাই বদলে দিয়েছেন। সেসব আবিষ্কার ও গবেষণার আধুনিকীকরণ ঘটেছে, তার সুফল ভোগ করছে আজকের বিশ্ববাসী। দুনিয়া কাঁপানো মুসলিম আবিষ্কারকদের মধ্যে গণিতশাস্ত্রে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন।
আল খাওয়ারিজমি : তাঁর পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি। সোভিয়েত রাশিয়ার আরব সাগরে পতিত আমু দরিয়ার কাছে একটি দ্বীপে আনুমানিক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন জগদ্বিখ্যাত গণিতবিদ। তাঁর সময়ের গণিতের জ্ঞানকে তিনি এক অভাবনীয় সমৃদ্ধতর পর্যায়ে নিয়ে যান। গণিতবিদ হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য জ্যোতির্বিদ। ভূগোল বিষয়ে তাঁর প্রজ্ঞা উৎকর্ষতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন বীজগণিত তথা অ্যালজেবরার জনক। তাঁর রচিত বই ‘কিতাব আল জিবার ওয়াল মুকাবিলা’ থেকে বীজগণিতের ইংরেজি নাম অ্যালজেবরা উৎপত্তি লাভ করে। তিনি বিজ্ঞানবিষয়ক বহু গ্রিক ও ভারতীয় গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেন। পাটিগণিত বিষয়ে তিনি একটি বই রচনা করেন, যা পরে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। তাঁর হাতেই বীজগণিত পরবর্তী সময়ে আরো সমৃদ্ধতর হয়। বর্তমান যুগ পর্যন্ত গণিতবিদ্যায় যে উন্নয়ন এবং এর সহায়তায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে উন্নতি ও আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে তার মূলে রয়েছে আল খাওয়ারিজমির উদ্ভাবিত গণিতবিষয়ক নীতিমালারই বেশি অবদান।
জ্যোতিষশাস্ত্র বিষয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থটি তিনি আরবিতে অনুবাদ করেন। তিনি এবং তাঁর কয়েকজন ভূতত্ত্ববিদ সাথী মিলে ‘সূরত আল আরদ’ বা বিশ্বের একটি বাস্তবরূপ প্রস্তুত করেছিলেন। এটাই পরবর্তীকালে বিশ্বের মানচিত্র অঙ্কনের মডেল হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। ভূগোলবিদগণ পৃথিবীকে যে সাতটি মহাদেশে বিভক্ত করেছেন তা তাঁর রচিত বই ‘সপ্ত ইকলীমের’ ভিত্তিতেই বিশ্বের মানচিত্র অঙ্কন, বিশ্বের পরিধি, অক্ষরেখা, দ্রাঘিমা এবং জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁর গবেষণালব্ধ জ্ঞানই পরবর্তীতে এ বিষয়ে পথিকৃতের কাজ করে।
আল-বিরুনি : আল-খাওয়ারিজমির পরে দ্বিতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম গণিতবিদ হলেন আল-বিরুনি। গণিতে তার শ্রেষ্ঠতম অবদান ‘আল-কানুন আল-মাসউদী। এটিকে গণিতশান্ত্রে বিশ্বকোষ বলা হয়। আল-বিরুনি তার এ গ্রন্থটিতে জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, ক্যালকুলাস প্রভৃতি বিষয়ের সূক্ষ্ম, জটিল ও গাণিতিক সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি পরিমাপ পদ্ধতির ওপর কাজ করেন। আর পৃথিবীর পরিমাপ সম্পর্কে অদ্যাবধি স্বীকৃত এবং বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত একটি পরিমাণ উপস্থাপন করেন।
ওমর খৈয়াম : ইতিহাসবিদের মতে সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর কিছু আগে ওমর খৈয়াম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ওমর খৈয়ামের শৈশবের কিছু সময় কেটেছে আফগানিস্তানের বালক শহরে। সেখানে তিনি খোরাসানের অন্যতম সেরা শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত ইমাম মোয়াফ্ফেক নিশাপুরির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দিনের বেলায় জ্যামিতি ও বীজগণিত পড়ানো, সন্ধ্যায় মালিক-শাহ-এর দরবারে পরামর্শ প্রদান এবং রাতে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চ্চার পাশাপাশি জালালি বর্ষপঞ্জি সংশোধন সবটাতে তার নিষ্ঠার কোনো কমতি ছিল না। জীবদ্দশায় ওমরের খ্যাতি ছিল গণিতবিদ হিসাবে। তিনি প্রথম উপবৃত্ত ও বৃত্তের ছেদকের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করেন। ওমরের আর একটি বড় অবদান হলো ইউক্লিডের সমান্তরাল স্বীকার্যের সমালোচনা যা পরবর্তী সময়ে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সূচনা করে। ১০৭০ খ্রিস্টাব্দে তার পুস্তক ‘মাকালাত ফি আল জার্ব আল মুকাবিলা’ প্রকাশিত হয়। এই পুস্তকে তিনি ঘাত হিসাবে সমীকরণের শ্রেণিকরণ করেন এবং দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধানের নিয়মাবলি লিপিবদ্ধ করেন। ওমর খৈয়াম জ্যোতির্বিদ হিসেবেও সমধিক পরিচিত ছিলেন।
আল বাত্তানী : আব্দুল্লাহ আল-বাত্তানী খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতকের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ। গণিতশাস্ত্রের ক্রমন্নোতিতে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। ত্রিকোণমিতির অনুপাত প্রকাশ আল-বাত্তানীর প্রধান কীর্তি। গণিতশাস্ত্র ইতিহাসে ত্রিকোণমিতিকে আল বাত্তানিই সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গভাবে প্রথম তুলে ধরেন। ত্রিকোণমিতির Sine, Cosine, Tangent, Cotangent ইত্যাদি সাংকেতিক নিয়মের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার তিনিই প্রথম করেন। এসব সংকেতের মধ্যে বিভিন্ন সম্পর্ক তিনি আবিষ্কার করেন। কোনো কোণের সাইন জানা থাকলে তার ট্যানজেন্ট বের করা এবং ট্যানজেন্ট জানা থাকলে তার সাইন বের করার নিয়ম তিনিই উদ্ভাবন করেন।
এছাড়াও নাসির ইদ্দিন তুসী, আবুল কাশেম আহমদ, আবু জাফর মুহাম্মাদ, হাসান ইবনে মুসা বিন শাকির প্রমুখ অসংখ্য মুসলিমদের অবদান সমৃদ্ধ করেছে আজকের আধুনিক গণিতশাস্ত্র। আর আধুনিক গণিতশাস্ত্রের বিকাশ সাধন ঘটায় আমরা তাদের কাছে চিরঋণী-এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে।
লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক