• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
রমজানে করণীয় ও বর্জনীয়

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

রমজানে করণীয় ও বর্জনীয়

  • প্রকাশিত ২০ এপ্রিল ২০২১

মুমিন মুসলমান প্রত্যেকের ওপর রমজানের রোজা ফরজ। কোরআন-হাদিসের সাথে সাথে ইজমা তথা উম্মতের সর্বসম্মত মত এবং কিয়াস তথা যুক্তির দ্বারাও রোজা ফরজ হওয়াটা প্রমাণিত। অতএব, যদি কোনো ব্যক্তি রোজা ফরজ হওয়াকে অস্বীকার করে তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। (বাদায়েউসসানায়ে : ২য় খণ্ড, পৃ-২০৯-২০১) রোজার আরবি শব্দ হলো সাওম, যার আভিধানিক অর্থ হলো বিরত থাকা। আর রোজার নিয়তে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার এবং যৌনাচার থেকে বিরত থাকাকে শরিয়তের পরিভাষায় রোজা বলা হয়। (আদ্দুররুল মুখতার : ৩য় খণ্ড, পৃ.-৩৩০)

রোজা ফরজ হওয়ার শর্ত : কোনো ব্যক্তির ওপর রোজা ‘ফরজ’ হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে-

১. মুসলমান হওয়া, সুতরাং কাফেরের ওপর রোজা ফরজ নয়।

২. বিবেকবান হওয়া, সুতরাং পাগলের ওপর রোজা ফরজ নয়।

৩. সাবালেগ হওয়া, সুতরাং নাবালেগের ওপর রোজা ফরজ নয়। (আলমগীরী : ১ম খণ্ড, পৃ.-১৯৫)

নিজ কু-প্রবৃত্তিকে দমন ও আত্মশুদ্ধির সর্বোত্তম মাস হলো রমজান। প্রথমত সিয়াম সাধনায় আল্লাহর নির্দেশ পালন করা হয়। দ্বিতীয়, রোজা দ্বারা সংযমী হওয়া যায়। তৃতীয়, রোজা দ্বারা অতীতের গুনাহগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। পারতপক্ষে আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের সর্বোত্তম পন্থা হলো সিয়াম সাধনা। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৩) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই তার প্রতিদান দেবো।’ (বুখারি শরিফ) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানি চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পরকালীন প্রতিদান কামনায় রমজানের রোজা রাখবে তার অতীত জীবনের সব পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (বুখারি শরিফ)

সিয়াম সাধানার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি হালাল খাদ্য ও পানীয়কে আল্লাহর নির্দেশের কারণে বর্জন করে প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে। সেই সাথে তারাবিহ, তাহাজ্জুদ, দান-সাদকাহ, কোরআন তিলাওয়াতসহ অন্যান্য ইবাদত করার মাধ্যমে তার আত্মার পরিশুদ্ধতা অর্জিত হয়। পবিত্র রমজান মাসে হাদিসে উল্লিখিত কতিপয় আমল দ্বারা আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারি।

করণীয় :

১. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত লাভের উদ্দেশ্যে সিয়াম সাধনা করা। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। অপর বর্ণনায় রয়েছে, বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। অপর বর্ণনায় আছে, রহমতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। (বুখারি ও মুসলিম) রমজান মাসে যেহেতু বেহেশতের ও রহমতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। সেহেতু রোজা রেখে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর রহমতের আশা করব।

২. মুখ ও জিহ্বাকে সংযত রাখা। পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি নিজের মুখ ও জিহ্বাকে সংযত রাখতে হবে। মিথ্যা, অশ্লীল কথাবার্তা, গালিগালাজ, গিবত, পরনিন্দা, অভিশাপ দেওয়া ও চোগলখোরিসহ অন্যান্য অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু

আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কর্ম পরিত্যাগ করেনি, তার পানাহার ছেড়ে দেওয়াতে আল্লাহর কোনো কাজ নেয়।’ (মিশকাত : ১০৮৯, বুখারি)

৩. নিয়মিত তারাবিহ-এর নামাজ আদায় করা। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসের নামাজ কায়েম করার জন্য উৎসাহ দান করতেন। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে খুব তাকিদ করতেন না; বরং এরূপ বলতেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে নামাজ কায়েম করবে তার পূর্ববর্তী (সগিরা) গুনাহগুলো ক্ষমা করা হবে। (সহিহ মুসলিম)

৪. কোরআন তিলাওয়াত করা। নফল ইবাদতের মধ্যে সর্বোত্তম ইবাদত হলো  কোরআন তিলাওয়াত করা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের সবচেয়ে উত্তম ইবাদ কোরআন তিলাওয়াত করা। (বায়হাকি, শুআবুল ঈমান : ১৮৬৯)

অন্য হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি রমজান মাসে আল্লাহর নৈকট্যলাভের উদ্দেশ্যে একটি নফল কাজ করবে সে ওই ব্যক্তির সমান হলো যে, অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল। (মিশকাত :১৮৬৮)

৫. নিজে ইফতার করার পাশাপাশি অন্য রোজাদারদের ইফতার করানো। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করালো তাকে রোজাদারের অনুরূপ সওয়াব দান করা হবে। কিন্তু রোজাদারের সওয়াবের কোনো কমতি হবে না। (তিরমিজি, হাদিস নং- ৮০৭)

৬. ইফতারের পূর্বে ও ইফতারের সময় দোয়া করা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন

ইফতার করতেন নিম্নের দোয়াটি পড়তেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার জন্য রোজা রেখেছি

এবং তোমার রিজিক দিয়ে ইফতার করছি।

তুমি আমার এই রোজাকে কবুল কর। নিশ্চয় তুমি সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রোতা। (তাবারানী, হাদিস নং-৮৪৫)

৭. খেজুর অথবা পানি দিয়ে ইফতার করা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে, কেননা এতে বরকত রয়েছে। যদি খেজুর না পায়, তবে যেন পানি দ্বারা ইফতার করে, এটি পবিত্রকারী। (আহমদ, তিরমিজি, আবু দাউদ) ৮. সেহরি খেয়ে রোজা রাখা :  সেহেরি খাওয়া সুন্নত। সেহেরি খেয়ে রোজা রাখার মধ্যে বরকত নিহিত রয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা সেহেরি খাবে। কেননা, সেহেরিতে বরকত রয়েছে। (বুখারি, মুসলিম)

৯. মসজিদে এতেকাফ করা : রমজানের শেষের ১০ দিনে এতেকাফ করা সুন্নত। পুরুষরা মসজিদে এবং স্ত্রী লোকেরা আপন ঘরে একটি স্থান ঘিরে নিয়ে তথায় এতেকাফ করবে। হাদিসে এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন, যাবৎ না আল্লাহ তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁর পর তাঁর স্ত্রীগণও এতেকাফ করেছেন। (বুখারি ও মুসলিম)

১০. বেশি করে আল্লাহর জিকির ও তাসবিহ-তাহলিল করা। রমজান মাসে বেশি করে তাসবিহ পাঠ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, আর যারা কোনো অশ্লীল কাজ করে অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ

ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে

শুনে তা তারা বারবার করে না। (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত-১৩৫)

১১. রমজান মাসে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করা। রমজান মাসের শেষের ১০ দিনের বেজোড় রাত্রিতে লাইলাতুল কদরের জন্য বেশি করে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে এবং সারা বিশ্ববাসীর শান্তি, ক্ষমা ও স্থিতিশীলতার জন্য দোয়া করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, লাইলাতুল কদর এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। (সূরা কদর, আয়াত-৩) 

১২. রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা : রমজান মাসে এমন কিছু করা যাবে না যা শরিয়ত পরিপন্থি। যেমন রোজাদারহীন ব্যক্তি রোজাদারদের সামনে পানাহার করা। সেই সাথে অশ্লীল ও অনৈতিক কার্যাবলি থেকে বিরত থাকতে হবে।

বর্জনীয় কাজ : রোজা অবস্থায় করণীয় যেমন অনেক রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে বর্জনীয়ও অনেক কাজ রয়েছে। যেমন: ১. মিথ্যা কথা ও অসৎ কাজ করা : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা এবং অসৎ আমল বর্জন করে না, আল্লাহর নিকট তার ক্ষুধা ও পিপাসার কোনো মূল্য নেই। (বুখারি শরিফ) ২. জবানের হেফাজত : রোজা অবস্থায় বেফায়দা অনর্থক কোনো কথা বলা যাবে না। অন্যকে গাল-মন্দ করা যাবে না। অশ্লীল কথা বর্জন করতে হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘রোজা হলো (জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষার) ঢালস্বরূপ। সুতরাং যদি কেউ রোজাদার হয় তাহলে তার উচিত অশ্লীল কথা বা নির্লজ্জ কথা না বলা। গুনাহে লিপ্ত না হওয়া। কেউ যদি তোমাকে গালি দেয় তাহলে তাকে বলে দেবে ভাই আমি রোজাদার। সুতরাং রমজান মাসের সম্মানার্থে বিশেষ করে টেলিভিশন বন্ধ রাখা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আবশ্যক।’ (বুখারি মুসলিম)

৩. পুরো শরীরে রোজা রাখা : রোজা অবস্থায় হাত, পা, কানসহ পুরো শরীরও যাতে রোজা রাখে এমন কাজ করতে হবে। অর্থাৎ এমন যাতে না হয় যে, রোজা রাখা ও না রাখা দুটাই বরাবর। প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রত্যেঙ্গকে গুনাহ থেকে হেফাজত রাখতে হবে। টেলিভিশন দেখা, নাটক শুনা, গল্পের ও উপন্যাসের বই পড়া ইত্যাকার কাজ বর্জন করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে না এবং তা থেকে যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে। (সুরা আন-আম : ১৫১) অতএব, আমরা যেন এই রমজানে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত ও সৎকর্মের মাধ্যমে রমজানের পরিপূর্ণ ফজিলত লাভ করতে পারি। আর মহান আল্লাহ তায়ালা যেন এই রমজান মাসে আমাদের ওপর রহমত, রবকত ও মাগফিরাত দান করুন। আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে নাজাত প্রদান করুন। আমিন।  

লেখক : মো. হুসাইন আহমদ

ফারেগ, দারুস-সুন্নাহ মাদরাসা, টাংগাইল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads