• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯
ইসলামে জুলুম ও জালেমের শাস্তি

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

ইসলামে জুলুম ও জালেমের শাস্তি

  • প্রকাশিত ২৪ এপ্রিল ২০২১

এই পৃথিবীতে যার যা প্রাপ্য বা অধিকার তাকে সেই প্রাপ্য বা হক থেকে বঞ্চিত করার নামই জুলুম। ইনসাফবিরোধী কাজ করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, কারো অধিকার হরণ করা, বিনা অপরাধে মানুষের ওপর হামলা করা, নির্যাতন চালানো, কাউকে শারীরিক, আর্থিক, মানসিক ও মান-সম্মানের ক্ষতিসাধন করা, কারো ওপর নৃশংসতা চালানো, অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ দখল করা, অশ্লীল ভাষায় কাউকে গালি দেওয়া, কাউকে যন্ত্রণা দেওয়া সবই জুলুমের পর্যায়ভুক্ত। এভাবে অন্যায়, অবিচার করে যারা মানুষের হক নষ্ট করে তারা জালেম।

ইসলাম শুধুমাত্র আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব কোনো ধর্ম নয়। ইসলাম জীবন পরিচালনার একটা সিস্টেম। এটা একটা পরিপূর্ণ জীবনবিধান। অন্তত কয়েক শতক ধরে ইসলাম যে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি তা নিয়ে সারা দুনিয়ায় অহরহ আলোকপাত করা হচ্ছে। কিন্তু অশিতি, কুশিতি, ইসলাম বিদ্বেষী, ধর্মব্যবসায়ী, স্বার্থান্বেষী মুসলমানের কর্ণকুহরে তা যেন কিছুতেই প্রবেশ করছে না! অতএব, যা হবার তাই হচ্ছে। পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদিতে আজ একচেটিয়া আধিপত্য মুসলিম বিদ্বেষীদের। ইহুদি-নাসারাদের। জ্ঞান-বিজ্ঞান আজ ইহুদি-নাসারা ও মুসলিমবিদ্বেষীদের হাতে। সমগ্র সমাজ পরিচালনা করছে আজ তথাকথিত প্রগতিবাদীরা! সাম্রাজ্যবাদ, সমাজবাদ, সেক্যুলারবাদ, পুঁজিবাদ আজ মুসলমানদের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে টেনে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে।

ইসলামে সব রকমের অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন অত্যন্ত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন করা নয়, বরং এসব অন্যায় কাজে সহযোগিতা করাও ইসলামে হারাম করা হয়েছে। তাছাড়া জালিমদের সাথে সম্পর্ক রাখাও ইসলামে হারাম করা হয়েছে। মানুষের ওপর অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন এমনই এক মারাত্মক অপরাধ। যার কারণে দুনিয়ার জীবনেই এর শাস্তি কোনো না কোনোভাবে মানুষ পেয়ে যায়। শুধু মানুষ নয়, পশুপাখি ও প্রাণীর ওপরও জুলুম করা হারাম। জুলুম একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ।

এই অপরাধের কারণে পরকালে অবশ্যই জাহান্নামে যেতে হবে। আমি এখানে জুলুম, জুলুমের পরিণাম, জুলুম থেকে বাঁচার উপায় ও কারো প্রতি জুলুম করে থাকলে দুনিয়াতে করণীয় কী সে সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করব।

আমরা অনেকে পরহেজগার হিসেবে সমাজে বেশ পরিচিত হলেও অন্যের ওপর জুলুম-নির্যাতন করার ক্ষেত্রে অজ্ঞ জালেমের চেয়ে কোনো দিক থেকে কম নই। বিশেষ করে দুর্বল মানুষের ওপর। প্রকৃত ধার্মিকদের ওপর। অসহায়দের ওপর জুলুম করাকে আমরা অনেকে অন্যায় মনে করি না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জালেমরা জুলুম করে কৌতুক ও আনন্দ অনুভব করে। মনে রাখা জরুরি যে, জুলুম এমন এক মহাপাপ; যা সাধারণত আল্লাহ কখনো ক্ষমা করেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত যার ওপর জুলুম করা হয়েছে সে যদি জালেমকে ক্ষমা না করে। প্রকৃত ধার্মিকদের আরো মনে রাখতে হবে যে, শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের নাম ধর্ম নয়। সব ভালো কাজ পালন করা এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার নাম হচ্ছে ধর্ম। সাথে সাথে ভালো কাজের জন্য উপদেশ দেওয়া আর অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখাও ধর্ম। এর অর্থ হচ্ছে কোরআন ও হাদিসের ভালো কাজের আদেশগুলো শুধু মেনে নিলে বা মেনে চললেই ধর্ম পালন করা হবে না; বরং এর পাশাপাশি কোরআন ও হাদিসের নিষেধগুলোও বর্জন করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘কিছু লোক এমন আছে যারা বলে আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি।

আসলে তারা ঈমানদার নয়। তারা আল্লাহকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দেয় এবং আসলে তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না। কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-৮,৯)

মহান আল্লাহর এ ঘোষণা সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। কীভাবে একজন মানুষ আল্লাহর বান্দা হিসেবে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত প্রদান করে আবার সেই একই মানুষ অহরহ অন্যের হক নষ্ট করে। অন্য মানুষের অত্যাচার জুলুম নির্যাতন চালায়। মানুষ নিজেই আল্লাহর সৃষ্টি হয়ে আল্লাহর অন্য সৃষ্টির ওপর জুলুম করবে এ অধিকার আল্লাহ মানুষকে দেননি। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে জুলুম সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘জালেমদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আল্লাহকে কখনো উদাসীন মনে করো না। তবে আল্লাহ তাদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দেন। যেদিন চোখসমূহ বিস্ফোরিত হবে। মানুষ মাথা উপরমুখী করে পড়িমরিভাবে দৌড়াতে থাকবে। তাদের চোখ নিজেদের দিকে ফিরবে না এবং তাদের অন্তর দিশেহারা হয়ে যাবে। মানুষকে আজাব আসার দিন সম্পর্কে সাবধান করে দাও। যেদিন তাদের কাছে আজাব আসবে, সেদিন জালেমরা বলবে, ‘হে আমাদের প্রভু! সামান্য সময়ের জন্য আমাদের অবকাশ দিন, আমরা আপনার ডাকে সাড়া দেব (আর কারো ওপর জুলুম করব না) এবং রাসুলদের অনুসরণ করব।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত-৪২, ৪৩)

অন্যত্র আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘জুলুমবাজরা তাদের জুলুমের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে, তাদের গন্তব্যস্থল কেমন। আর তোমরা জালেমদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না। জালেমদের সহযোগী হবে না। তাহলে জাহান্নামের আগুন তোমাদেরও স্পর্শ করবে।’ (সুরা হুদ, আয়াত-১১৩) জুলুমের ভয়াবহতা সম্পর্কে কোরআন-হাদিসে অসংখ্য বর্ণনা আছে। জালেম বা জুলুমবাজদের জানা উচিত, তাদেরও একদিন আল্লাহর দরবারে গিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘জালেমদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আল্লাহকে উদাসীন মনে করো না। যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে, জুলুমবাজরা তাদের অত্যাচারের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে।’ (সুরা শুরা, আয়াত-২২)

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালা জালেমদেরকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন তাদের পাকড়াও করেন। তখন আর তাদের রেহাই দেন না। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেন, তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদে পাকড়াও করেন। তাঁর পাকড়াও হয় অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, ‘ঋণী ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে টাল-বাহানা করাও জুলুমের শামিল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২২২৭) হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। রসূলুলাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুমিনরা যখন দোজখের আগুন থেকে পরিত্রাণ পাবে। তখন জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে একটি সেতুর ওপর তাদেরকে থামানো হবে এবং তখন দুনিয়ায় তারা একে অপরের প্রতি যে জুলুম করছিল তার প্রতিশোধ নেওয়া হবে। অবশেষে যখন তারা পাপমুক্ত হয়ে পবিত্র হবে তখন তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। এরপর তিনি বলেন, সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে  মাহাম্মদের জীবন নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যেকের কাছে দুনিয়ার বাড়িঘর যেমন পরিচিত ছিল, তার থেকেও বেশি জান্নাতের বাড়ি চিনতে পারবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২২৬৩)

বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না; কিংবা তাকে জালেমের হাতে সোপর্দও করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে। আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের কোনো বিপদ দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহের মধ্যে থেকে সবচেয়ে বড় কোনো বিপদ দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলামানের দোষ ঢেকে রাখবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ২২৬৫) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘জুলুম জালেমের জন্য কিয়ামতের দিন কঠিন অন্ধকার হয়ে আসবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২২৭০) হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) মুআয (রা.)-কে ইয়েমেনে পাঠালেন এবং তাকে বললেন, ‘মজলুমের অভিশাপকে ভয় কর। কেননা; তার অভিশাপ ও আল্লাহর মাঝে কোনো আঁড়াল থাকে না।’ (সহি বুখারি, হাদিস নং-২২৭১) হজরত সাঈদ ইবনে যায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুলাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি কারো জমি জোর-জবরদস্তি করে কেড়ে নেবে কিয়ামাতের দিন সাতস্তর জমি তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২২৭৫)

ক্ষমতা থাকলেই জুলুম করা ঠিক নয়। জুলুমকারী জুলুম করে সুখে নিদ্রা গেলেও মজলুমের চোখে ঘুম থাকে না। তার কষ্টের কথা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। মজলুমের অভিশাপের পরিণাম হয় ভয়াবহ। মানুষ মানুষের অধিকার হরণ, নির্যাতন, উৎপীড়ন ও যন্ত্রণা দেওয়া যেমন জুলুম। তেমনি মহান আল্লাহর সঙ্গে তাঁর কোনো সৃষ্টিকে শরিক করা সবচেয়ে বড় জুলুম। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর সাথে কোনো শরিক করো না। নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে বড় জুলুম।’ (সুরা লুকমান, আয়াত-১৩) দুনিয়াবাসীকে সত্যের দিকে ডাকা প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ। যারা মানুষকে এ হক থেকে বঞ্চিত করে, তারাও জালেমের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সত্য রয়েছে, সে তা প্রকাশ না করে গোপন রাখে?’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৪০) আর যেসব মানুষ আল্লাহর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাদের সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন, ‘তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার রবের আয়াত শুনিয়ে উপদেশ দেওয়ার পরও সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।’ (সুরা কাহফ, আয়াত-৫৭)

 

লেখক : শিক্ষার্থী, আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া মেখল, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads