• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
বদর যুদ্ধ : ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

বদর যুদ্ধ : ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা

  • প্রকাশিত ৩০ এপ্রিল ২০২১

ইসলাম শুধু আরবের মরুভূমিতেই কেবল মহীরুহ হিসেবে আসেনি। বরং মক্কার ঊষর শুষ্ক মরুভূমিতে বোপিত এমন একটি বটবৃক্ষের শীতল ছায়া, যা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। ইসলাম আরবের রুক্ষ মানুষগুলোর মন জয় করা এত সহজ হয়ে আসেনি। বরং তাদের কোরবানির চরম নজরানা আর ঈমানের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- ‘আমি অবশ্যই ঈমানের দাবিতে তোমাদের পরীক্ষা করবো, কখনো ভয় ভীতি দ্বারা, কখনো ক্ষুধাও অনাহার দ্বারা, কখনো বা তোমাদের জানমাল ও ফল-ফসলাদি বিনষ্ট দ্বারা, যারা ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করে; তুমি সেই ধৈর্যশীলদের জান্নাতের সুসংবাদ দান করো।’ (আল কোরআন ২:১৫৫)

এরকম কঠিন মুহূর্তে মুসলমানদের পাড়ি দিতে হয়েছে বিশাল আটলান্টিকের চেয়েও চরম তরঙ্গায়িত ও বিক্ষুব্ধ এক বন্ধুর পথ। ত্যাগের মহিমায় রাখতে হয়েছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ঝরাতে হয়েছে রক্ত, দিতে হয়েছে প্রাণ, ছাড়তে হয়েছে নিজের জন্মভূমি, মোকাবিলা করতে হয়েছে ক্ষুধা ও মৃত্যুর শোক‌ এবং সইতে হয়েছে জুলুম-নির্যাতন। এক্ষেত্রে জুলুম-নির্যাতন এতটাই অসহনীয় এবং মাত্রাতিক্ত হয়ে পড়ে যে, সাহাবিরা আল্লাহর রাসুলকে সাহায্যের জন্য আবেদন শুরু করেন। হজরত খাব্বাব ইবনে আরাত রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে একটি হাদিস প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন- আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কেনো আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য দোয়া করছেন না? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ তাওহিদবাদী ছিলেন; যাদের মস্তকের ওপর করাত রেখে পা পর্যন্ত চিরে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল; কিন্তু তথাপি তারা তাওহিদের অধীনের অনুসরণ থেকে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি। আর কাউকে কাউকে লোহার চিরুনি দ্বারা দেহের মাংস হাড় থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল; কিন্তু তবু তারা আল্লাহর দ্বীন পরিত্যাগ করেননি। আল্লাহর শপথ! আমাদের এই দিনকে আল্লাহ পরিপূর্ণ করবেনই। (মুসনাদে আহমদ)

মক্কায় মুসলমানদের ঈমানের কিছু পরীক্ষার দৃষ্টান্ত। আম্মার ইবনে ইয়াসার সুমাইয়াদের শাহাদতবরণ, আবিসিনিয়ায় হিজরত, শিয়াবে আবু তালিবের বন্দিদশা, ক্ষুধা মৃত্যুর সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই, চূড়ান্তভাবে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে মদিনায় হিজরত। ইরশাদ হয়েছে- ‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, নিশ্চয়ই জানমালের ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে তোমাদের পরীক্ষা নেওয়া হবে, এ পরীক্ষা দিতে গিয়ে তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী সম্প্রদায়- যাদের আল্লাহর কিতাব দেওয়া হয়েছিল এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্যদের শরিক করেছে, তাদের উভয়ের কাছ থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথাবার্তা শুনবে; এ অবস্থায় তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং আল্লাহকে ভয় করো, তাহলে অবশ্যই তা হবে বড় ধরনের এক সাহসিকতার ব্যাপার।’ (আল কোরআন)। মদিনা হিজরত করে মুসলমানদের আরো বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হয়েছে। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মসহ বিভিন্ন গোত্রের সাথে কম্প্রোমাইজ করে চলতে হয়েছে।

মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে মদিনা একটি অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক আমির আলী বলেন, ‘সমগ্র মদিনাসহর বিদ্রোহ বিশ্বাসঘাতকতায় ভরে গিয়েছিল।’ এর কারণ হলো মক্কার কুরাইশদের ক্রমাগত শত্রুতা হুমকি এবং সীমান্ত আক্রমণ। ঐতিহাসিক এএইচ সিদ্দিক এর মতে, ‘মদিনা সনদের ফলেই মুহাম্মাদ (সা.) এর সর্বোচ্চ সামরিক বিচারক প্রশাসনিক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান হলে মদিনা রাষ্ট্র একটি শক্ত ভিত্তি লাভ করে।’ এতদসত্ত্বেও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব ধরনের শত্রুতা পরিহার করে মদিনা ও মদিনাবাসীর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন নবীজি। কোরায়েশদের হুমকি মোকাবিলা করার জন্য এবং কুরাইশদের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখার জন্য বাণিজ্যপথ ও সীমান্ত পথে টহল জোরদার করেন।

ঐতিহাসিক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায়কে রক্ষায় দায়িত্ব মোহাম্মদ (সা.)-এর ওপর এসেছিল এবং তিনি একজন দক্ষ সেনানায়েকের মতো শত্রুর গতিবিধি খেয়াল রাখার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন।’ এর ফলে বিভিন্ন সময়ে দুই পক্ষের মধ্যে ছোটখাটো যুদ্ধ সংঘটিত হয় যাকে সারিয়া বলে। বদর যুদ্ধের আগে এরকম প্রায় আটটি সারিয়া সংঘটিত হয়। যা উল্লেখ রয়েছে আর রাহীকুল মাখতুম গ্রন্থে। চূড়ান্তভাবে আবু সুফিয়ানের কাফেলায় আক্রমণের প্ররোচনা আর সারিয়া ই নাখলা বদর যুদ্ধ অনিবার্য করে তোলে। এসএম ইমাম উদ্দিন বলেন, ‘আব্দুল্লাহ আল হাজরামীর পুত্র আমার এর মৃত্যু মক্কাবাসীর মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে এবং এটি বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়।’ হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা না থাকলেও আল্লাহ তায়ালার ঐশীবাণী পেয়ে তিনি আর এই যুদ্ধ থেকে পিছু হটতে পারেননি। ইরশাদ হয়েছে- ‘তাদের সাথে যুদ্ধ করো, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তবে সীমালঙ্ঘন করো না, কারণ সীমালঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।’ (আল-কোরআন, ২:১৯০)

আবু সুফিয়ানের প্ররোচনায় মক্কার কুরাইশ নেতা আবু জেহেল, আবু লাহাব, উতবা, শায়বাদের নেতৃত্বে সশস্ত্র এক হাজার সৈন্য নিয়ে তারা মদিনা আক্রমণের জন্য রওনা দেন। ইতোমধ্যেই খবর হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছালে তিনি মদিনায় মুসলমানদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন। তার এই সৈন্যবাহিনীতে মাত্র ৩১৩ জন। একদিকে আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত এক হাজার সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী অন্যদিকে অস্ত্রবিহীন মাত্র ৩১৩ জন একটা বাহিনী। যদিও ইতোমধ্যে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বের বাণিজ্য কাফেলা যুদ্ধ এড়িয়ে মক্কার দিকে রওনা দেয়।

যুদ্ধের মাঝ মুহূর্তে হজরত মোহাম্মদ (সা.) তার মজলিসে শুরা নিয়ে একটি বৈঠক করেন এবং সেখানে দুর্বল ঈমানের লোকেরা রক্তাক্ত সংঘর্ষের কথা শুনে ক্ষেপে ওঠে কিন্তু দৃঢ়চেতা ঈমানদার লোকেরা মুখোমুখি সংঘর্ষকে আলিঙ্গন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে যায়।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যেমন তোমার প্রতিপালক তোমাকে ন্যায়সঙ্গতভাবে তোমার গৃহ থেকে বের করেছিলেন, অথচ বিশ্বাসীদের একদল তা পছন্দ করেনি। সত্য সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হওয়ার পরেও তারা তোমার সঙ্গে বিতর্ক করতে থাকে, মনে হচ্ছিল যেন তারা মৃত্যুর দিকে চালিত হচ্ছে আর তারা যেন তা প্রত্যক্ষ করছে।’ (আল কোরআন, ৮:৫-৬)। এখানে হজরত আবু বকর, ওমর, সাদ ইবনে মুয়াজের মতো মুহাজির এবং আনসার সাহাবিদের ঈমানদীপ্ত বক্তৃতার বলে ৩১৩ জন মুসলমান নিয়ে, বিশাল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটা বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য সৈন্য সমাবেশ করেন।

ঐতিহাসিক আল ওয়াকিদি বলেন, ‘হজরত মোহাম্মদ (সা.) মুসলিম সৈন্য সমাবেশের জন্য এমন একটি স্থান বেছে নেন যেখানে সূর্যোদয়ের পর যুদ্ধ শুরু হলে কোনো মুসলমান সৈন্যের চোখে সূর্যের কিরণ পড়বে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করো তিনি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের তন্দ্রায় আচ্ছন্ন এবং আকাশ থেকে তোমাদের ওপর বারি বর্ষণ করেন, তা দ্বারা তোমাদের তিনি পবিত্র করবেন, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা প্রসারণ করবেন, তোমাদের হূদয় শক্ত করবেন এবং তোমাদের পা স্থির করবেন।’ (আল কোরআন, ৮:১১)

প্রত্যুষে দুটি বাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে বদর প্রান্তরে। ঠিক তখন আল্লাহ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করেন, হে আল্লাহ কুরাইশরা পরিপূর্ণ অহংকারের সাথে তোমার বিরোধিতায় এবং তোমার রাসুলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে এগিয়ে এসেছে। হে আল্লাহ আমার প্রতিশ্রুত সাহায্যের বড় বেশি প্রয়োজন। হে আল্লাহ তুমি আজ ওদের ছিন্নভিন্ন করে দাও!’

যুদ্ধ শুরু। প্রথমে মল্লযুদ্ধে উতবা, শায়বা, ওয়ালিদদের মুখোমুখি হন হামজা, আলি, এবং আবু ওবায়দা। খুব সহজেই হামজা আলি এবং আবু ওবায়দা অন্যদেরকে ধরাশায়ী করে ফেলেন। এদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করতে থাকেন, হে আল্লাহ যদি আজ মুসলমানরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তবে দুনিয়ায় তোমার এবাদত করার মতো কেউ থাকবে না, হে আল্লাহ তুমি কি চাও, আজকের পর কখনোই তোমার এবাদত কর না হোক? আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের সাহায্য করবো এক হাজার ফেরেশতা দিয়ে, যারা একের পর এক আসবে।’ (আল কোরআন,৮:৯)। ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। সুতরাং তোমরা মুমিনদের অবিচল রাখো, অচিরেই আমি তাদের হূদয়ে ভীতির সঞ্চার করাব যারা কুফরি করে।’ (আল কোরআন, ৮:১২)। ‘তারা দুটি বিবদমান পক্ষ যারা তাদের প্রতিপালক সম্পর্কে বিতর্ক করে।’ (সুরা হজ্জ আয়াত ১৯)

এরপর রাসুল (সা.) হুজরা থেকে বের হতে হতে কাফেরদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এ দল শিগগিরই পরাজিত এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে’। (সুরা আল-কামার আয়াত-৪৫)। একদিকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের মাঝে কথা বিনিময় হচ্ছে অন্যদিকে বদরের ময়দানে মাত্র ৩১৩ জন বীর যোদ্ধা এক হাজার জনের সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে প্রাণপণে লড়াই করে যাচ্ছে। প্রচণ্ড লড়াইয়ের মধ্যে আবু জেহেল, উতবা, শায়বা, ওয়ালিদের মতো প্রমুখ কুরাইশ নেতা ধরাশায়ী হয়ে বদর প্রান্তরে নিহত হন। একটি অসম যুদ্ধ ছিল, ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে, বাবা ছেলের বিরুদ্ধে, সন্তান তার বাবার বিরুদ্ধে ঈমানের পরীক্ষা দেয়ার জন্য বদর প্রান্তর মুখোমুখি হয়। চূড়ান্তভাবে ৭০ জন কোরাইশ নিহত হয়, ৭০ জন বন্দি হয় এবং ১৪ জন মুসলমান শাহাদত বরণ করেন। এই যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে মুসলমানদের ঈমানের অগ্নিপরীক্ষার বিজয় হয়। কুরাইশদের দম্ভ চূর্ণ হয়।

আল্লাহতায়ালা বদর যুদ্ধ সম্পর্কে সুরা আনফাল নাজিল করেন। প্রকৃতপক্ষে এটি হচ্ছে বদর যুদ্ধ সম্পর্কে আল্লাহর পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন। এই মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা দুনিয়ার কোনো বাদশা সেনানায়ক বা অন্য কারো মূল্যায়নের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের দৃষ্টি সেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং চারিত্রিক দুর্বলতা প্রতি আলোকপাত করেন, যেগুলো তাদের মাঝে তখনো মোটামুটি অবশিষ্ট ছিল যার কিছু যুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধ শেষে প্রকাশ পায়। এ মনোযোগ আকর্ষণে উদ্দেশ্য ছিল যেন মুসলমানরা এসব থেকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন হয়ে পূর্ণতা লাভ করতে সক্ষম হয়। এ বিজয় আল্লাহতায়ালার গায়েবি সাহায্য সহায়তায় লাভ করে মুসলমানরা যেন নিজেদের বীরত্ব বাহাদুরির ধোঁকায় না পড়ে। গণমত সম্পর্কে মৌলিক নীতিমালা এবং যুদ্ধ ও সন্ধির বিধান ব্যাখ্যা করা হয়।

মূলত বদর যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা এবং এই পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে তারা উত্তীর্ণ হয়।

ঐতিহাসিক পি কে হিট্টি তার বই আরব জাতির ইতিহাসে বলেন, ‘ইসলাম তার প্রথম সর্বাত্মক সামরিক বিজয় অর্জন করে বদর যুদ্ধের মাধ্যমে।’

আবু সালেহ

লেখক : প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, এস আলম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads