• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
বন্ধ হোক শ্রম শোষণ

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

বন্ধ হোক শ্রম শোষণ

  • প্রকাশিত ০১ মে ২০২১

প্রতিটি ভালো নিরবচ্ছিন্ন ভালো নয়। এর সঙ্গে  কিছু মন্দও থাকে।  অর্থনীতির বাছ-বিচারে শ্রমবিভাগ জরুরি। মানবিকতার বিচারে তা মানুষে মানুষে বিভাজন ও শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টিকারী। অনুরূপভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র মানুষের নিরাপত্তার জন্য জরুরি হলেও এই সমাজ ও রাষ্ট্র যাদের দ্বারা পরিচালিত হয় তাদের দ্বারাই মানুষ শোষিত, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত। এসব কারণে আমরা সভ্যতা বিকাশের এক পর্যায়ে এসে দেখতে পাই গরু-ছাগলের বেচা-কেনার হাটের মতো আদম সন্তানের বেচা-কেনার হাট বসতে। এক মানুষ কর্তৃক আরেক মানুষের নিরবচ্ছিন্ন মালিকানা লাভের যথেচ্ছ ব্যবহার করা হতো সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও সহযোগিতায়। গৃহপালিত পশুর কাজের সময় নির্ধারিত থাকলেও গৃহভৃত্য মানুষের কোনো কাজের সময় নির্ধারিত ছিল না।

কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের অবস্থাও ঠিক একই রূপ। কৃষিকাজ এমনিতেই শ্রমনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা। এতে প্রচুর শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়। খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে কৃষি শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। শুধু দিনের বেলা নয়, রাতেও তাদের কাজ শ্রম ব্যয় করতে হয়। সুতরাং কৃষিকাজে নির্ধারিত কোনো সময় নেই। কাজের নির্ধারিত সময় না থাকলেও মজুরি সবসময় নির্ধারিত। তাও কোনোরকম বেঁচে থাকার মতো। কৃষিকাজ সরাসরি কৃষি শ্রমিকদের হাতে না থাকায় তারা সবসময় ভূস্বামীদের হাতে বন্দি ছিল। ছিল তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার দাস। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষি-শ্রমিকদের অবস্থা কৃতদাসের মতো ছিল।

এরপর এলো শিল্পবিকাশের যুগ। মানুষ ও পশু-শক্তির বদলে যন্ত্রশক্তির ব্যবহার শিখলো। উৎপাদনের প্যাটার্ন পাল্টে গেলো। ভোগের সামগ্রির বিস্তৃতি ঘটলো। যন্ত্র ব্যবহার করে একসঙ্গে অনেক পণ্য উৎপাদিত হতে শুরু হলো। নতুন নতুন যন্ত্র ও উৎপাদন কৌশল আবিষ্কারের সয়লাব বয়ে গেলো অল্প কিছুদিনের ভেতরে। তথাকথিত এই শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদন ও ভোগের মাত্রাতিরিক্ত উন্নতি হলেও শ্রমজীবী মেশিনম্যান তথা সাধারণ শ্রমিকদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। কাজের সময়সীমাও অনির্ধারিত রয়ে গেলো। উদয়-অস্ত মেশিন চালিয়ে কাজ করেও রেহাই পেতো না তারা। এই অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে যক্ষ্মাসহ বিভিন্ন অসুখ-বিসুখের আক্রান্ত হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেলেও কাজের নিষ্কৃতি ছিলো না এতোটুকুনও। মজুরির হারও ছিল তথৈবচ, কোনোরকম মাথা গুঁজবার জন্য। এভাবে চলতে লাগলো নতুন ধারায় নতুন কৌশলে শ্রম শোষণ। এক সময় শ্রমিক ভায়েরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে। গুলি হলো শান্তিপূর্ণ মিছিলে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো অনেক শ্রমিক। এর মধ্যে নিহত কয়েকজন। শ্রমিকদের এই মহান আত্মত্যাগের কারণে পহেলা মেকে স্মরণীয় রাখার জন্য পরবর্তীতে এই দিনটাকে আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গেও প্রতিবছর পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে।

সফল শিল্পবিপ্লবের পর সভ্যতা এখন সেটেলাইট ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে উপনীত হয়েছে। রিমোট কম্পিউটার দ্বারা এখন সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত। যারা শিল্পবিপ্লবকে সফলভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে, তরা উন্নত বিশ্ব হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। আর যারা তা পারেনি তারা অনুন্নত দেশ নামে অভিহিত। এতো কিছুর পরও শ্রম শোষণ বন্ধ হয়নি। গরিব দেশগুলো আগের মতোই রয়েছে। তবে উন্নত দেশগুলো এখন আর আগের মতো শ্রম শোষণ করতে পারে না। তাই তারা গরিব রাষ্ট্র থেকে শ্রমিক নিয়ে নতুন পদ্ধতিতে শোষণ চালাতে থাকে। কেমন যেন দাসপ্রথার মতো শ্রমিক আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে। সঙ্গে চলছে অমানবিক শাস্তি আর অসহনীয় যন্ত্রণাদায়ক নিপীড়ন। অনেক সময় তাদের কাজের সময়ও থাকে অনির্ধারিত।

কেবল যে মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শ্রমিকরা শোষিত হচ্ছে, তা নয়। ওভারটাইম এবং প্রতারণার মাধ্যমেও তারা শোষিত হচ্ছে। মানুষ কোনো মেশিন নয়। মেশিনও অত্যধিক ব্যবহারে গরম হয়। ক্ষয় হয়। অবশেষে অচল হয়ে পড়ে। ওভারটাইমের লোভ দেখিয়ে একজন শ্রমিককে দিয়ে নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত সময় কাজ করিয়ে অল্পদিনেই তার জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দেওয়া হয়। আর এ কাজটি করা হয় অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে। নির্দিষ্ট সময়ের মজুরি এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, যা দিয়ে শ্রমিক তার সংসার চালাতে পারে না। তখন সে বাধ্য হয় ওভারটাইম কাজ করতে। বিনোদন মানুষের ছয়টি মৌলিক চাহিদার একটি। খাদ্য-বস্ত্রের মতো বিনোদন ছাড়াও মানুষ বাঁচতে পারে না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কর্তৃকও তা স্বীকৃত। সুতরাং একজন শ্রমিকের বিশ্রাম ও বিনোদনের সময় কমানোও আরেকটি শ্রম শোষণ।

সময়মতো মজুরি না দেওয়াও এক প্রকার শ্রম শোষণ। দেখা যাচ্ছে, এ কাজটি অহরহ হচ্ছে। অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই বিভিন্ন অজুহাতে এই কাজটি করা হয়। করা হয় এই কারণে যে, পরবর্তীতে পুরো মজুরি মেরে দেওয়ার সুযোগ হয় এবং করাও হয় তাই। কাজ শেষ হয়ে গেলে প্রতারণা বা শক্তির আশ্রয় নিয়ে গোটা মজুরি মেরে দেওয়া হয়। এটা শ্রম শোষণের আরেকটি কলঙ্গকজনক দিক। এই কাজটি যারা করে তারা প্রাথমিক পর্যায়ে মজুরি নির্ধারণ করে তুলনামূলক একটু বেশি। আর বেশি পাওয়ার আশায় শ্রমিকরা বাকিতেও কাজ করে যায়। আদি থেকে আজ অবধি পৃথিবীতে যত শোষণ-নির্যাতন হয়েছে, তার সিংহভাগই শ্রম শোষণ। অথচ আল্লাহতায়ালা শ্রমিকের প্রাপ্য না দেওয়াকে কঠিন ধমকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালা বলেন, কিয়ামত দিবসে আমি তিন লোকের বিরুদ্ধে বাদী হবো, ১. যে লোক আমার নামে অঙ্গীকার করে পরে তা ভঙ্গ করেছে। ২. যে লোক স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য খেয়েছে। ৩. যে লোক শ্রমিক নিয়োগ করে পূর্ণ কাজ আদায় করে নিয়েছে, কিন্তু তার প্রাপ্য মজুরি প্রদান করেনি।’ (বুখারি, হাদিস নং-২২২৮) আসলে শ্রম শোষণের মূলকারণ হচ্ছে অতিরিক্ত ভোগস্পৃহা। অপরের সেবা গ্রহণের প্রবণতা এবং স্বল্পসময়ে ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। ইসলামধর্ম এগুলোর পক্ষে নয়। ইসলামে সবধরনের শোষণ নিষিদ্ধ ও হারাম।

লেখক : মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads